1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

শলৎসের চীন সফরে বাড়ছে বিতর্ক

৫ নভেম্বর ২০২২

জার্মান চ্যান্সেলরের চীন সফর নিয়ে চলছে ব্যাপক বিতর্ক৷ ওলাফ শলৎস নিজে সফরকে সফল বলে মনে করলেও কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই সফর জার্মান সরকারের কৌশল বিঘ্নিত করেছে এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঐক্যও বিপন্ন হয়েছে৷

https://p.dw.com/p/4J6yl
ব্যবসায়িক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনার প্রসঙ্গ ছাড়াও শলৎস সাংবাদিকদের বলেন তিনি চীনা নেতাদের কাছে সে দেশের মানবাধিকারের বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন
ব্যবসায়িক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনার প্রসঙ্গ ছাড়াও শলৎস সাংবাদিকদের বলেন তিনি চীনা নেতাদের কাছে সে দেশের মানবাধিকারের বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেনছবি: Kay Nietfeld/dpa/picture alliance

জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎসের সফর নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে একাধিক সংশয় সত্ত্বেও শুক্রবার চীন সফরে যান তিনি।মহামারির পর থেকে জি-৭ গোষ্ঠীর প্রথম কোনো নেতা চীনে গেলেন। শলৎস বলেন, তিনি ইউক্রেন যুদ্ধ, মানবাধিকার এবং পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার সহ বিস্তৃত বিষয়ে চীনা রাষ্ট্রপতি শি জিনপিংয়ের সঙ্গে "অকপটে কথা" বলেছেন। .

চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াংয়ের সঙ্গে বৈঠকের পর একটি সংবাদ সম্মেলনে শলৎস বলেন, দুই নেতা সম্মত হয়েছেন, পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দেওয়া "দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং বিপজ্জনক"। চীনা নেতৃত্ব এ বিষয়ে সম্মত হলেও রাশিয়ার নাম উল্লেখ করেনি। যদিও এর আগে ইউক্রেনে আগ্রাসনের সময় পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ইঙ্গিত দিয়েছে রাশিয়া।

শলৎসের কথায়, "উত্তেজনার সময়েও" দুই নেতা সব বিষয়ে আলোচনা করেছেন। সংকটের সময় চীন ও জার্মানি-এই দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা বাড়াতে যে আহ্বান জানিয়েছিলেন জিনপিং, শলৎসের বক্তব্যে সেই একই সুর।

বেইজিং সফরের একদিন পর সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের এক বৈঠকে চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিংয়ের সঙ্গে তার চুক্তিকে স্বাগত জানান শলৎস। তিনি বলেন, "চীনে সফর করা ঠিক নাকি ঠিক নয়, এই বিতর্ক সত্ত্বেও এটা সত্য যে চীনের সরকার, রাষ্ট্রপতি এবং আমি একসুরে বলতে পারছি- এই যুদ্ধে কোনো পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা উচিত নয়। শুধুমাত্র এটুকুর জন্যই সফরটি গুরুত্বপূর্ণ।"

কূটনৈতিক আলাপ সত্ত্বেও শলৎসের ১১ ঘণ্টার সফর নিয়ে বিতর্ক চলছেই। জার্মানির বর্তমান জোট সরকার চীনের উপর নির্ভরতা কমিয়ে দেশটির প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল-তবে এই জন্য বিতর্ক হচ্ছে তা কিন্তু নয়। বরং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জার্মানি চীন নিয়ে তার নীতির কোনো পরিবর্তন করেনি, শলৎসের সফরই তার প্রমাণ।

জার্মান অর্থনৈতিক স্বার্থ অগ্রাধিকার

বেশ কয়েকটি প্রভাবশালী জার্মান ব্যবসায়িক সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাদের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বেইজিংয়ে এসে চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন শলৎস।

সফরের আগে জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক চীনের উপর জার্মানির অতিরিক্ত নির্ভরতা নিয়ে সতর্কতা করেছিলেন। শলৎস বলেন, কীভাবে অন্যান্য খাতে অর্থনৈতিক সহযোগিতা আরো বাড়ানো যায়, তা নিয়ে কথা বলতে চান তিনি। যেমন-জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্য নিরাপত্তা, ঋণগ্রস্ত দেশ ইত্যাদি।

তাইওয়ানের ন্যাশনাল ডং হাওয়া ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক এবং ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা সুৎসা আনা ফেরেনজি বলেছেন, "এই সফরে বার্তা মিলল, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত হলেও বার্লিন যথারীতি ব্যবসা করছে।"

তিনি বলেন, " আমি মনে করি নিজেদের শক্তির অবস্থান বুঝে চীনের সঙ্গে গঠনমূলকভাবে কথা বলার উপায় খুঁজে বের করতে হবে ইউরোপকে।ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে আমরা দেখেছি ইউরোপীয় ঐক্যের উত্থান ঘটেছে, যদিও তা ভঙ্গুর। তবু তার বিনিময়ে বার্লিন তার নিজস্ব স্বার্থ অনুসরণ করে সেই অবস্থানকে ক্ষুণ্ণ করছে।"

জার্মান রাজনীতিবিদ এবং ইউরোপীয় পার্লামেন্টে গ্রিন পার্টির সদস্য রাইনহার্ড ব্যুটিকোফার ডয়চে ভেলেকে বলেন, জার্মান জোট সরকারের চুক্তির বিরোধিতা করেছে শলৎসের চীন সফর । ইউরোপীয় ইউনিয়নেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এটি৷ তার কথায়, "শলৎস বার্তা দিতে চেয়েছেন, বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ চালু রাখা তার কাছে রাজনৈতিক অগ্রাধিকার।"

তিনি বলেন, "জার্মানির চীনা নীতি একজন চ্যান্সেলরের ভিত্তিতে তৈরি করা যায় না। তিনি অন্তত তিনবার চীনের বিষয়ে উপযুক্ত পরামর্শ উপেক্ষা করেছেন। নতুন জার্মান সরকার ক্ষমতায় আসার সময় আমরা একমত হই যে চীন নিয়ে জার্মানির ভবিষ্যতের নীতি ইউরোপীয় স্তরের নিয়ম মেনে হবে। কিন্তু তা হয়নি।"

সফরের আগে শলৎস একটি বিতর্কিত চুক্তিকে বজায় রেখেছেন। এর ফলে চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিপিং কোম্পানি কস্টকোকে হামবুর্গের একটি বন্দর টার্মিনালের ২৪.৯% শেয়ার কেনার অনুমতি দেয়া হয়েছে। বেয়ারবক সহ মন্ত্রিসভার বেশ কয়েকজন সদস্যদের আপত্তি শোনেননি তিনি। যদিও কস্টকোর ৩৫% শেয়ার নেওয়ার কথা ছিল কিন্তু তা কমানো হয়।

চীনে মানবাধিকার

ব্যবসায়িক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনার প্রসঙ্গ ছাড়াও শলৎস সাংবাদিকদের বলেন তিনি চীনা নেতাদের কাছে সে দেশের মানবাধিকারের বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে উইগুর সংখ্যালঘু এবং জিনজিয়াংয়ের অন্যান্য তুর্কি সংখ্যালঘু নিয়ে বেইজিংয়ের মনোভাবের দিকটিও। বেইজিংকে মানবাধিকার বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন শলৎস। তার কথায়, এটি অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ নয়।

শলৎস জানান, চীনে থাকা বিদেশিদের বায়ো-এন-টেকের টিকা নিতে সম্মতি দেয়া হয়েছে। এর আগে চীনের ভিতরে টিকা ব্যবহারের অনুমোদন দেয়নি বেইজিং। তীার কথায়, জলবায়ু পরিবর্তন এবং রোগ প্রতিরোধের মতো ক্ষেত্রে দুই দেশ তাদের সহযোগিতা জোরদার করবে।

সংবেদনশীল বিষয়গুলি তুলে ধরার জন্য শলৎসের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা ফেরেনজি মনে করেন, " শলৎস মিডিয়াকে বলে শুধুমাত্র বাক্সে টিক চিহ্ন দিচ্ছেন যে তিনি চীনা নেতৃত্বের সঙ্গে মানবাধিকার নিয়ে কথা বলেছেন। "

ডিডাব্লিউকে ফেরেনজি বলেন, "চীন সফরের ঘোষণার সময় কঠিন রাজনৈতিক ইস্যুগুলি নিয়ে আরো জরুরি ভূমিকা মাথায় রেখে এটি অন্যভাবে পরিচালনা করা যেত। মানবাধিকারের প্রশ্ন আসলে এজেন্ডার অংশই ছিল না।"

তার বক্তব্য, "শলৎস যে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন, চীনে মানবাধিকার মোকাবেলায় এটি আসলে কার্যকর নয়।চীনের অভ্যন্তরে অত্যন্ত সংবেদনশীল ইস্যু এটি। জার্মানরা প্রায়ই মানবাধিকার ইস্যুতে শান্ত কূটনীতি পছন্দ করে।"

তার মতে, "যে ইউরোপীয় সদস্য রাষ্ট্র চীনের মাধ্যমে উদ্দেশ্যসাধন করতে পারত, তা না করে বরং সেই সুযোগ সদ্ব্যবহার না করাটা মারাত্মক ব্যর্থতা।"

ইইউতে অনৈক্য

ইউরোপীয় পার্লামেন্টে জার্মান সদস্য ব্যুটিকোফার মনে করেন, সফরটি ইউরোপীয় ইউনিয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সম্ভবত মধ্য ও পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলিও প্রতিবাদ করবে৷ ব্রাসেলসও কড়া মন্তব্য করতে পারে। বাল্টিক দেশগুলি গত মাসে জোর দিয়ে বলেছিল, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিটি দেশকে এক সুরে চীনের সঙ্গে কথা বলতে হবে। শলৎসের সফরে তা মানা হয়েছে কি, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

চেক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ইউরোপিয়ান ভ্যালুস সেন্টারের তাইওয়ান অফিসের প্রধান মার্সিন জেরজেউস্কি বলেছেন, "এই সফরটি কেবল ইইউর মধ্যেই নয়, জার্মান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও বিভাজনের একটি ইঙ্গিত। চীনের সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করা যায় তা নিয়ে উদারপন্থি, গ্রিন পার্টি এবং সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে স্পষ্টতই ভিন্নমত রয়েছে।"

জর্জ সি. মার্শাল ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর সিকিউরিটি স্টাডিজের চীনের গবেষক এবং সহযোগী অধ্যাপক, সারি আরহো হাভরেন ডিডাব্লিউকে বলে, শলৎসের এই সফর বেইজিংকে একটি শক্তিশালী সংকেত দিল।

তার কথায়, "বেইজিং দেখল যে, জার্মান চ্যান্সেলর ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাকি নেতাদের চীনের সঙ্গে সম্পর্কস্থাপনের ক্ষেত্রে আরো বাস্তবসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেছেন। তার নেতৃত্ব অনুসরণে উৎসাহ দিতে উদাহরণ স্থাপন করছেন।এর অর্থ হলো, এবার বেইজিংয়ের আচরণকে স্বাভাবিক হিসেবে দেখা হবে, যেটিকে মূলত সমস্যা হিসাবে দেখে ইইউ।"

সারি আরহো হাভরেন উল্লেখ করেছেন যে দুই নেতা কীভাবে বিশ্বকে দেখেন তার একটি উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে।

ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, "ইউক্রেনের যুদ্ধের মারাত্মক প্রভাবগুলির জোর দিয়েছিলেন শলৎস। কিন্তু জিনপিংয়ের জন্য, এটা আরো বেশি কিছু। যুক্তরাষ্ট্র চীনকে ঠেকানোর চেষ্টা করছে, এমন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সারা বিশ্বকে দেখে বেইজিং।''

এই দৃষ্টিভঙ্গিতে তাইওয়ানের একত্রীকরণের জন্য রাশিয়ার সঙ্গে চীনের অংশীদারত্বও গুরুত্বপূর্ণ৷ ইউরোপের দেশগুলো এই ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ নয়।

সারি আরহো হাভরেনের মতে, "বিভিন্ন শক্তিশালী কোম্পানির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে চীনের সঙ্গে জার্মানির সম্পর্কও গভীর হচ্ছে। এর ফলে বেইজিং এবং ওয়াশিংটনের মধ্যে একটি পক্ষ বেছে নিতে হলে জার্মানির পদক্ষেপ একক ইউরোপীয় সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে৷।"

উইলিয়াম ইয়াং/আরকেসি