বইয়ের তরী
২৩ জুন ২০১৪সুপার মার্কেট আর অ্যামাজনের মতো অনলাইন কোম্পানির সঙ্গে কুলাতে না পেরে ব্রিটেনের ছোটখাট বইয়ের দোকানগুলো যে একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে – সে খবর ভালোই জানতেন সারা৷ একটি বইয়ের দোকান দিয়ে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা যে সহজ হবে না, তাও তাঁর অজানা ছিল না৷ তারপরও তিনি স্বপ্নের পেছনে ছুটলেন৷
‘‘পরিস্থিতি আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম৷ তাই আমি ঠিক করলাম, এমনভাবে দোকানটা শুরু করতে হবে যাতে চমক থাকে, মানুষ আগ্রহী হয়৷''
পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ফেলার পর সারার সামনে প্রথম সমস্যা হলো টাকা৷ ঋণ নিতে ব্যাংকে গেলে তাঁরা হেসেই উড়িয়ে দিল৷ তবে শেষ পর্যন্ত সহায় হলেন সারার বাবা-মা৷ তাঁদের দেয়া ধারের টাকায় সারা কিনলেন সরু, কিন্তু দীর্ঘ একটি নৌযান, ব্রিটেনে যাকে বলা হয় ক্যানাল বার্জ৷ সেই নৌকায় বই সাজিয়ে তিনি ভেসে পড়লেন বার্টন শহরের কাছাকাছি একটি বন্দরে৷
‘‘ক্যানাল বার্জগুলো এত সরু যে ঠিকমতো বই সাজিয়ে রাখতে আমাকে যথেষ্ট খাটতে হলো৷ একটা ভালো বইয়ের দোকানে যথেষ্ট ভালো বই তো থাকতে হবে, তাই না৷''
তবে এ কাজটি করতে গিয়ে প্রতিটি বই নিয়েই সারাকে মাথা ঘামাতে হয়েছে৷ ফলে ব্রিক্রি করাও তাঁর জন্য হয়েছে অনেক সহজ৷
টলমল জল
সারা হেনশোর এই বইয়ের তরী যাত্রা শুরু করে ২০০৯ সালে৷ তিনি এর নাম দিয়েছেন ‘দি বুক বার্জ'৷
শুরুর দিকে অনেকেই আগ্রহ নিয়ে এলো, ব্যবসাও ভালো চললো৷ তবে দুই বছরের মাথায় পরিস্থিতির অবনতি শুরু হলো৷ পায়ের নীচের পাটাতন টলে ওঠায় সারা ভাবতে বসলেন – এত সাধের বইয়ের দোকান কি তবে বন্ধ করে দিতে হবে?
‘‘আমি জানতাম, বহু বইয়ের দোকানের ভাগ্যে ঠিক এ পরিণতিই ঘটেছে৷ এত প্রতিযোগী আর বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পেরে ওঠা সত্যিই কঠিন৷ তখন আবার বিশ্বমন্দার মাঝামাঝি সময়৷ আমি বুঝতে পারছিলাম, হয় আমাকে বন্ধ করে দিতে হবে, না হলে টিকে থাকার জন্য কিছু একটা করতে হবে৷''
টিকে থাকার তাড়না থেকেই সারা তাঁর বইয়ের তরীর নোঙর তুলে নিলেন, ছয় মাস ধরে ভেসে বেড়ালেন ইংল্যান্ড আর ওয়েলসের খালগুলোতে৷ নৌকা নিয়ে তিনিই গেলেন বিভিন্ন শহরের পাঠকের কাছে৷ এতে প্রচার হলো, বিক্রিও বাড়ল৷
খরচ কমানোর জন্য ততদিনে সারা নিজের ফ্ল্যাটটি ছেড়ে দিয়েছেন৷ কোনোরকমে বিছানা আর রান্নার ব্যবস্থা করে নৌকার মধ্যেই শুরু করেছেন বসবাস৷ এখনো তাঁর পুরো সময় বার্জেই কাটে৷
বিক্রি বাড়াতে আরো কিছু নতুন আইডিয়া তিনি চালু করেছেন৷ টাকা না থাকলেও সমস্যা নেই, এক বেলার খাবার, পুরনো বই বা এক দফা চুল কেটে দিয়েও সারার দোকান থেকে বই কেনা যায়৷ সারার ভাষায়, এতে ফল হয়েছে দুটো৷ প্রথমত তাঁর জীবনযাপনের খরচ আরো কমে এসেছে৷ দ্বিতীয়ত, এ সব আইডিয়া আরো অনেক ক্রেতা আকৃষ্ট করতে পারছে৷
বইয়ের দর
ব্রিটিশ খালগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে প্রায় প্রতিটি বড় শহরেই নৌপথে পৌঁছে যাওয়া যায়, পরিবহন করা যায় কয়লা থেকে বিয়ার – সবই৷ এ সুযোগটিই সারা কাজে লাগাচ্ছেন৷
গত কয়েক বছর ধরে গ্রীষ্মের সময়টা বার্জ নিয়ে সারা দেশ চষে বেড়াচ্ছেন সারা৷ ম্যানচেস্টার, লন্ডন, লিভারপুল, বার্মিংহাম – সব বড় শহরেই দর্শন দিয়েছে তাঁর নৌকা৷ তিনি এখন চেষ্টা করছেন সেই শহরগুলোতে যেতে, যেখানে বইয়ের দোকান কম৷
ইলেকট্রনিক রিডার, ট্যাবলেট কম্পিউটার আর নানা ধরনের গেজেটের প্রতাপে মানুষের বই পড়ার অভ্যাস, বই কেনার চল অনেক কমে এসেছে ঠিকই, তবে তাতে বুক বার্জের মতো ছোট উদ্যোগের টিকে থাকার সম্ভাবনা একেবারে শেষ হয়ে যায়নি বলেই সারার বিশ্বাস৷
তিনি বলেন, ‘‘যত দিন যাচ্ছে, বই অবমূল্যায়িত হচ্ছে৷ আমরা সব জায়গায় মূল্য ছাড় দেখে দেখে এত অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে, বই কিনতে এসেও মানুষ আশা করছে, দুটো কিনলে একটা বই ‘ফ্রি' পাওয়া যাবে৷ একটা বইয়ের নিজস্ব মূল্য কতটুকু – তা আর কারো মাথায় থাকছে না৷''
বইয়ের তরী দেশান্তরে
ব্রিটেনের জলপথে পাঁচ বছর ভেসে বেড়ানোর পর এখন বইয়ের বার্জ নিয়ে অন্যান্য দেশে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন সারা৷ সব ঠিক থাকলে আগামী বছরই ‘দি বুক বার্জ' ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে ফ্রান্সে যাবে৷
‘‘আমি বার্গান্ডিতে এক খালের তীরে খানিকটা জায়গা কিনেছি৷ এই বার্জসহ পুরো জায়গাজুড়ে একটা বড় বইয়ের দোকান খোলার ইচ্ছা আছে আমার৷''
সারা আর তাঁর বইয়ের তরী নিয়ে আরো জানা যাবে তাঁর লেখা বই ‘দি বুকশপ দ্যাট ফ্লোটেড অ্যাওয়ে' থেকে৷ আর আপাতত বুক বার্জকে পাওয়া যাবে ইংল্যান্ডের বার্টন মেরিনা এলাকায়৷