শাড়ি নিয়ে কলকাতায় তীব্র বিতর্ক
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮‘‘যদি কেউ আমাকে বলেন যে, আপনারা জানেন না কীভাবে শাড়ি পরতে হয়, তা হলে বলব, আপনাদের লজ্জা হওয়া উচিত৷ এটা সংস্কৃতির অংশ৷ প্রত্যেকেরই উচিত নিজেদের সংস্কৃতির পাশে দাঁড়ানো৷''
সম্প্রতি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্ডিয়া কনভেনশনে বক্তৃতা করার সময় ছাত্র-ছাত্রীদের এক প্রশ্নের উত্তরে এ কথা বলেন বিশ্বখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়৷ উল্লেখ্য, দীর্ঘদিন ধরে শাড়ি নিয়ে কাজ করছেন তিনি৷ তাঁর তৈরি পোশাক পরার জন্য মুখিয়ে থাকেন মুম্বইয়ের বিখ্যাত অভিনেত্রীরা৷ রানি মুখোপাধ্যায় থেকে ঐশ্বরিয়া রাই সকলেই তাঁর পোশাক নিয়ে মুগ্ধ৷ পৃথিবীর সমস্ত বড় বড় ফ্যাশন শো'তে সব্যসাচী মুখোপাধ্যায় একটি নাম৷ তাঁর বাচনভঙ্গি, বক্তব্য, ভাবনা নিয়েও সকলেরই উচ্চ ধারণা ছিল৷ কিন্তু হার্ভার্ডে সব্যসাচী এ কথা বলার পর প্রতিবাদের ঝড় ওঠে৷
সোশ্যাল নেটওয়ার্কে বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তাঁর এই বক্তব্যের নিন্দা হয়৷ বলা হয়, সব্যসাচীর বক্তব্য নারীবিদ্বেষী৷ অপমানজনক৷ যে মহিলারা শাড়ি পরেন না, বা পরতে পারেন না, কেন তাঁদের লজ্জা পেতে হবে, সে প্রশ্নও ওঠে৷ কেউ কেউ আরো গভীরে গিয়ে প্রশ্ন করেন, ভারতের সমস্ত রাজ্যে শাড়ি সত্যিই ঐতিহ্য তো? সব্যসাচী জানেন কি যে, দেশের সর্বত্র ঐতিহ্যবাহী পোশাক যে শাড়ি নয়!
দীর্ঘ প্রতিবাদের পর সোশ্যাল নেটওয়ার্ককেই উত্তর দেওয়ার মঞ্চ হিসেবে বেছে নেন সব্যসাচী৷ ইনস্টাগ্রামে পর পর তিনটি চিঠি পোস্ট করেন তিনি৷ সেখানে তিনি বলেন, ‘লজ্জা' শব্দটি ব্যবহার করার জন্য তিনি ক্ষমাপ্রার্থী৷ ক্ষমা চাওয়ার সুযোগটুকু অন্তত দেওয়া হোক তাঁকে৷ শুধু তাই নয়, কোন পরিস্থিতিতে, কোন প্রশ্নের প্রেক্ষিতে, কেন তিনি এ কথা বলেছেন, তার উত্তরও দেন সব্যসাচী৷
তাঁর দ্বিতীয় পোস্টে সব্যসাচী লিখেছেন, ১৬ বছর ধরে তিনি শাড়ি নিয়ে কাজ করছেন৷ অনেক সময়েই শাড়ি নিয়ে বর্তমান প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের কাছে নানা বিরূপ মন্তব্য শুনেছেন৷ মেয়েদের গর্ব করে বলতে শুনেছেন যে, তারা শাড়ি পরতে পারেন না৷ এগুলি কোনোদিনই মেনে নিতে পারেননি তিনি৷তারই প্রেক্ষিতে কথাগুলি বলেছিলেন হার্ভার্ডে৷
তাঁর তৃতীয় পোস্টে সব্যসাচী লিখেছেন, তাঁর সঙ্গে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের অনেকেই মহিলা৷ সব্যসাচী তাঁদের সর্বোচ্চ বেতন দেন বলেও জানান৷ দেন, কারণ, সেই বেতন পাওয়ার যোগ্য তাঁরা৷ অর্থাৎ, ব্যক্তিগত স্তর থেকে সংস্থা পর্যন্ত কোথাও মহিলাবিদ্বেষী কোনো কাজ তিনি করেন না৷ শুধু তাই নয়, জানিয়েছেন, প্রত্যেক শুক্রবার তাঁর সংস্থার কর্মীরা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরেন৷
সব্যসাচী ক্ষমা চাইলেও বিতর্ক এখনই থামছে না৷ সব্যসাচীর বক্তব্য ধরে ফিরে এসেছে পুরনো বিতর্ক৷ ভারতীয় ঐতিহ্য বলতে যা বোঝানোর চেষ্টা করে কোনো কোনো ধর্মীয়সংগঠন কিংবা উগ্র রাজনৈতিক দল, সব্যসাচীর মনোভাবের মধ্যেও কি একই আভাস দেখা যাচ্ছে না? কেউ কেউ বলছেন, আসলে মূলস্রোতের ভারতীয়রা ঐতিহ্যের কথা বলার সময় ভারতের বৈচিত্রের কথাটিই মনে রাখেন না৷ তাই ঠিক যে অজ্ঞতা থেকে তাঁরা উত্তর-পূর্বের মানুষদের ভারতীয় বলে মনে করেন না, ‘চিংকি' বলে গালিগালাজ করেন, ঠিক একইভাবে তাঁদের সংস্কৃতিকেও গুরুত্ব দেন না৷ লক্ষণীয়, গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতে কিংবা কাশ্মীরে, কিংবা আদিবাসী জঙ্গলে শাড়ি পরার প্রচলন নেই৷
মণিপুরের ঐতিহ্যবাহী পোশাকের নাম ইন্নাফি এবং ফানেক৷ মিজোরামের মহিলারা পরেন পুয়ান৷ নাগাল্যান্ডে মহিলাদের পোশাকের নাম আজু জাংনুপ পু৷ কাশ্মীরের পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে পরেন ফিরান এবং পুট৷ এসবের কোনোটির সঙ্গেই শাড়ির সামান্যতম সংযোগ নেই৷ এভাবে তালিকা বানালে দেখা যাবে, ভারতের বহু অঞ্চলেই শাড়ি ঐতিহ্য নয়৷ সব্যসাচীর মতো বিশিষ্ট মানুষও যদি সেই বৈচিত্র মাথায় না রাখেন, তাহলে সাধারণ মানুষের আর কী দোষ?
আপনি কি সব্যসাচীর সঙ্গে একমত?