ভাস্কর নভেরার নিভৃত বিদায়
৭ মে ২০১৫নভেরা আহমেদের গবেষক এবং তাঁর গুণমুগ্ধ শিল্পী হাশেম খান ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘অভিমানে ষাটের দশকে তিনি দেশ ছেড়ে যান৷ আর কখনো আসেননি৷ তাঁর অবস্থানও আমাদের জানা ছিল না৷ ১৯৯৭ সালের আগে প্যারিস প্রবাসী শিল্পী শাহাবুদ্দিনের স্ত্রী লেখিকা আনা ইসলাম তাঁকে সেখানে খুঁজে বের করেন৷''
তিনি জানান, ‘‘নভেরা আহমেদ সুস্থ হয়ে বাংলাদেশে আবার আসতে চেয়েছিলেন৷ কিন্তু তা আর সম্ভব হলো না৷''
নভেরা জন্মগ্রহণ করেছিলেন তাঁর পৈতৃক নিবাস চট্টগ্রামের আসকার দীঘির উত্তর পাড়ায় ১৯৩৯ সালের ২৯শে মার্চ৷ বাবা সৈয়দ আহমেদ৷ কলকাতার লরেটো স্কুল থেকে প্রবেশিকা পাস করে তিনি চলে যান লন্ডনে৷ সেখানে ক্যাম্বারওয়েল স্কুল অফ আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটসে পড়াশুনা শেষে ইটালির ফ্লোরেন্স ও ভেনিস শহরে ভাস্কর্য বিষয়ে শিক্ষা নেন৷
১৯৫৬ সালে তিনি দেশে ফিরে ভাস্কর হামিদুর রহমানের সঙ্গে ঢাকায় শহীদ মিনারের প্রাথমিক নকশা প্রণয়নের কাজে নিয়োজিত হন৷ পরে অজ্ঞাত কারণে শহীদ মিনারের নির্মাতা হিসেবে তাঁর নামটি সরকারি কাগজ থেকে বাদ পড়ে যায়৷
ঢাকায় ১৯৬০ সালের ৭ই আগস্ট, কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থগারের প্রাঙ্গনে (এখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে) ‘ইনার গেজ' শিরোনামে তাঁর প্রথম একক ভাস্কর্য প্রদর্শনী হয়৷ তাতে ৭৫টি ভাস্কর্য স্থান পেয়েছিল৷ পরে সেখান থেকে ৩০টি ভাস্কর্য জাতীয় জাদুঘর সংরক্ষণ করে৷ সেই ভাস্কর্যগুলো নিয়ে ১৯৯৮ সালে জাদুঘর একটি প্রদর্শনীরও আয়োজন করে৷ নভেরার কয়েকটি ভাস্কর্য এখনও জাতীয় জাদুঘর প্রঙ্গনে আছে৷
এরপর ব্যাংকক ও প্যারিসে তাঁর ভাস্কর্য প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়৷ সর্বশেষ প্রদর্শনীও হয়েছে প্যারিসে ২০১৪ সালে৷ সেখানেই গত ৪৫ বছর ধরে তিনি নিভৃতে বসবাস করছিলেন৷ নভেরা আহমেদ ১৯৯৭ সালে একুশে পদক পান৷
শিল্পী হাশেম খান জানান, ‘‘তাঁর ভস্কর্য প্রদর্শনী যখন ঢাকায় হয়, তখন আমি চারুকলার প্রথম বর্ষের ছাত্র৷ তিনি ছিলেন সময়ের চেয়ে এগিয়ে৷ তাই সেই সময়ে তাঁর এই ভাস্কর্য প্রদর্শনী তেমন সমাদর পায়নি, যা তাঁকে অভিমানিনী করে৷ আসলে সেই সময়ে ভাস্কর্য প্রদর্শনী ছিল অকল্পনীয় ব্যাপার৷ কারণ তখন ছবি আঁকাকেই সমালোচনার চোখে দেখা হতো৷''
তিনি বলেন, ‘‘শহীদ মিনারের নকশাকার হামিদুর রহমান ছিলেন নভেরার বন্ধু৷ শহীদ মিনারের মূল পরিকল্পনায় ৬টি ভাস্কর্য ছিল, যার নকশা নভেরাই করেছিলেন৷ পরে নভেরা চলে যান৷ তাই ভাস্কর্য আর হয়নি৷''
হাসেম খান বলেন, ‘‘অধ্যাপক মুনতাসির মামুন এবং আমি ১৯৯৪ সালে নভেরাকে নিয়ে কাজ শুরু করি৷ দৈনিক সংবাদে মুনতাসির মামুন তাঁকে নিয়ে একটি লেখা প্রকাশ করলে বাংলাদেশে আবার নভেরার ব্যাপারে আগ্রহ তৈরি হয়৷ তাঁর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভাস্কর্য সংগ্রহ করে জাদুঘরে রাখা হয়, এখনও যা সেখানেই পড়ে আছে৷''
হাশেম খান জাদুঘরের ট্রাস্টি বোর্ডেরও সদস্য৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা উদ্যোগ নিয়েছি জাদুঘরে একটা নভেরা কর্নার করার৷''
তাঁকে একুশে পদক দেয়া সম্পর্কে হাসেম খানের বক্তব্য: ‘‘আমরা তাঁকে নিয়ে লেখালেখির পর তা শেখ হাসিনার নজরে পড়ে৷ তিনি আগ্রহ নিয়ে বিষয়টি জানেন৷ এরপর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগ্রহে তাঁকে একুশে পদক দেয়া হয়৷ অভিমান ভেঙে শেষ পর্যন্ত প্যারিসে থাকাকালীনই নভেরা সেই একুশে পদক গ্রহণ করেন৷''
নভেরা আহমেদের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, নভেরার মৃত্যু পুরো জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি৷ তাঁর মৃত্যুতে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরও শোক প্রকাশ করেন৷