1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

শিশু-কিশোর গ্রেপ্তার, হয়রানি থামছেই না

সমীর কুমার দে ঢাকা
২ আগস্ট ২০২৪

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যে গ্রেপ্তার অভিযান চালাচ্ছে তাতে শিশু-কিশোরদের গ্রেপ্তার, হয়রানি এখনো চলছে বলে অভিযোগ৷ অথচ সরকারের একাধিক মন্ত্রী শিশু-কিশোর বা শিক্ষার্থীদের হয়রানি না করার কথা বলেছেন৷

https://p.dw.com/p/4j2lt
ডিএমপির প্রিজন ভ্যানে কয়েকজন বন্দি তাকিয়ে আছেন
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে হত্যামামলায় গণহারে শিশু-কিশোরদের গ্রেপ্তারের অভিযোগ উঠছেছবি: ABU SUFIAN JEWEL/AFP

হত্যা মামলায়ও কিশোরদের গ্রেপ্তার দেখানো হচ্ছে৷ কেবল টঙ্গীর শিশু উন্নয়ন (বালক) কেন্দ্রে গত ১৬ দিনে ১৩৭ জন শিশু-কিশোর এসেছে৷ ২০০ বন্দির ধারণক্ষমতাসম্পন্ন এই কেন্দ্রে এখন আছে ৬১০ জন শিশু-কিশোর৷

কোটা সংস্কার আন্দোলনে প্রাণ গেছে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের৷ পুলিশের গুলিতে তার মৃত্যুর বিষয়টি বিভিন্ন টেলিভিশনের ফুটেজে দেখেছেন সারা দেশের মানুষ৷ অথচ এই হত্যা মামলায় রংপুর পুলিশ লাইনস স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির (বিজ্ঞান বিভাগ) ছাত্রকে আসামি হিসেবে আদালতে হাজির করে পুলিশ৷ জন্মসনদ অনুযায়ী তার বয়স ১৬ বছর ১০ মাস৷ তবে পুলিশ মামলায় তার বয়স উল্লেখ করে ১৯ বছর৷ বৃহস্পতিবার রংপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক মোস্তফা কামাল ওই কিশোরকে জামিন দিলেও এখনো তার মাথার উপর ঝুলছে মামলার খড়গ৷

ওই কিশোরের আইনজীবী আবদুল মোকছেদ বাহালুল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘৪ আগস্ট এই কিশোরের জামিন আবেদনের শুনানি হওয়ার কথা ছিল৷ কিন্তু বৃহস্পতিবার সকালে তার আগাম জামিন শুনানির জন্য আদালতে আবেদন দেওয়া হয়৷ আদালত তা মঞ্জুর করেন৷ উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত কিশোরের জামিন মঞ্জুর করেন৷ আমরা ওই কিশোরের জন্মসনদসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আদালতের কাছে উপস্থাপন করেছি৷ রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন রংপুর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর শারমিন আফরোজ৷ ডয়চে ভেলের পক্ষ থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘‘কাজটা ঠিক হয়নি৷’’

জামিনে মুক্ত কিশোরের বাবা রংপুরের পার্কের মোড়ে স্টুডিও ব্যবসা করতেন৷ এখন তিনি কিছুই করেন না৷ দুই ভাই-বোনের মধ্যে ওই কিশোর ছোট৷ তার বড় বোন সানজানা আক্তার স্নেহা মাহিগঞ্জ কলেজে অনার্সের (ইংরেজি) তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘আমার ভাইয়ের পরীক্ষা চলছিল৷ ১৫ তারিখ পরীক্ষা দিয়ে এসে সে শ্বাসকষ্টে পড়লে ওইদিন বিকেলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়৷ ১৭ তারিখে আমরা তাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে আনি৷ আর আবু সাঈদ নিহত হন ১৬ জুলাই৷ পরীক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে ১৮ জুলাই বাড়ি থেকে বের হয়৷ পরীক্ষা যে স্থগিত হয়েছে সেটা সে জানতো না৷ আর আমাদের বাড়িটা এমন জায়গায় যে, আমাদের অটো ধরতে হলে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল গেটে যেতে হয়৷ আমার ভাই ওখানে গিয়েছিল অটোতে উঠে কলেজে যেতে৷ সেখানে একটা মিছিল আসে, আর ওটার মধ্যে পড়ে যায়৷ পরদিন দুপুরে ওকে যখন আদালত থেকে কারাগারে পাঠানো হয়, তখন আমরা ওর গ্রেপ্তারের বিষয়টি জানতে পারি৷ এর আগে আমরা হাসপাতালে খুঁজেও ভাইকে কোথাও পাইনি৷ কেবল ১৮ তারিখ রাত ১০টার দিকে একটা ফোন এসেছিল৷ আমার বাবা ধরেছিলেন৷ শুধু বলেছে, আপনার ছেলে আমাদের হেফাজতে আছে, চিন্তা করবেন না৷ কিন্তু ওই নম্বরটি কার, কোথা থেকে ফোন এসেছে আমরা বারবার কল করেও বুঝতে পারিনি৷’’

আবু সাঈদ নিহত হওয়ার ঘটনার একাধিক ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ওই দিন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন' কর্মসূচি চলাকালে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের সড়কে পুলিশ আবু সাঈদকে খুব কাছ থেকে গুলি করে৷ আর আবু সাঈদ এক হাতে লাঠি নিয়ে দুই হাত প্রসারিত করে বুক পেতে দেন৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি লুটিয়ে পড়েন৷ সাঈদের মরদেহের ময়নাতদন্ত করেন রংপুর মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক রাজিবুল ইসলাম৷ তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘আবু সাঈদের বুক ও পেট ছররা গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল, এই কারণে তার মৃত্যু হয়েছে৷’’

এদিকে রাজধানীর মিরপুর থানায় নাশকতার মামলায় ১৬ বছর ১০ মাস বয়সি এক কলেজশিক্ষার্থীকে হাতকড়া পরিয়ে আদালতে নেয় পুলিশ৷ গত মঙ্গলবার বিকালে তাকে হাতকড়া পরিয়ে ঢাকার চিফ মেট্টোপলিটন ম্যাজিষ্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে নেয় পুলিশ৷ পরে ওই কিশোরের আইনজীবী আদালতে জন্মসনদ জমা দেন৷ তাকে শিশু হিসেবে গণ্য করে মামলাটি শিশু আদালতে পাঠিয়ে দেওয়ার আবেদন করেন৷ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৮ তাকে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানোর নির্দেশ দেন৷

ন্যায়বিচারের দাবিতে ঢাকায় শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

জানা গেছে, উচ্চমাধ্যমিক পড়ুয়া ছেলেটির জন্মসনদ অনুযায়ী বয়স ১৬ বছর ১০ মাস৷ তবে মিরপুর থানা-পুলিশ তার বয়স ১৮ বছর উল্লেখ করে এক মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে নিয়েছে৷ ওই কলেজ ছাত্রের স্বজনরা জানান, তার গ্রামের বাড়ি ঢাকার নবাবগঞ্জে, মিরপুরের একটি হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করে৷ সোমবার দুপুরে তার এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে মিরপুর-১০ গোল চত্বরে যায়৷ তখন পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায়৷ সে বারবারই বলেছিল, গত বছর সে মাধ্যমিক পাস করেছে৷ তার বয়স ১৮ বছর হয়নি৷ শিশুটিকে যখন আদালত কক্ষে আসামির কাঠগড়ায় রাখা হয়, তখনও তার হাতে হাতকড়া ছিল৷ শিশুটি বারবারই বলছিল, সে হাঁপানি রোগে আক্রান্ত৷

শুধু এই দুই কিশোরের মতো অনেকশিশু ও কিশোরকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের পর গ্রেপ্তার করে আদালতে তোলা হয়েছে৷ কাউকে সহিংসতার মামলায়, কাউকে হত্যা মামলার আসামি করেছে পুলিশ৷ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রীসহ কয়েকজন মন্ত্রী বারবার বলেছেন, কোনো শিক্ষার্থীকে হয়রানি করা হবে না৷ অথচ শিশু-কিশোরদের বিরুদ্ধে একটার পর একটা মামলা দেওয়া হচ্ছে৷

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গ্রেপ্তার হয়ে ১৬ দিনে ১৩৭ শিশু-কিশোর টঙ্গী শিশু উন্নয়ন (বালক) কেন্দ্রে এসেছে৷ ২০০ বন্দির ধারণক্ষমতা সম্পন্ন এই কেন্দ্রে এখন আছে ৬১০ জন শিশু-কিশোর৷

সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালনায় টঙ্গী শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, গত ১৫ জুলাই থেকে ১ আগস্ট পর্যন্ত ১৩৭ জন শিশু-কিশোর বন্দি এখানে এসেছে৷ ১৪ জুলাই বন্দির সংখ্যা ছিল ৪৭৩ জন৷ বর্তমানে সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৬১০৷ দেশের বিভিন্ন আদালতের আদেশে বিভিন্ন মামলায় এরা বন্দি৷ শিশু-কিশোর অপরাধীদের অন্যতম বন্দিশালা টঙ্গী শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র (বালক)৷ ধারণক্ষমতার চেয়ে তিন গুণ বেশি বন্দি এখানে থাকলেও নেই চিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত ডাক্তার, বা নার্স৷ একটি পাঁচতলা ও একটি দোতলা ভবনে থাকে শিশু-কিশোর বন্দিরা৷

সমাজসেবা অধিদপ্তর গাজীপুরের উপ-পরিচালক আনোয়ারুল করিম বলেন, ‘‘এখানে শিশু বন্দিদের আসা-যাওয়া নিয়মিত ঘটনা৷ আদালতের নির্দেশেই শিশুরা এসে থাকে৷ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৬১০ জন শিশু-কিশোর বন্দি এখানে আছে৷’’

বন্দি শিশুদের মানসিক বিকাশে ও সংশোধনের জন্য কী ব্যবস্থা আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা আছে এই কেন্দ্রে৷ শিশু-কিশোরদের নানা ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়৷ মানসিক বিকাশে রয়েছে খেলাধুলার ব্যবস্থা৷ প্রতিদিন দুপুর আড়াইটা থেকে ৩০ মিনিট করে প্রতি ফ্লোরের বন্দিদের পালাক্রমে মাঠে খেলতে দেওয়া হয়৷ এছাড়া ফ্লোরের ভেতরে দাবা, কেরাম ও লুডু খেলার ব্যবস্থা আছে৷ এর বাইরে সেলাই, কম্পিউটার, ইলেকট্রনিক্সের কাজ, অটোমোবাইলসহ নানা ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও আছে৷’’

বাংলাদেশ মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট এলিনা খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এভাবে শিশু-কিশোরদের গ্রেপ্তার জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের সরাসরি বরখেলাপ৷ আবার এটা আমাদের সংবিধানবিরোধীও৷ কেবল মিছিলে যাওয়ার কারণে যাকে গ্রেপ্তার করা হলো, তাকে রাখা হচ্ছে খুন করে আসা একজন কিশোরের সঙ্গে, সেটা তো হতে পারে না৷ সরকার চাইলেই যেসব শিশু ও কিশোরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের পরিবারের কাছে দিতে পারতো৷ তা না করে এখানে আদালতে হাজির করে তাদের শিশুমনকে ক্ষতবিক্ষত করা হচ্ছে৷ আমি এই ধরনের ঘটনায় গণহারে শিশু-কিশোরদের গ্রেপ্তারের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই৷’’

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান