স্থানীয় সরকার নির্বাচন: সময় এবং ‘আসল’ উদ্দেশ্য
১০ জানুয়ারি ২০২৫এরপরই বুধবার প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, “অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচনেরও প্রস্তুতি নিচ্ছে।”
এই বক্তব্যের পর এখন আলোচনা শুরু হয়েছে জাতীয় নির্বাচনের আগে কি তাহলে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হচ্ছে? বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান রিপন বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, "আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন মেনে নেবো না।” বিএনপি এই মুহুর্তে আগে জাতীয় নির্বাচন চায়।
নির্বাচন কমিশন কী ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, আগে কি স্থানীয় নির্বাচন নাকি জাতীয় নির্বাচন? নির্বাচন কমিশনার তাহমিদা আহমদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমরা সব নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। সরকার যে নির্বাচন আগে চাইবে, আমরা সেটা করবো। তবে আমাদের ম্যান্ডেট কিন্তু আগে জাতীয় নির্বাচন করার।”
জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হলে জাতীয় নির্বাচন পিছিয়ে যেতে পারে কিনা জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার তাহমিদা আহমদ বলেন, "আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। ফলে কোনোটার জন্য কোনোটা পেছাবে না।”
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিগত সরকারের আমলে নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী সিটি ও পৌরসভার মেয়র-কাউন্সিলরদের বরখাস্ত করা হয়। ভেঙে দেওয়া হয় জেলা ও উপজেলা পরিষদ। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও সদস্যরা এখনো বহাল থাকলেও তাদের বেশিরভাগই পলাতক বা কাজে অনুপস্থিত। এ অবস্থায় সারা দেশে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদে নাগরিক সেবা নেই বললেই চলে। মানুষ জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, নাগরিকত্বের সনদ ও অন্যান্য নাগরিক সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। কিছু কিছু ইউনিয়ন পরিষদেও প্রশাসক হিসেবে ইউএনও বা সরকারী কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
তা সত্ত্বেও নাগরিক সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলার শালিখা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হোসাইন শিকদার ডয়চে ভেলেকে বলেন, "একজন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান যদি না থাকেন, তাহলে মানুষের যে কী পরিমান দুর্ভোগ, সেটা বলে বোঝানো যাবে না। আমি প্রতিদিন নাগরিক সনদ, জন্ম নিবন্ধনসহ অন্তত ৫০ জনকে এই সেবা দিয়ে থাকি। এখন ইউএনও বা সরকারি কোনো কর্মকর্তার পক্ষে এই সেবা দেওয়া সম্ভব না। আমরা তো মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাগজে সই করে দেই। আর ইউএনওদের কাছে সই নিতে উপজেলায় যেতে হয়। তা-ও আবার যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা সই দেন না। আগে সেক্রেটারির কাছে জমা দিতে হয়, তার সেক্রেটারি সম্মতি দিলে একদিন বা দুইদিন পরে তিনি সই দেন। ফলে মানুষের ভোগান্তি যেমন বেড়ে যায়, তেমনি উপজেলায় যাওয়ার-আসার খরচও বাড়ে।”
এই বাস্তবতায় কোন নির্বাচন আগে হওয়া উচিত জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. তোফায়েল আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "কোন নির্বাচন আগে হওয়া উচিত সেটা তো আমরা বলতে পারি না। আমরা সংস্কারের কথা বলতে পারি। এখন আমি ময়মনসিংহে আছি। মাঠ পর্যায়ে সব ধরনের মতই পাচ্ছি। তবে স্থানীয় পর্যায়ে যেহেতু কোনো জনপ্রতিনিধি নেই, ফলে ওই নির্বাচনটা হয়ে যাওয়াই ভালো।”
দুই দিন আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, "আমাদের কাছে সুপারিশ আসছে আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার জন্য। মানুষ বলছে, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি না থাকায় তারা কাঙ্খিত সেবা পাচ্ছেন না। একটা শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এই শূন্যতা দূরীকরণের জন্য তারা আগে স্থানীয় নির্বাচন চাচ্ছেন।”
সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা চেয়ারম্যানদের স্থলে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অল্পসংখ্যক সরকারি কর্মকর্তা কোনোরকম জোড়াতালি দিয়ে রুটিন কার্যক্রম সচল রেখেছেন। তবে এতে কাউন্সিলর, সদস্য ও অন্যান্য জনপ্রতিনিধির শূন্যতা পূরণ হচ্ছে না। প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে নাগরিক সেবা কার্যক্রম। এ অবস্থা থেকে দ্রুত উত্তরণ প্রয়োজন বলে মনে করেন সাধারণ মানুষ।
যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার একটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বর্তমানে পলাতক রয়েছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমরা তো দায়িত্ব পালন করতে চাই। আমাদের মেয়াদও আছে আরো দুই বছর। এখন আমার বিরুদ্ধে হত্যাসহ ৬টি মামলা দিয়েছে। আদালত কোনো জামিন দিচ্ছে না। ফলে এই পরিস্থিতিতে কিভাবে দায়িত্ব পালন করবো? এলাকার অনেকেই ফোন করে তাদের সমস্যার কথা বলছেন। সরকার আমার ইউনিয়নে প্রশাসক বসিয়ে দিয়েছে। তার কাছে মানুষ যেতে পারে না। ফলে মানুষ চরম হয়রানির শিকার হচ্ছেন।”
অপসারণ করা চেয়ারম্যানদের মধ্যে ১০ জন ইতিমধ্যে আদালতে রিট করে দায়িত্ব ফিরে পেয়েছেন। আরো অনেকেই মামলা করেছেন। এই মামলা চলাকালে নির্বাচন কমিশন স্থানীয় সরকার নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে পারেন কিনা জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরশেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "মেয়াদ যতদিনই থাকুক না কেন, কেউ দায়িত্ব পালন না করলে নির্বাচন কমিশন সেখানে নির্বাচন দিতে পারেন। এখন কেন দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না, সেটা ভিন্ন আলোচনা। নির্বাচন কমিশন তফসিল দিলে কোনো জনপ্রতিনিধি যদি আদালতে যান এবং আদালত যদি ওই এলাকায় নির্বাচন করতে নিষেধ করেন, তাহলে সেখানে নির্বাচন হবে না। অন্য জায়গাগুলোতে তো নির্বাচন অনুষ্ঠানে তখন আর বাধা থাকবে না।”
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংক (ইআইবি)-র ভাইস প্রেসিডেন্ট নিকোলা বিয়ার সাক্ষাতে বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতিও নিচ্ছে।
নাগরিক সেবায় যে বিঘ্ন হচ্ছে, সেটা স্বীকার করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মূখপাত্র উমামা ফাতেমা ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমরা কিন্তু সরকারকে এ ব্যাপারে কিছুই বলিনি। সরকার যে নির্বাচন আগে মনে করবে, সেটা করবে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে হলেও আমাদের কোনো আপত্তি নেই। আমরা শুধু বলেছি, নির্বাচনের আগে ফ্যাসিস্ট সরকারের হত্যাকাণ্ডের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। ফ্যাসিবাদ যাতে ফিরে না আসতে পারে, সেই ধরনের সংস্কার করতে হবে। এগুলো হলে তারপর যে কোনো নির্বাচন হতে পারে।”