1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সাম্প্রদায়িকতা বা অসাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ 

অজয় রায়
২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭

কমিউনালিজম শব্দের বাংলা আমরা সাধারণত করে থাকি ‘সাম্প্রদায়িকতা'৷ তবে আমি সাম্প্রদায়িকতা বলতে যা বুঝি তা একাধিক সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্বেষ, হিংসা এবং একই বস্তু বা লক্ষ্যে উপনীত হওয়ার জন্য পারস্পরিক প্রতিযোগিতা থেকে উদ্ভুত৷

https://p.dw.com/p/2kZie
ছবি: bdnews24.com

বিভিন্ন সম্প্রদায় পরস্পর মিলে নিজেদের স্বার্থ অর্জন, সংবরণ ও শ্রীবৃদ্ধির জন্য নিজ সম্প্রদায়ের সদস্যদের নিয়ে সংগঠনও তৈরি করতে পারে৷ যেমন, ব্রিটিশ ভারতে হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যরা গঠন করেছিলেন 'হিন্দুমহাসভা' আর মুসলমানরা 'মুসলিম লীগ'৷ এ ধরনের সংগঠনের মূল লক্ষ্যই হলো, নিজ সম্প্রদায়ের স্বার্থ দেখা ও উন্নয়ন সাধন৷ নিজ সম্প্রদায়ের বাইরে দরিদ্র ও ‘নিডি' কেউ থাকলেও এই সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলোর কোনো দায় নেই বা ফিরেও তাকাতো না৷ এই দৃষ্টিভঙ্গিকেই আমরা বলতে পারি 'সাম্প্রদায়িকতা'৷

নিজ কমিউনিটির, ধমের্র, শ্রেণির মানুষের কল্যাণ ও স্বার্থ অর্জনের এই অ্যাটিচুডকেই বলা যেতে পারে নিখুঁত সাম্প্রদায়িকতা বা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, পারস্পরিক সাম্প্রদায়িক রেষ ও হিংসা৷ দু’টি কমিউনিটির মধ্যে এই রেষ, বিদ্বেষ, প্রতিহিংসা অতীব উচ্চমাত্রায় উপনীত হলে দু’টি সম্প্রদায়ের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষ বেধে যেতে পারে, যার পরিণতি প্রাণহানি, আঘাত ও আহত৷ বিদ্বেষ প্রসুত এ ধরনের দু’টি সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক হানাহানিকে ইংরেজিতে বলা হয় 'রায়ট' (১৯৪৬ সালে ক্যালকাটা গ্রেট কিলিং বা দাঙ্গা ছিল দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে দাঙ্গার জ্বলন্ত উদাহরণ)৷ এরা কলকাতার রাজপথে পরস্পরকে হত্যা করেছে হাজারে হাজারে; এরই 'ফল আউট' দেখা দিল বিহার প্রদেশে, এবং বাংলার শ্যামল মাটি নোয়খালী সিক্ত হলো উভয় সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষের রক্তে৷ কলকতায় দাঙ্গা থামাতে গুজরাটের সরস্বতী নদীতীরে পার্শ্ববর্তী  আশ্রম থেকে ছুটে এলেন মহাত্মা গান্ধী, ঘুরলেন কলকাতার পথে পথে, বিভিন্ন এলাকায়, বাংলার তখনকার মুসলিম লীগ প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দিকে সাথে নিয়ে৷ কলকাতার উভয় সম্প্রদায়ের এই নৃশংস হানাহানি আমি ছেলেবেলায় দেখেছি৷ আমরা তখন বালীগঞ্জে থাকতাম৷ বালীগঞ্জ প্রাথমিক স্কুলের ছাত্র৷ বাবা তখন আলীপুরে ল-ইয়ার মেজিস্ট্রেট৷ 

দাঙ্গা নিয়ন্ত্রিত হলো, মহাত্মা ছুটে গেলেন বিহারে৷ রইলেন দিনের পর দিন, সাথে বিহারের জেসওয়ালাসহ বুদ্ধিজীবী মহল৷ প্রশমিত হলো নৃশংসতা৷ গান্ধী ছুটে এলেন বাংলায়, নোয়াখালীতে রইলেন দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, চারণের মতো ঘুরলেন গ্রামের পথে পথে, হিন্দু-মুসলমান, নরনারী সবাইকে নিয়ে শান্তির বাণী প্রচারে নামলেন৷ প্রতিষ্ঠা করলেন শান্তি ও প্রীতির প্রতীক গান্ধী-আশ্রম৷ 
উইকিপিডিয়ার সংজ্ঞায় সাম্প্রদায়িকতা হলো এক ধরনের পদ্ধতি বা সিসটেম, যার মাধ্যমে বা যা ব্যবহার করে অতিমাত্রায় স্বতন্ত্র ও স্বাধীন স্থানীয় সম্প্রদায়রা সম্পদ ও সম্পত্তি নিজেদের আয়ত্বে নিয়ে আসে৷ অনেকেই সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পত্তি কুক্ষিগত করার প্রবণতাটিকে 'সাম্প্রদায়িক' আখ্যা দিয়ে থকে৷ যেমন একজন প্রখ্যাত উদারপন্থি সমাজবাদী মুরে বুকচিনের সংজ্ঞায় কমিউনালিজম হলো এক ধরনের সরকার পদ্ধতি, যার ব্যবহার করে স্বাধীন কমিউনরা বা সম্প্রদায়েরা ফেডারেশনে অংশ গ্রহণ করতে পারে এবং মালিকানার নীতি গ্রহণ ও চর্চা করতে পারে৷ তাহলে মোদ্দা কথা হলো, সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষা করা, সম্পদ অর্জন ও বৃদ্ধি = এই দৃষ্টিভঙ্গিকেই আমরা বলতে পারি সাম্প্রদায়িক৷ ঐতিহাসিকভাবে বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে কমিউন-ফেডারেশন থেকে সম্প্রদায়গুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং নিজ নিজ সম্প্রদায় স্বার্থ সচেতন হয়ে নতুন সম্প্রদায় চেতনার উদ্ভব ঘটতে থাকে৷

তখন থেকেই আধুনিক সম্প্রদায়ের বিকাশ৷ নিজ সম্প্রদায়ের চিন্তাচেতনা, সম্পত্তি অর্জন, স্বার্থ রক্ষাই স্বতন্ত্র সম্প্রদায় গঠন করে৷ আর এ থেকেই সাম্প্রদায়িক চেতনা বা সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব৷ এর সাথে রাজনীতিও সম্পৃক্ত হয় রাজনৈতিক সংগঠন উদ্ভবের সাথে সাথে৷

এর মাঝামাঝি সত্ত্বেও যখন কমিউন ফেডারেশন ভেঙে পড়ছিল, তখন বিশৃঙ্খলা, সমাজবাদ বা সাম্যবাদের উদ্ভবও লক্ষ্যণীয়৷ এদেরকেই বলা যেতে পারে ভাববাদী সাম্যবাদ বা অরাজক সাম্যবাদ৷ বুকানন এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ ৷ যা-ই হোক, মার্কসবাদের প্রভাবে এক সময় লেনিনের নেতৃত্বে রুশ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয় অক্টোবর বিপন্ন পরবর্তীকালে৷ ব্যক্তিগত বা সম্প্রদায়গত সম্পত্তি মালিকানা ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে যায়৷ ফলে সাম্প্রদায়িকতার দৃষ্টিও বদলে যেতে খাকে৷ 

আমার মনে হয় সম্প্রদায়ভিত্তিক একত্রে জীবন নির্বাহের যে ব্যবস্থা ছিল, যা আমাদের দেশের আদি সমাজেও বিদ্যমান ছিল বা এখনও আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে এর রেশ দেখা যায় (যেমন সাঁওতাল, ওঁড়াও, গাড়ো বা পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন নৃজাতিরূপের মধ্যে বিদ্যমান) তা সমাজ পরিবর্তনের অনিবার্য কারণে ভেঙে পড়ার ফলে এবং বিংশ শতাব্দীতে রাজনৈতিক আন্দোলনের সূত্রপাতের কারণে 'সাম্প্রদায়িকতা' শব্দটির ব্যবহার শুরু হয় সম্প্রদায়গত স্বার্থ অর্জনের লক্ষ্যে, একবারেই সম্প্রদায়গত উন্নয়নের উদ্দেশ্যে৷ এই দৃাষ্টভঙ্গিকেই আমরা যথার্থভাবে সাম্প্রদায়িক নামে চিহ্নিত বা অভিহিত করতে পারি৷ এই দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত অনুদার, সংকীর্ণ এবং ভেদ-বুদ্ধি জাত৷ এর সংকীর্ণ অর্থ হলো, আমার প্রতিবেশী অন্য সম্প্রদায়ের বা ধর্মের মানুষদের প্রতি আমার কোনো দায় তো নেইই, বরং এক ধরনের বিরাগ, উষ্মা এমনকি ঘৃণাও থাকতে পারে৷ এর ফলে আমাদের নিজেদের অবিবেচনা, অবিমৃষ্যকারিতা, নির্বুদ্ধিতার কারণে এবং শাসকদের উসকানিতে আমরা একটি সম্প্রদায়ের মানুষ অন্য একটি সম্প্রদায়ের মানুষকে বিনা কারণে, আর একটি মানুষকে কেবল অন্য সম্প্রদায়ের সদস্য হওয়ার কারণেই ঘৃণা, হিংসা এমনকি আমার উন্নয়নের কন্টক বিবেচিত হলে তাকে হত্যাও করতে পারি৷ 

ইতিহাসের পথ ধরে আমরা এগোলে দেখতে পাব যে, অনেক সম্প্রদায় যারা ভাববাদী সমাজবাদ বা অরাজক সমাজতন্ত্রকে গ্রহণ করেছিলেন, তারা ফেডারেশন ভিত্তিক সম্প্রদায়ভুক্ত সম্পদের মালিক হওয়ার জন্য নিয়ম-কানুন প্রবর্তন করেছিলেন৷ মনে রাখতে হবে, ব্যক্তিগত মালিকানার পরিবর্তে সম্প্রদায়গতভাবে মালিকানাই ছিল কমিউনিয়নের নীতি বা নিয়ম৷ মার্কসই সাধারণভাবে আধুনিক সাম্যবাদ ধারণার প্রতিষ্ঠাতা, তিনি আদিম সাম্যবাদী ব্যবস্থাকে যেমন প্রত্যাখ্যান করেছেন, তেমনি ভাববাদী সমাজতন্ত্রকেও উপেক্ষা করেছেন৷ কারণ, এসব তত্ত্বীয় সমাজবাদ বাস্তবায়নযোগ্য নয়৷ 

আমাদের আবার এক পর্যায়ে চার্চের বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে সংঘর্ষে নামতে হয়েছিল৷ চার্চ বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ আমাদের সমাজজীবনকে চাইতো নিয়ন্ত্রণ করতে তাদের ডকট্রিন্স দিয়ে, আমাদের স্যেকুলার জীবন তাদের কাছে অসহ্য মনে হতো, নিয়ন্ত্রণ করতে চাইতো জীবনের সর্বক্ষেত্রকে৷ ফলে সেক্যুলারিজম (ধর্মহীনতা) বা মেটেরিয়ালিজমের সাথে চার্চের দ্বন্দ্ব বা সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে দাড়াল৷ বিজ্ঞান পাশে এসে দাঁড়াল সেক্যুলারিজমের পরে৷ 

এ প্রসঙ্গে আপনার কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷