‘সব নাই’-এর কনটেইনার ডিপো, জীবনের দামে মুনাফা
১০ জুন ২০২২কনটেইনার ডিপোটির মালিক আওয়ামী লীগ নেতা মুজিবুর রহমান৷ এই ডিপোটির পরিবেশ ছাড়পত্র, ফায়ার লাইসেন্স, বন্ড লাইসেন্স, ট্রেড লাইসেন্স, কলকারখানার সনদ, বিস্ফোরক অধিদপ্তরের অনুমতি পত্র সব খানেই ত্রুটি৷ শনিবার রাতে আগুন ও বিস্ফোরণে ৪৫ জন নিহত হওয়ার পর প্রতিটি দপ্তর এবং অধিদপ্তর স্বপ্রণোদিত হয়েই এসব তথ্য দেয়৷ আগুনের জন্য যে হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের কথা বলা হচ্ছে তাও উৎপাদন করে তাদের স্মার্ট শিল্প গ্রুপের আরেকটি প্রতিষ্ঠান আল রাজি কেমিকেল কমপ্লেক্স লি. ৷ এর অবস্থান চট্টগ্রামের পাহাড়তলি এলাকার পাশে সংরক্ষিত পর্যটন এলাকায়৷ চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের জমি দখল করে এটা করা হয়েছে বলে অভিযোগ৷ ওই এলাকার মানুষও এখন আতঙ্কে আছেন৷
অনুমোদন পেতে যা লাগে
প্রাইভেট কনটেইনার ডিপোর অনুমোদন দেয় নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয় ৷ তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এর একটি বড় ভূমিকা আছে৷ স্থানীয় শুল্ক কর্তৃপক্ষ চূড়ান্ত অপারেশনাল অনুমোদন দেয়৷ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে এটা স্থাপনের যে নীতিমালা তাতে ১৩ ধরনের অনুমতি ও ডকুমেন্টের কথা বলা হয়েছে৷ তারমধ্যে রয়েছে ফায়ার ও অগ্নি নিরাপত্তা ছাড়পত্র, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র, অগ্নি ও দুর্যোগ বীমা সনদ, বন্ড লাইসেন্স, হালনাগাদ ট্রেড লাইসেন্স, হালনাগাদ মূসক ও আয়কর সনদ, কর্মচারীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা, সব ধরনের নিরাপত্তা যন্ত্রপাতি ইত্যাদি৷
ঘটনার পর যা প্রকাশ পায়
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে জানাগেছে কনটেইনার ডিপোটির বন্ড লাইসেন্স, ট্রেড লাইসেন্স, মূসক ও আয়কর সনদ কিছুই হালনাগাদ করা নেই৷ রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস বিভাগের দ্বিতীয় সচিব (শুল্ক, রপ্তানি ও বন্ড) মো. মশিয়ার রহমান মন্ডল ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমরা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি৷ তারা এই বিষয়গুলো খতিয়ে দেখছে৷ প্রতিবেদন পাওয়ার পর বলা যাবে তাদের ওইসব কাগজপত্র ঠিক আছে কী না৷’’ আর চট্টগ্রাম শুল্ক কর্তৃপক্ষও বিষয়টি দেখছে৷ চট্টগ্রাম কাস্টমস-এর কমিশনার ফখরুল আলম জানান, ‘‘তারা হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রপ্তানি করে৷ আগেও করেছে৷ কিন্তু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আছে কীনা তা তদন্ত করে দেখছি৷’’
আগুন ও বিস্ফোরণের পর সীতাকুণ্ডের কন্টেইনার এলাকা পরিদর্শন করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা৷ বিস্ফোরক অধিদপ্তরের পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন জানিয়েছেন, ‘‘ডিপোটির রাসায়নিক বা দাহ্য পদার্থ রাখার অনুমতি নেই৷’’ সেখানে দাহ্য পদার্থ সংরক্ষণ বা মজুদের নিয়ম না মানার ফলেই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে তার ধারণা৷ আর পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রামের আঞ্চলিক পরিচালক মুফিদুল আলম বলেন, ‘‘বিএম কনটেইনার ডিপো আমাদের কাছ থেকে শুধু কনটেইনার রাখার বিষয়ে ছাড়পত্র নিয়েছিল৷ তারা বলেছিল সেখানে কনটেইনার ভর্তি ও খালি করবে৷ ফুড, পোল্ট্রি ফিড ও গার্মেন্টস আইটেম মিলিয়ে বেশ কিছু পণ্যের অনুমতি ছিল৷ কোনো কেমিকেল রাখার অনুমতি নেয়নি৷ ফায়ার সার্ভিস ও উদ্ধারকারী সেনা ব্রিগেডের কাছ থেকে আমরা ডিপোতে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড নামক রাসায়নিক রাখার তথ্য পেয়েছি৷ মঙ্গলবার সকালে আমরা বিভিন্ন নমুনাও সংগ্রহ করেছি৷’’
কলকারখানা অধিদপ্তরও অবকাঠামো ও শ্রমিক নিরপাত্তায় অনিয়ম পেয়েছে৷ তারাও তদন্ত করে দেখছে৷
আগুন লাগার পরদিন রোববার ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) শাহজাহান শিকদার ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আগুন লাগার পর কনটেইনার ডিপোর মালিকপক্ষকে আমরা পাইনি৷ তাদের কেউ আমাদের জানায়নি যে সেখানে কেমিকেল আছে৷ ফলে আমাদের ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা মারা যান৷’’
তিনি বলেন, ‘‘কনটেইনার ডিপো করতে হলে ফায়ার লাইসেন্স দরকার হয়৷ এটা ছাড়া ডিপো করা যায় না৷ আর কোনো দাহ্য পদার্থ বা কেমিকেল থাকলেও তা জানিয়ে রাখতে হবে ফায়ার সার্ভিসকে৷ আমরা সেখানে অনেক কেমিকেলের উপস্থিতি পেয়েছি৷ বিভিন্ন ধরনের কেমিকেলের অনেক ড্রাম রয়েছে ৷ আমাদের তারা কেমিকেলের তথ্য জানায়নি৷’’
এখন তদন্ত যেভাবে চলছে
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে৷ এই কমিটিতে সংশ্লিষ্ট সব বিভাগের সদস্যরা রয়েছে৷ এই কমিটির প্রধান হলেন স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক ড. বদিউল আলম৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে জানান, কমিটিতে, ফায়ার, পরিবেশ, বিস্ফোরক, কলকারখানা, কাস্টমসসহ সংশ্লিষ্ট সব বিভাগের প্রতিনিধি আছেন৷ দায় দায়িত্ব নির্ধারণই এই কমিটির কাজ কমিটিকে সাত কর্মদিবস সময় দেয়া হয়েছে৷ তিনি বলেন, ‘‘এই দায়দায়িত্ব নির্ধারণ করতে গিয়ে যেসব অভিযোগ এরইমধ্যে এসেছে তা আমরা তদন্ত করে দেখবো৷ তাদের অনুমোদন থাকা না থাকার সব দিক তদন্ত করে দেখার দায়িত্ব আমাদের৷ তবে তদন্তের এই পর্যায়ে কোনো তথ্য আমরা প্রকাশ করছি না৷ কারণ নিশ্চিত না হয়ে প্রকাশ করলে তা অনুমান নির্ভর হবে৷ আমরা এরইমধ্যে কিছু নমুনা সংগ্রহ করেছি৷ এরমধ্যে কেমিকেলও আছে৷ সেই নমুনা পরীক্ষার পর বিশেষজ্ঞ মতামতও নেয়া হবে৷’’
ফায়ার সার্ভিসের সাবেক উপ-পরিচালক সেলিম নেওয়াজ ভূঁইয়া বুধবার বলেন, ‘‘আমার অভিজ্ঞতা বলছে ওই ডিপোতে দাহ্য পদার্থ বা কেমিকেল ছিল৷ হাইড্রোজেন পার অক্সাইডে এরকম হওয়ার কথা নয়৷ আর যা জানতে পেরেছি তাতে ওই ডিপোতে সেইফটি সিকিউরিটি বলতে কিছু ছিল না৷ ফায়ার সার্ভিস যদি জানতে পারত যে ওখানে দাহ্য পদার্থ আছে তাহলে তাদের নয় জন কর্মী মারা যেত না৷ এটার গভীর তদন্ত হওয়া প্রয়োজন৷’’
তবে নৌ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী দাবি করেছেন, ‘‘বিভিন্ন দপ্তর থেকে বিভিন্ন অভিযোগ করা হলেও তা এখনো প্রমাণিত নয়৷ তদন্তে প্রমাণ হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘তারা বন্ডেড ওয়্যার হাউজের লাইসেন্স পেয়েছে৷ কিছুদিন আগে আইএসপিস কোডের (ইন্টারন্যাশনাল শিপ এন্ড পোর্ট ফ্যাসিলিটি সিকিউরিটি কোড) অডিট হয়েছে৷ তাদের যদি কোনো ত্রুটি থাকত তাহলে তো ধরা পড়ত৷ আমরা প্রশ্ন তাহলে অডিটে তারা পাস করল কীভাবে?’’
এই অডিটের দায়িত্ব শিপিং বিভাগের৷ ওই বিভাগটি নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে৷
আইএসপিএস কোডের ক্লিয়ারেন্স পেতে প্রতিষ্ঠানটি কোনো রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করেছে কীনা জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘‘না, কোনো রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করেনি৷’’
মামলায় মালিকপক্ষের কারো নাম নেই
কনটেইনার ডিপোটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুজিবুর রহমান চট্টগ্রাম দক্ষিণ আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ৷ তিনি গত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন৷
আগুন ও বিস্ফোরণের পর থেকে তিনি পলাতক থাকলেও ঘটনার পাঁচদিন পর বুধবার যে মামলা হয়েছে তাতে আটজনকে আসামি করা হলেও আওয়ামী লীগ নেতা মুজিবুর রহমান বা মালিকপক্ষের কাউকে আসামি করা হয়নি৷ পুলিশ দাবি করেছে এখন পর্যন্ত আগুন ও বিস্ফোরণের ঘটনায় মালিক পক্ষের কারুর সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি৷ মামলার তদন্তে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে চার্জশিটে আসামি করা হবে৷
এদিকে বিএম কনটেইনার ডিপোর পক্ষে মহাব্যবস্থাপক মেজর (অব.) শামসুল হায়দার সিদ্দিকী দাবি করেন, তাদের সব ধরনের কাগজপত্র ঠিক আছে৷ বৈধতা নিয়ে কোনো সমস্যা নাই৷ তিনি সব ধরনের বৈধ কাগজপত্র হোয়াটসঅ্যাপে এই প্রতিবেদককে পাঠানোর কথা বললেও শেষ পর্যন্ত আর পাঠাননি৷