সর্বধর্মের বসন্ত পঞ্চমী নিজামউদ্দিন দরগায়
৩০ জানুয়ারি ২০২০চারপাশে শুধু বাসন্তীর সমারোহ৷ বাসন্তী রঙের চাদর, যা চড়ানো হবে দরগায়৷ তার ওপর উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সূর্যমূখির পাপড়ি৷ মাথায় বাসন্তী রঙের পাগড়ি, গলায় একই রঙের অঙ্গবস্ত্র জড়িয়ে চাদর ধরে আছেন জনা দশেক লোক৷ আশপাশের লোকের পোশাকেও একইরকমভাবে হলুদের ছোঁয়া৷ সঙ্গে গান, 'আজ বসন্ত মানা লে সুহাগন, আজ বসন্ত মানা লে৷' ঢোলকের বোলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাততালি৷ গান যে রাগে বাঁধা, তার নামও বসন্ত৷ এ ভাবেই বসন্ত পঞ্চমীর দিনে আনন্দে উতরোল হল দিল্লির হজযরত নিজামউদ্দিন দরগা৷ সুফি সাধকের দরগায় গান রোজই হয়। তবে তা কাওয়ালি৷ কিন্তু বসন্ত পঞ্চমীর উৎসবে সেখানে কেবলই বসন্তের গান৷
এখান থেকে পনেরো-কুড়ি কিলোমিটার দূরে শাহিনবাগ৷ যেখানে সিএএ নিয়ে একমাসের বেশি সময় ধরে বিক্ষোভ দেখানো হচ্ছে৷ শুধু শাহিনবাগই নয়, দিল্লির মোট তেরোটি জায়গায় চলছে এই ধরনের বিক্ষোভ৷ আর সেই প্রতিবাদকে সাম্প্রদায়িক রঙ দিয়ে শুরু হয়েছে বিভাজনের রাজনীতিও৷ এই আবহে একেবারেই ব্যতিক্রমী হযরত নিজামউদ্দিন দরগার বসন্ত উৎসব৷ এখানে একটাই রঙ৷ বাসন্তী৷ উৎসবের রঙ, সম্প্রীতির রঙ, শান্তির রঙ, সৌহার্দ্যের রঙ৷
বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ শুরু হল উৎসব৷ মূল প্রবেশদ্বারে পৌঁছলেন গাইয়েরা৷ সঙ্গে ঢোল৷ বিশাল চাদর হাতে তৈরি বাকিরা৷ হাতে সর্ষে ফুল নিয়ে সাজ্জাদা নাশিন শোনাতে শুরু করলেন কাহিনি৷ দরগায় বসন্ত উৎসব শুরুর কাহিনি৷ সৈয়দ আফসর আলি নিজামি ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন সেই ইতিহাস৷ ''সাতশো বছর আগে হজরত নিজামউদ্দিনের ভাগ্নের অকালপ্রয়াণের পর সুফি সন্ত বিষন্ন হয়ে যান৷ মুখ থেকে হাসি চলে যায়৷ তাঁর এই অবস্থা দেখে প্রবল চিন্তিত হন সুফি কবি আমির খসরু৷ তিনি একদিন দরগা থেকে বেরিয়ে একটু দূরে গিয়ে দেখতে পান, কিছু লোক বাসন্তী পোশাক পরে বাসন্তী রঙা ফুল নিয়ে গান গাইছেন। তাঁদের কাছে খসরু জানতে চান, এ কীসের উৎসব? লোকেরা জানান, বসন্ত উৎসব। বসন্ত পঞ্চমীর দিন এভাবেই তাঁরা উৎসব পালন করেন৷ আর এ হল আনন্দের উৎসব৷ খসরু জানতে চান, এভাবে গেলে হজরত নিজামুদ্দিনের মুখে হাসি ফিরবে? তাঁরা বলেন, ফিরবে৷ খসরু তখন বাসন্তী রঙের পোশাক পরে, সর্ষে, সূর্যমুখি ফুল হাতে নিয়ে, বসন্তের গান গাইতে গাইতে ঢুকলেন দরগায়৷ দেখেই হযরত নিজামউদ্দিনের মুখে হাসি ফুটল৷ তারপর থেকে সাতশো বছর ধরে এভাবেই আনন্দের উৎসব পালন করা হচ্ছে দরগায়৷''
চাদর নিয়ে নিয়ে যাওয়া হল হযরত নিজামউদ্দিনের মাজারে৷ সঙ্গে গাইয়ের দল। ঢোলও৷ সৈয়দ গুলাম নিজাম বলছিলেন, ''এই একদিনই ঢোল ঢোকে মাজারের ভিতরে৷ এমনিতে রোজ সন্ধ্যায় কাওয়ালি হয়৷ তবে আজ শুধু বসন্তের গান৷ খসরুর নিজের লেখা, কিছু সংগ্রহ করে সামান্য বদল করে নেওয়া৷'' হজরত নিজামুদ্দিনের মাজার থেকে বেরিয়ে গাইয়েরা বসলেন সামনের চাতালে৷ চারপাশে ভিড় করে অজস্র মানুষ৷ হিন্দু-মুসলিম সকলেই আছেন৷ শুরু হল গান৷ 'আজ বসন্ত মানা লে৷' বারবার উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে হলুদ ফুলের পাপড়ি৷ মাঝে মধ্যে গানের দলের ওপর টাকা বৃষ্টিও হচ্ছে৷ বসন্ত রাগের আবেশে, ঢোলের ছন্দে বাহিত হয়ে আনন্দের পরশ লাগছে লোকের মনে৷
গান শেষ হল, গাইয়েরা চললেন খসরুর মাজারে৷ তারপর অন্য মাজারেও৷ খসরুর মাজারের পাশের চাতালে আবার বসলেন তাঁরা৷ শুরু হল আরেক দফা গান৷ তারপর নামাজের বিরতি৷ মসজিদে গিয়ে প্রার্থনার সময়৷ তার আগেই মাজারের সামনে দুয়া হয়ে গিয়েছে, শান্তি ও সম্প্রীতি কামনা করে৷ নামাজ শেষ হতেই আবার শুরু হল বসন্তের গান৷ ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে৷ আঁধার নেমেছে৷ কিন্তু উৎসবের রঙ ফিকে হয়নি৷ গান শুরু হতেই বর্ষিত হতে থাকল ফুলের পাপড়ি৷ ছড়িয়ে গেল বসন্তের আমেজ ও আনন্দের লহরী৷