অসহায় আলাউদ্দিন খান, অসহায় ‘দেবী দুর্গা’
৩১ মার্চ ২০২১ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের সংগীতাঙ্গনও আবার হামলায় বিধ্বস্ত৷
নরেন্দ্র মোদী ও তার হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপির বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু নির্যাতনে মদতের অভিযোগ ভারতেও ওঠে৷ তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয় প্রচুর৷ গতকাল মঙ্গলবারও হয়েছে৷ বাংলাদেশের ডেইলি স্টার-এর অনলাইন সংস্করণের খবরেও বলা হয়েছে, ‘‘নরেন্দ্র মোদীর তামিলনাড়ু সফরের আগে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, কালো পতাকা ও ‘মোদী ফিরে যাও’ লেখা প্ল্যাকার্ড প্রদর্শনের অভিযোগে চেন্নাইয়ের কোয়েমবেদু এলাকা থেকে প্রায় ৬০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’’
ইন্ডিয়া টুডে-কে উদ্ধৃত করে ডেইলি স্টারের খবরে আরো জানানো হয়, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধ নিয়ে জাতিসংঘে আলোচনার সময় শ্রীলঙ্কা সরকারের বিরুদ্ধে ভোট না দেওয়ায় মোদী সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন তারা৷ মোদী ও শ্রীলঙ্কার নেতা মাহিন্দা রাজাপাকসের ছবি প্রদর্শন করে বিক্ষোভ করার সময় বিক্ষোভকারীরা আরো বলেন, ‘‘ব্রিটেন এবং জার্মানিসহ ২২টি দেশ তামিলদের সমর্থন করেছে এবং যুদ্ধাপরাধের জন্য শ্রীলঙ্কাকে দায়ী করেছে। কিন্তু, ভারত সরকার ভোট দেয়নি এবং ওয়াকআউট করে, যা শ্রীলঙ্কার প্রতি স্পষ্ট সমর্থন। এটা শ্রীলঙ্কার তামিল জনগণ এবং এখানকার তামিলদের সঙ্গে বড় ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা।’’
ভারতের তামিলনাড়ুতে মোদীবিরোধী বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীদের উদ্ধৃত করে খবরে আরো বলা হয়, ‘‘গৃহযুদ্ধের সময় শ্রীলঙ্কায় অনেক হিন্দু মন্দির ধ্বংস করা হয়েছিল এবং হিন্দুদের হত্যা করা হয়েছিল। তাই বিজেপি সরকারের ভোট না দেওয়া তামিলদের স্বার্থবিরোধী একটি কাজ।’’ বিক্ষোভকারীদের একটাই কথা, ‘‘আমরা চাই মোদী ফিরে যান এবং এখানকার জনগণের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা করায় তিনি যেন তামিলনাড়ুতে না আসেন।’’
ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ইতিহাস অনেক দীর্ঘ হলেও বাবরি মসজিদ হামলার পর থেকে বলতে গেলে সব দাঙ্গাতেই বিজেপি এবং সমমনা দলগুলোর সম্পৃক্ততা ও মদতের অভিযোগ রয়েছে৷ সর্বশেষ দিল্লি দাঙ্গাসহ অনেক দাঙ্গায় উসকানি দিয়েছে বিজেপি নেতাদের একাংশ৷ দাঙ্গা রোধে আন্তরিকতার অভাব লক্ষ্য করা গেছে মোদী সরকার বা সংশ্লিষ্ট এলাকার স্থানীয় সরকারের কর্মকাণ্ডে৷
এসবের বিরোধিতা এবং প্রতিবাদও হয়েছে ভারতে৷
তবে তামিলনাড়ুর বিক্ষোভটা একটু অন্যরকম, কারণ, আগে ভারতে মোদী এবং তার দল ও সরকারের বিরুদ্ধে প্রধানত মুসলিম ও দলিতদের নির্যাতনের অভিযোগই উঠেছে৷ এবার তামিল এবং হিন্দুদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগেও বিক্ষোভ দেখা গেল৷ সেই বিক্ষোভে অবশ্য মুসলিম নির্যাতনের বিষয়টি যেন গুরুত্ব পায়নি৷
বাংলাদেশে হেফাজতে ইসলামের মোদীবিরোধী বিক্ষোভের চিত্রটা সম্পূর্ণ বিপরীত৷ দেশের বিভিন্ন স্থানে চলা বিক্ষোভ ও ধর্মঘট দৃশ্যত শান্তিপূর্ণ হয়নি৷ সেখানে ভারতে ‘নিম্নবর্ণের’ হিন্দুদের প্রতি, শ্রীলঙ্কার তামিলদের প্রতি মোদীর বৈষম্যমূলক নীতি এবং একই সময়ে বাংলাদেশ সফর করে যাওয়া রাজাপাকসের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদের শব্দ শোনা যায়নি৷ এসব ছাপিয়ে গেছে দুটি বিষয়৷ এক, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে মৃত্যুর ঘটনা৷ ১৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেলেও হেফাজত বলছে ১৭ জন৷
দুই, বিক্ষোভ ও ধর্মঘটের নামে চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ময়মনসিংহ, খুলনা, সিলেট, রাজশাহীসহ বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক তাণ্ডব৷ এই তাণ্ডবে সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বাড়ি-ঘর এবং উপাসনালয়ের ক্ষতির ভয়াবহ চিত্র সংবাদমাধ্যমে উঠে আসছে৷
একজন মানুষের মৃত্যু বা সামান্য ধ্বংসযজ্ঞও কাম্য নয়৷ সুতরাং সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ তদন্তে এত মানুষের মৃত্যু এবং এত সম্পদ ধ্বংসের জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করে তাদের শাস্তি দেয়া খুব জরুরি৷ কিন্তু বরাবরের মতো আবারও শুরু হয়েছে দায় অস্বীকার, দায় চাপানো এবং ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা দলীয় স্বার্থে পক্ষপাতিত্বের অপকৌশল৷ কয়েকদিন আগে সুনামগঞ্জের শাল্লায় সংখ্যালঘুদের গ্রামে হামলার পর অতীত অভিজ্ঞতা স্মরণ করে লিখতে হয়েছিল, ‘‘প্রতিটি ঘটনায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চলে শুধু দায় এড়ানো আর নিজেদের সাধুসন্ত প্রমাণের প্রতিযোগিতা৷’’
মোদীবিরোধী বিক্ষোভ এবং তা নিয়ন্ত্রণের নামে ঘটে যাওয়া প্রতিটি অনাকাঙ্খিত ঘটনাশেষে প্রাপ্তিও আপাতত ওইটুকুই৷ যে মায়ের বুক খালি হয়েছে, তার বিচারপ্রাপ্তির আশা জাগানোর মতো কিছুই করা হয়নি৷ যাদের কর্মস্থল, বাসস্থান, উপাসনালয় বা সৃজনশীলতা চর্চাস্থান ধুলোয় মিশেছে, তাদের মনেও ভরসা জাগায়নি কোনো পদক্ষেপ৷
তাহলে কি এ ঘটনারও বিচার হবে না? কোনো অপরাধীই শাস্তি পাবে না?
আলাউদ্দীন খানের বিদেহী আত্মা সে আশা করতে পারছে?
পাঁচ বছর আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তার বাড়ির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল৷ তু্চ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটি মহল কিভাবে সুরসম্রাট খাঁ সাহেবের নামে প্রতিষ্ঠিত সংগীত অ্যাকাডেমি এবং জাদুঘরে হামলা চালিয়েছিল তা বিবিসি বাংলাসহ অনেক সংবাদমাধ্যমই প্রচার করেছিল৷
খবর প্রকাশ করে অবশ্য কোনো লাভ হয়নি৷ কারো শাস্তি হয়নি৷ বরং পাঁচ বছরের মধ্যে উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর কায়দায় মোদী কিংবা অন্য কারো বিরুদ্ধের ক্ষোভ-বিক্ষোভের আগুন গিয়ে পড়েছে সেই ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁনের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটিতে৷
কল্পনায় তো অনেক কিছুই পাওয়া যায়, আসুন সুরসম্রাট আলাউদ্দিন খানকেও আমাদের মাঝে একটু ফিরিয়ে আনি৷
ধরুন, উপমহাদেশের চিরপ্রণম্য সংগীতসাধক ফিরে এসেছেন৷ তার কাছে জানতে চাওয়া হলো, ‘‘ওস্তাদজি, আপনি কি আশা করেন এই অপকর্মের বিচার হবে?''
খাঁ সাহেব মলিন হেসে বললেন, যে বছর হিন্দুদের দেবী দুর্গা মেশিনগান হাতে এই ধরায় অসুর নিধনে আসবেন, সেই বছর বিচার অবশ্ই হবে৷
বোঝা গেল, সুরসম্রাট আসলে লোকগানের শিল্পী রবি বাগ্দীর একটি গানের কথা বলছেন৷ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগবঞ্চিত, হতদরিদ্র রবি সেই গানে বলতে চেয়েছেন, ভারতে অপশক্তি, অর্থাৎ অসুরের সংখ্যা এত বেড়ে গেছে যে, মা দুর্গাও আগের মতো শুধু দশ হাত আর একখানা ত্রিশূল নিয়ে এলে অসুররা নির্ঘাত তাকে মেরে ফেলবে৷ তাই রবি বাগ্দী গানে গানে মা দুর্গাকে বলেছেন,
‘‘মা দুগ্গা আসছু যদি গো
সঙ্গে এবার আনবি মেশিনগান
ওমা অসুরদের ওই অত্যাচারে
ও তোর ছেলেদের বাঁচে না প্রাণ৷৷
একটা অসুর মেরে মা গো পাবি না তুই ছুটি
এখন সারা দেশে পথেঘাটে ওরাই কোটি কোটি
দশ হাত দিয়ে মারবি মা গো
আমি গাইবো যে তোর গুণগান৷৷
অসুরে যদি ছরা ফেলে হাতে নেয় গো কামান
একবার দেগে দিলে ভুলি দিবেক বাপের নাম
তাই দেখেশুনে যাবি মা গো
নইলে অকালে হারাবি প্রাণ ৷৷
একটা কথা বলছি মাগো রাখবি মা তুই মনে
গোটা চারেক সাদ্দাম হোসেন পাঠাবি ভুবনে
তোর খাটানি কমবে মাগো ইরাকে আছে তার প্রমাণ৷৷’’
সুরসম্রাট আলাউদ্দীন খানের কথায় খুব স্পষ্ট যে, তিনি মনে করেন, সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়া খারাপ মানুষগুলোকে শায়েস্তা করতে হলে ভারতে যেমন মা দুর্গাকেও পুরোনো কায়দায় সেকেলে অস্ত্র নিয়ে লড়লে হবে না, বাংলাদেশেও তেমনি আপোষ, দলান্ধতা, অনুদারতা, প্রাচীন ধ্যান-ধারণা ঝেড়ে ফেলে কাজ করতে হবে৷
কিন্তু সেই কাজটা করবে কে?