সহিংসতা, অতিমারি ও উষ্ণায়নে আরো ক্ষুধার্ত দুনিয়া
১৭ অক্টোবর ২০২১২০১৫ সালে জাতিসংঘ বেঁধে দেয়া সময়সীমা বলে যে, ২০৩০ সালের মধ্যে ঘোচাতে হবে বিশ্বজুড়ে খাদ্যের অভাব৷ কিন্তু প্রথম কয়েক বছরে উন্নতি করার পর, এখন বাস্তবতা ভিন্ন৷ সাম্প্রতিক ‘গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স’ বা বিশ্ব ক্ষুধা সূচক জানাচ্ছে যে ‘‘ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াই বিপজ্জনকভাবে পথভ্রষ্ট'' হয়ে পড়েছে৷
গত দুই বছর ধরে অতিমারির ফলে অর্থনৈতিক টানাটানি, জলবায়ু পরিবর্তন ও দেশে দেশে সশস্ত্র সংঘর্ষের বাড়বাড়ন্তের ফলে আরো বেশি মানুষ ক্ষুধার কবলে পড়ছেন, বলে জানাচ্ছে বেসরকারি সংগঠন ভেল্ট হুঙ্গারহিলফে অ্যান্ড কনসার্ন ওয়ার্ল্ডওয়াইড৷
বৃহস্পতিবারে এই সংস্থার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ পায়, যেখানে দেখা যাচ্ছে গত বছর থেকে পর্যাপ্ত পুষ্টি না পাওয়া মানুষের সংখ্যা বিশ্বজুড়ে বেড়েছে ৩২ কোটি৷ এই সংখ্যা বর্তমানে প্রায় আড়াই বিলিয়ন মানুষের সমান, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের সমান৷ অভুক্ত ও অপুষ্টিতে থাকা মানুষের সংখ্যা আজ গত পাঁচ বছরের সংখ্যার মিলিত যোগফলেরও বেশি৷
বিশ্ব খাদ্য সূচকের অন্যতম লেখক মিরিয়াম উইমার্সের মতে, ‘‘আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যে এই খাতে উন্নয়ন এখন শিথিল হয়ে আসছে বা পিছনের দিকে যাচ্ছে৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘খাবারের গুণগত মান, শিশুদের বিকাশ ও শিশুমৃত্যুর হার দেখায় আসলে অপুষ্টি ঠিক কতটা দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে, বিশেষ করে শিশুদের মানসিক, শারীরিক ও চিন্তার বিকাশের ক্ষেত্রে৷''এই সূচক অনুযায়ী, বিশ্বের ৫০টি দেশের একটা বড় অংশের মানুষের জন্য অপুষ্টি ও খাদ্য সংকট অন্যতম বড় সমস্যা৷
পরিবেশ ও ক্ষুধা
জাতিসংঘের খাদ্য বিষয়ক সংস্থা এফএও ২০২১ সালে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে জানায় যে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে খাদ্য সংকটের বর্তমান চিত্র৷
পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষকদের সংগঠন ইএসএএফএফ-এর মুখপাত্র জো এমজিঙ্গা বলেন, ‘‘সাব-সাহারান আফ্রিকায় অপুষ্টি ও ক্ষুধার পরিমাণ বাড়ছে কারণ সেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে মোকাবিলা করার যথেষ্ট অবকাঠামো নেই৷ সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জীববৈচিত্র্যের হারিয়ে যাওয়ার ফলে নির্দিষ্ট কিছু শস্য উৎপাদনে জোর দেওয়ার দিকটি৷ বিশেষ করে দক্ষিণ ও পূর্ব আফ্রিকায় যেভাবে ভুট্টা ফলানো হচ্ছে, তা এই ধারার প্রতীক৷''
বিশেষ শস্য উৎপাদনে জোর দিলে অনেক সময় অন্যান্য পণ্যের অভাব দেখার যায়, যা নতুন করে খাদ্যের সংকট সৃষ্টি করে৷
উইমার্সের মতে, ‘‘যে সব দেশের কার্বন নিঃসরণ অন্যান্য বড় দেশের তুলনায় কম, দেখা যায় শেষ পর্যন্ত তাদের ওপরেই এসে পড়ে জলবায়ু পরিবর্তানের সবচেয়ে বেশি প্রভাব৷''
অতিমারি যা বদলালো
পণ্যের মুক্ত চলাফেরায় ব্যাপক ব্যাঘাত ঘটায় করোনা অতিমারি৷ এর ফলে, জিনিসের দাম বাড়তে থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে আসে৷ নগর ও গ্রাম দুই অঞ্চলেই দারিদ্র্য চরম হয়, দেখা যায় খাদ্যের সংকট, জানাচ্ছে এফএও৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি সরকারি গবেষণামতে, মাংস, মাছ, ডিমের মতো পণ্যের দাম ২০১৯ সালের তুলনায় বেড়েছে প্রায় ১৬ শতাংশ৷
পাশাপাশি, আফ্রিকা ও এশিয়ার বহু দেশে খাদ্য পণ্য নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সংকট আরো গভীর হয়েছে৷ অতিমারির আগের তুলনায়, ২০২০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলিতে প্রায় ২৬ লাখ শিশু স্বাভাবিক বৃদ্ধি থেকে বঞ্চিত হয়েছে৷
সহিংসতা ও ক্ষুধা
সহিংসতায় জর্জরিত অঞ্চলগুলিতে ফসল নষ্ট হয়, কৃষিকাজে ব্যবহৃত প্রাণীদের চুরি বা মেরে ফেলা হয় ও স্থানীয় জনগণ ঘরছাড়া হয়ে পড়ে৷ এমজিঙ্গা বলেন, ‘‘যুদ্ধের সময়ে আমরা স্বাভাবিক উৎপাদন চালিয়ে যেতে পারিনা৷ বাজারে অংশগ্রহণও স্বাভাবিক থাকে না৷''
বিশ্বের যে ১০টি দেশে ক্ষুধা ও অপুষ্টির সমস্যা সবচেয়ে প্রকট, সেই দশটির মধ্যে আটটি দেশেই এই সংকটের মূল কারণ সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতা, জানাচ্ছে বিশ্ব ক্ষুধা সূচক৷ এর সাথে, যত বেশি উগ্র ও ভয়াবহ হচ্ছে সহিংসতার ধরণ, তত বেশি কঠোর হচ্ছে খাদ্যের অভাব৷
শুধু তাই নয়, অনেক ক্ষেত্রে খাদ্যের অভাব থেকেও জন্ম নিতে পারে সহিংসতার পরিবেশ৷ খাদ্য পণ্যের দখল নিয়ে যত বেশি প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হবে, যত বেশি করে এই দ্বন্দ্বে এসে জুড়বে ধর্ম, ভাষাভিত্তিক সংঘর্ষ, তত বেশি প্রকট হবে খাদ্য সংকট, এমনটাই মত ২০১৭ সালের বিশ্ব খাদ্য প্রোগ্রামের একটি গবেষণার৷
ক্ষুধা সূচকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘‘খাদ্যের নিরাপত্তার অভাবকে না মিটিয়ে দীর্ঘমেয়াদী শান্তি অসম্ভব৷ শান্তি ছাড়া বিশ্বজুড়ে ক্ষুধাকে হার মানানোর সম্ভাবনাও ক্ষীণ৷’’
এ বিষয়ে উইমার্স বলেন, ‘‘খাদ্য মানুষের মৌলিক অধিকার৷ আজ আমরা এমন একটা সময়ে বাস করি যেখানে প্রতি দিন লাখ লাখ মানুষ এই মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হন৷’’
মোনির ঘায়েদি/এসএস