শান্তি পুরস্কার পেলেন ডাভিড গ্রসমান
২৩ জুন ২০১০প্রতি বছর ফ্রাংকফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলার সমাপ্তি পর্বে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনের কোন ব্যক্তিত্বকে দেয়া হয় ২৫ হাজার অর্থ মূল্যের এই পুরস্কারটি৷
ডাভিড গ্রসমান তাঁর উপন্যাস, প্রবন্ধ ও নানা রচনার মাধ্যমে ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সদ্ভাব গড়ে তুলতে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন৷ এ ছাড়া ভিন্ন চিন্তাধারাকেও বোঝার চেষ্টা করেছেন তিনি৷ আর এই জন্যই তাঁকে এই সম্মাননা দেয়া৷ বলা হয়েছে পুস্তক সমিতির পক্ষ থেকে৷
মধ্যপ্রাচ্যে অনবরত যে সহিংসতা ঘটছে, তা শুধু পরস্পরের সঙ্গে কথা বলা ও পরস্পরের কথা শোনার মাধ্যমেই দূর করা সম্ভব৷ তাঁর লেখনীর মাধ্যমে এ কথাই বার বার বলতে চেয়েছেন গ্রসমান৷ ইসরায়েলের খ্যাতনামা লেখক ও সাংবাদিকদের অন্যতম ডাভিড গ্রসমান৷ বহু উপন্যাস প্রবন্ধ ও শিশু সাহিত্যের রচয়িতা তিনি৷ ৩০টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর গ্রন্থ৷ অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি৷ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হ্যারি হ্যারসন প্রাইজ, গেশুইস্টার শোল প্রাইজ ইত্যাদি৷
লেখালিখি ছাড়া থাকতে পারেননা গ্রসমান৷ বাসে, ট্রেনে বা প্লেনে যখনই যেখানে সময় ও সুযোগ পান লিখতে থাকেন তিনি৷ লেখার টেবিল ছেড়ে যাওয়াটাই তাঁর পক্ষে মুস্কিল৷ গ্রসমান বলেন, ‘‘একটি উপন্যাস লেখা মানে এক বিরাট অভিজ্ঞতা, যার জন্য ৩/৪ বছর সময় লেগে যায়৷ উপন্যাসের মাধ্যমে যে কোনো জায়গায় পৌঁছে যাওয়া সম্ভব হয় আমার পক্ষে৷ লেখার সময় আমার মনে হয় আর কেউ এটি পড়বেনা, কারো হাতেই আসবেনা বইটি৷ এটি আমার একান্তই ব্যক্তিগত নিজস্ব জিনিস৷''
গ্রসমানের জন্ম ১৯৫৪ সালে জেরুসালেমে৷ পড়াশোনা করেছেন দর্শন ও থিয়েটার নিয়ে৷ ক্যারিয়ার শুরু করেন ইসরায়েল বেতারে৷ সেখানে তিনি ছোটদের জন্য জনপ্রিয় এক অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছেন ১৪ বছর৷ দুই সন্তানের জনক গ্রসমান বড়দের মত খুদে দর্শক, শ্রোতাকেও টানতে পেরেছেন সমানভাবে৷ ছোট পাঠকের সংখ্যাও তাঁর কম নয়৷ গ্রসমানের লেখার মূল বিষয় হল মধ্যপ্রাচ্য সংকট উত্তরণের শান্তিপূর্ণ পথ খোঁজা৷ এমনকি ২০০৮ সালে উগ্রপনন্থি হামাস বাহিনী ইসরায়েলি শহরের ওপর রকেট হামলা চালানোর পরও ইসরায়েলি জনগণের প্রতি সংযমের আহ্বান জানিয়েছেন গ্রসমান৷ জার্মানির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের টানা পোড়েনের কথাও বলেছেন গ্রসমান৷ জানিয়েছেন, জার্মানির কাছে যাওয়াটা তাঁর পক্ষে কতটা কঠিন ছিল৷ ‘‘আমি বহু বছরই জার্মানিতে যেতে চাইনি৷ হলোকস্ট বা ইহুদি নিধনের বর্বরোচিত ঘটনা আমাকে এতটাই পীড়া দিত যে, জার্মানিতে যাওয়া, জার্মান ভাষা শোনা আমার পক্ষে সহজ ছিলনা৷ লেখালিখি শুরু করার পর থেকেই আমি ভেবেছি, জার্মানিতে আমি তখনই যাব, যখন সেখানে আমার নাম আমার লেখা বইতে শোভা পাবে৷ কেননা জার্মানিতে এমন অসংখ্য মানুষকে খুন করা হয়েছে, যাদের নামটিও পর্যন্ত কেউ জানতে পারেনি৷ এটাই আমার কাছে সবচেয়ে অসহ্য মনে হয়৷ তাই জার্মান ভাষায় অনুদিত আমার প্রথম বই Das Lachen des Lammes - জনৈক মেষের হাসি প্রকাশ হওয়ার পরই জার্মানিতে যাওয়া সম্ভব হয় আমার৷''
২০০৩ সালে গ্রসমান এমন একটি বই লিখতে শুরু করেন, যার বিষয়বস্তু সঙ্গে গ্রসমানের নিজের জীবনের ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে মিলে যায়৷ একটি উপন্যাসে তিনি ইসরায়েলের বহু মা বাবার উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তার কথা তুলে ধরেছেন৷ গ্রসমানের নিজেরও সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়া দুই ছেলের জন্য আশংকা কম ছিলনা৷ ২০০৬ সালে উপন্যাসটি শেষ হওয়ার আগেই ছোট ছেলে উরি লেবানন যুদ্ধে নিহত হয়৷ গভীর বেদনায় কাতর হয়ে তেলআভিভে হাজার হাজার মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে গ্রসমান বলেন: ‘‘এই যুদ্ধে মানুষের মনে এই অনুভূতিই জাগিয়েছে যে আমাদের দেশে কোনো রাজা নেই৷ আমাদের নেতাদের কোন শক্তিই নেই৷ আমাদের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতারা যেন শূন্যগর্ভ৷'' কিন্তু গ্রসমানের মনে প্রতিশোধ স্পৃহা জাগেনি তখন৷ অবিশ্বাস, ঘৃণা ও ক্রোধকে প্রশ্রয় দিতে চাননা তিনি৷ গ্রসমানের মতে, ক্রোধকে বাড়তে দিলে ছেলে উরির কাছ থেকেও দূরত্ব বেড়ে যাবে তাঁর৷
প্রতিবদন: রায়হানা বেগম
সম্পাদক: আব্দুল্লাহ আল ফারূক