1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

অসীম প্রত্যাশায় সসীম সামর্থ্যের টিসিবি

সমীর কুমার দে ঢাকা
২৫ মার্চ ২০২২

নিত্যপণ্যের বাজারের মোট চাহিদার সর্বোচ্চ ৪ থেকে ৬ শতাংশ পূরণ করতে পারে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ বা টিসিবি৷ তাহলে নিত্যপণ্যের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে টিসিবিই মূল বিকল্প হবে কী করে?

https://p.dw.com/p/491Pt
ছবি: Abdul Halim

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, টিসিবির মাধ্যমে অল্প সময়ের জন্য হয়ত কিছু মানুষকে নিত্যপণ্য দেওয়া যাচ্ছে, কিন্তু এটা কোনো সমাধান না৷ তারা মনে করেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে যে পদ্ধতিগুলো আছে সেগুলোকে কাজে লাগাতে হবে৷ অসাধু ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে৷

টিসিবির যুগ্ম পরিচালক হুমায়ুন কবীরও ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘টিসিবি কখনো বাজার নিয়ন্ত্রণ করে না৷ সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নিম্নবিত্ত মানুষের কাছে আমরা কিছু নিত্যপণ্য পৌঁছানোর চেষ্টা করি, যা সফলভাবে করা হচ্ছে৷ এবার সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঈদের আগে এক কোটি পরিবারের কাছে দুই দফায় কয়েকটি নিত্যপণ্য সুলভ মূল্যে পৌঁছানো হবে৷ সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে সারা দেশে (ঢাকা ও বরিশাল সিটি কর্পোরেশন ছাড়া ) ও ৬ মার্চ থেকে ঢাকা ও বরিশাল সিটি কর্পোরেশনে পণ্য দেওয়া হচ্ছে৷ ঢাকা শহরে ১২ লাখ ও বরিশাল শহরে ৯০ হাজার পরিবারকে এসব পণ্য দেওয়া হবে৷ আর সারাদেশে দেওয়া হবে ৮৭ লাখ ৩০ হাজার পরিবারকে৷ এখন ঢাকা শহরের প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রতিদিন একটি করে টিসিবির ট্রাক পাঠানো হচ্ছে৷ স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলররা সেটার মনিটরিং করছেন৷ সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নিম্নবিত্ত মানুষকে এটা দেওয়া হচ্ছে৷’’

টিসিবি কখনো বাজার নিয়ন্ত্রণ করে না: হুমায়ুন কবীর

টিসিবির সক্ষমতা কতটুকু?

পণ্যমূল্য উত্তাপ ছড়ালে প্রকৃত দামের চেয়ে বেশি দামে ভোক্তাকে কিনতে হয় পণ্য৷ স্বস্তি দিতে কম দামে পণ্য নিয়ে মাঠে নামে টিসিবি৷ তবে বাজার নিয়ন্ত্রণে এই প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা খুবই কম৷ এই প্রতিষ্ঠানকে সক্রিয় করতে ২০১৪ সালের ২৮ জুন নির্দেশনা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী৷ আট বছরে বাজারে এই প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ তেমন বাড়েনি৷ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পণ্য কেনার জন্য কাঙ্খিত মাত্রায় অর্থ বরাদ্দ মেলে না৷ প্রতি বছরই ‘লোন অ্যাগেইনস্ট ট্রাস্ট রিসিপ্ট’ বা এলটিআরের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে অর্থ এনে পণ্য কেনা হয়৷ তবে বারবার চাহিদা দেয়া হলেও এই প্রতিষ্ঠানে কোনো এককালীন অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়নি৷ জনবল সংকট তো আছেই৷

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘টিসিবি যদি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরকারি প্রক্রিয়া, নিয়মনীতির আওতায় থাকে, তাহলে টিসিবিকে গতিশীল করা কঠিন৷ নিত্যপণ্যের বাজারে কোনো সমস্যা সৃষ্টি হলে সেটা মেটানোর জন্য সরকার টিসিবিকে ব্যবহার করছে৷ এটার দরকার আছে৷ কোনো পণ্যের দাম বেড়ে গেলে সেটা টিসিবির আওতায় দেয়া হয়৷ লাভ-লোকসান যা-ই হোক না কেন, টিসিবিকে স্বাধীনভাবে পণ্য কেনাবেচা করতে দিতে হবে৷ সরকারি সংস্থা হিসেবে নয়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বতন্ত্রভাবে কাজ করতে দিতে হবে৷ টিসিবির সাংগঠনিক কাঠামো ব্যবসায়িক কাঠামোর মতো করতে হবে, যা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ছিল৷ টিসিবির সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য গুদামের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি, আধুনিক মানসম্মত গুদাম নির্মাণ, উৎপাদন মৌসুমে পণ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং যথাসময়ে বাজারজাত করে পণ্যের সরবরাহ ও মূল্য নিয়ন্ত্রণে বাজার ভারসাম্য রাখতে পারে প্রতিষ্ঠানটি৷’’

অসাধু ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করতে নিয়মিত বাজার মনিটরিং করতে হবে: ড. মোস্তাফিজুর রহমান

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নে টিসিবির নেয়া পদক্ষেপগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য চট্রগ্রামে প্রতিষ্ঠানটি ৪০ হাজার বর্গফুটের ৮ হাজার মেট্রিক টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি গুদামের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে৷ এছাড়া মৌলভীবাজার ও রংপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ে সরকারি অর্থায়নে গুদাম নির্মাণের কাজ চলছে৷ বাজার থেকে কিনে বা আমদানি করে চিনি, ভোজ্য তেল ও মসুর ডাল সংরক্ষণ করে রাষ্ট্রায়ত্ত এ প্রতিষ্ঠান৷

কিভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব?

ব্যবসায়ীদের ছেড়ে দিয়ে শুধু টিসিবিকে মাঠে নামিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয় বলে মনে করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বা সিপিডির সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘সংকটের সময় টিসিবিকে নামানো হয়৷ এটা ঠিক আছে৷ অন্যান্য আরো অনেক দেশেই আরো বড় পরিসরে সরকারি প্রতিষ্ঠান জনগণকে রেশন দেয়৷ স্বাধীনতার আগে-পরে আমাদের এখানেও রেশনের ব্যবস্থা ছিল৷ কিন্তু এখন তো আর সেভাবে দেওয়া হয় না৷ তারপরও সরকার সর্বশেষ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এক কোটি পরিবারকে ঈদের আগে দুই দফায় কিছু নিত্যপণ্য দেবে, এটা খুবই ভালো সিদ্ধান্ত৷ কিন্তু এটা কোনো স্থায়ী সমাধান না৷ বাজারে নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে হলে বা অসাধু ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করতে হলে নিয়মিত বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা করতে হবে৷ সরকারের সবগুলো সংস্থাকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে৷ এখন ব্যবসায়ীরা যদি সিন্ডিকেট করে, সেটা যদি না দেখেন, তাহলে কোনো সমাধান হবে না৷’’

সম্প্রতি কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, কৃষকের ক্ষেতে যে সবজির দাম ১৩ টাকা, ঢাকার বাজারে সেটা বিক্রি হচ্ছে ৩৮ টাকায়৷ কিভাবে এত দাম বেড়ে যাচ্ছে? ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘‘এখানে ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে ট্রাক ভাড়া বেড়ে গেছে৷ তা-ও সেটা কতটা? অর্থাৎ, এখানে কোনো মধ্যস্বত্বভোগী আছে৷ তারাই এটা নিয়ন্ত্রণ করছে৷ এরা কারা, কিভাবে করছে সেটা খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নিতে হবে৷’’

হঠাৎ করে দেশে ভোজ্য তেলের বাজার অস্থির হয়ে পড়েছে৷ বিশ্ববাজারে তেলের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কেন দেশের বাজারে তেলের দাম বেড়ে যায়? এখানে যে তেল বিক্রি হচ্ছে সেটা বেশ কিছুদিন আগেই আমদানি করা৷ এখানে কি ব্যবসায়িদের কারসাজি নেই? ভোজ্যতেল আমদানিকারক মোহাম্মদ আলী ভুট্টো ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের ৯৫ শতাংশ ভোজ্যতেল আমদানি করতে হয়৷ আমরা সবসময় আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করেই তেল বিক্রি করি৷ ৭০০ ডলার যে ব্যারেলের দাম ছিল ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর সেই তেলের দাম ১ হাজার ৯৪০ ডলারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে৷ এখন আবার সেটা ২০০ ডলার কমেছে৷ সরকারও প্রতি লিটার তেলের দাম ১০ টাকা করে কমিয়েছে৷ আমি যে তেল ১ হাজার ৯৪০ ডলারে কিনেছি, সেটা এখন কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে৷ একজন ব্যবসায়ী কি ভর্তুকি দিয়ে তেল বিক্রি করবেন? আমরা প্রতিনিয়ত সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষন অধিদপ্তরের তদারকির মধ্যে থাকি৷’’

বাজারে সরবরাহ

গত বুধবার ঢাকার ব্যবসায়ীদের নিয়ে বৈঠকে বসেছিলেন কৃষি বিপনন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আব্দুল গাফ্ফার খান৷ ওই বৈঠকে কী বলেছেন ব্যবসায়ীরা? এ প্র্রশ্নের জবাবে আব্দুল গাফ্ফার খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ব্যবসায়ীরা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন, তাদের কাছে নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে৷ ইতিমধ্যে বাজারে দাম কমতে শুরু করেছে৷ অনেক পণ্যের দাম কমেছে৷ আর এক সপ্তাহ পরে যে রোজা শুরু হতে যাচ্ছে, সেখানে যাতে কোনো পণ্যের সংকট না হয়, সেটার জন্য মূলত ব্যবসায়ীদের ডাকা হয়েছিল৷ তারা আমাদের সহযোগিতা করবে বলে জানিয়েছে৷ আমরাও আশা করছি, রোজার মধ্যে আর কোনো পণ্যের মূল্য বাড়বে না৷’’

কিন্তু বাজারে পণ্য সরবরাহের ঘাটতি না থাকলে মূল্য কমছে না কেন? টিসিবির লাইনে কোথাও কোথাও মধ্যবিত্তদেরও কেন দেখা যাচ্ছে? ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘‘করোনার কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও কমে গেছে৷ তার মধ্যে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণে অনেক মধ্যবিত্তকেও এখন টিসিবির লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে৷’’ ড. মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, ‘‘এখন টিসিবির ট্রাকে একজন নিম্নবিত্তকে একবেলা দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে৷ ফলে তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে, ওই একবেলা সে উপার্জন বন্ধ করে কম মূল্যে পণ্য কিনবে, নাকি লাইনে না দাঁড়িয়ে উপার্জন করে বেশি মূল্যে পণ্য কিনবে? করোনার কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অনেকাংশেই কমেছে৷’’

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য