অসহায় শিকার শিক্ষার্থী
১৪ ডিসেম্বর ২০১৮রাজধানীতে নামজাদা স্কুলের তালিকায় ভিকারুননিসা নূন, আইডিয়েল, মডেল, সাউথপয়েন্ট ও ক্যাম্ব্রিয়ান অন্যতম৷ এ ধরনের প্রায় সব স্কুলেরই তিনটি বা ততোধিক শাখা রয়েছে৷ এসব শাখায় ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে অভিবাবকরা শিক্ষার্থীদের ঠেলে দিচ্ছেন এক ধরনের যুদ্ধের দিকে৷ সম্প্রতি ভিকারুননিসা শিক্ষার্থী অরিত্রীর আত্মহত্যার ঘটনায় ফের স্কুল ও অভিভাবকদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ৷ ভালো ও নাম করা স্কুল বলে যেসব স্কুলের পেছনে ছুটছেন অভিবাবকরা, সেগুলো কেমন চলছে?
গত ৫ মাসে ৩ আত্মহত্যা
২০১৮ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন স্কুল শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে৷ প্রাথমিকভাবে জানা যায়, স্কুল থেকে টিসি দেওয়ার হুমকি ও পরীক্ষায় কম নম্বর পাওয়াই এসব আত্মহত্যার কারণ৷
২৪ জুলাই, মঙ্গলবার রাতে স্কুলছাত্রী সুমাইয়া আক্তার মালিহা (১৪) ঢাকার শাহজাহানপুরের নিজ বাসায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে৷ সে শহীদ ফারুক ইকবাল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী ছিল৷ তার একটি সুইসাইড নোট উদ্ধার করেছে পুলিশ৷ তাতে লেখা আছে, ‘‘আমার সুইসাইড করার কারণ একমাত্র রিমি ম্যাডাম৷ সে অযথা পরীক্ষায় আমার খাতা নিয়েছে৷ আর পরীক্ষায় কম নম্বর দিয়েছে৷ তোমরা যদি পারো তাহলে সেই ম্যাডামকে মানসিক চিকিৎসা দাও, মেন্টাল হসপিটালে পাঠাও৷ ম্যাডাম আমারে অভিশাপ দিয়েছে, তাই আমার ভালো রেজাল্ট খারাপ হয়েছে৷''
একই দিনে উত্তরা রাজউক মডেল কলেজের ১০ম শ্রেণির ছাত্রী নাফিসা নেওয়াজ ইথিকা ভবনের ৪র্থ তলা থেকে পড়ে নিহত হন৷ স্কুল কর্তৃপক্ষের দাবি, নাফিসা পা ফসকে পড়েছে৷ কিন্তু ঐ কলেজের শিক্ষার্থীরা দাবি করছেন, ইথিকা আত্মহত্যা করেছে৷ পরীক্ষার নম্বর নিয়ে সে মানসিক চাপে ছিল৷ গণিত পরীক্ষার খাতায় পাওয়া ৩৯ নম্বরকে ৬৯ করে ধরা পড়ায় তাকে টিসির হুমকি দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন তার শিক্ষক৷ এক পর্যায়ে আত্মহত্যা করে ইথিকা৷
ভিকারুননিসা স্কুলের অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যার দগদগে ঘা-ও এখনো শুকায়নি। কিন্তু কেন এমনটা ঘটছে? কেন এত বাড়তি চাপ?
‘আমরা সিস্টেমের কাছে জিম্মি'
এ প্রসঙ্গে সাংবাদিক প্রভাষ আমিন বলেন, ‘‘চাপটা সিস্টেমের অংশ৷'' তাঁর সন্তান প্রসূন সেন্ট যোশেফ স্কুলের এসএসসি পরীক্ষার্থী৷ সামগ্রিক চাপ থেকে বের করতে পারেননি নিজের সন্তানকে৷ স্কুল নির্বাচনের ক্ষেত্রে তিনি মাঠটাকে প্রধান গুরুত্ব দিয়েছিলেন৷ সঙ্গে সেন্ট যোসেফের সুনাম তো আরেকটি কারণে রয়েছেই৷ চলমান জিপিএ ফাইভের চাপে তিনিও আর সবার মতো জিম্মি৷ তবে নম্বর কম পেলে নানা তিরষ্কারের ঘটনা থাকলেও গুরুতর দুর্ঘটনার নজির পাননি তিনি৷ পড়ালেখার পাশাপাশি অনেক ডিবেট ক্লাব, ল্যাংগুয়েজ ক্লাব বা সায়েন্স ক্লাবের মতো আন্ত প্রতিষ্ঠানে সংযুক্ত থাকার সুযোগ রয়েছে, যেটিকে এই চাপের মাঝেও মানসিক বিকাশের একটি পথ বলে মনে করেন তিনি৷
অন্যদিকে সাউথ পয়েন্ট স্কুলের অভিবাবক লীনা পারভীন ভীষণ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করলেন স্কুল নিয়ে৷ তিনি বলেন, ‘‘স্কুলের সামগ্রিক পরিবেশ নিয়ে অভিবাবক হিসেবে আমি মোটেই সন্তুষ্ট নই, কারণ, ক্লাসে বাচ্চাদের প্রতি মনযোগ দেওয়া হয় না সমানভাবে৷ কোচিং-বাণিজ্য আছে৷ ইংলিশ ভার্সনের স্কুল নাই বললেই চলে৷ তাই ভরসা হিসাবে এখানে ভর্তি করা হয়েছিল৷''
আরো একটি কারণ হিসেবে তিনি এটি যে ভিকারুন্নেছা স্কুলের সাবেক অধক্ষ্য হামিদা আলী প্রতিষ্ঠিত স্কুল সেই বিষয়টিও উল্লেখ করলেন৷
তিনি আরো জানান, আর সব বাচ্চার মতোই ভর্তি যুদ্ধে লড়াই করে উত্তীর্ণ হয়েই এই স্কুলে আসতে হয়েছিল তাঁর সন্তানদের৷ কিন্তু স্কুলে শিক্ষকরা মোটেই শিক্ষার্থীদের প্রতি যত্নশীল নন৷ পরীক্ষার খাতায় নম্বর কম দেওয়া হয়, কিন্তু কেন কম দেয়া হয় সে বিষয়ে কোনো উত্তর পাওয়া যায় না৷
তিনি আরো বলেন, ‘‘একজন অভিভাবক হিসেবে আমার চাওয়া স্কুল এমন একটি জায়্গা হবে, যেখানে কেবল পরীক্ষা আর পাস-ফেলের হিসাবই বড় হবে না৷ এখানে আমার সন্তান শিখবে একজন মানবিক গুণাবলীসম্পন্ন মানুষ হবার সব শিক্ষা৷ মুখস্থবিদ্যা না, মগজের শিক্ষা দেবে৷ সিলেবাস নির্দিষ্ট করা থাকবে, যাতে বাসায় গাইড করার জন্য অভিভাবকদের হয়রান না হতে হয়৷ স্কুল দায়িত্ব নেবে ভালো বা খারাপ ফলের৷ নিয়মতান্ত্রিক হতে শেখাবে বাচ্চাদের। শাস্তি কেবল নয়, মূল্যবোধ শিখাবে৷ ছাত্রদের সাথে বিতর্কিত কোনো রাজনৈতিক আলাপ করবে না অপ্রাসঙ্গিকভাবে৷'' তবে এমন স্কুল তাঁর চোখে পড়েনি৷ তিনিও বলেন, ‘‘আমরা সিস্টেমের কাছে জিম্মি৷''
‘অভিভাবকদের মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন'
ঢাকার শীর্ষস্থানীয় স্কুলগুলোর মধ্যে গভর্নমেন্ট ল্যবরেটরি অন্যতম৷ ভালো ফল করার সুনাম দীর্ঘদিনের৷ সেই স্কুলের অধ্যক্ষ আবদুল খালেক দাবি করেন, তাঁর স্কুলে শিক্ষার্থীদের কোনো চাপ দেওয়া হয় না৷ যদি নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত থাকার বিষয়টি চাপের হয়ে থাকে, তবে সেইটুকু চাপই দেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের। এই চাপ অভিবাবকদেরও দেওয়া হয় বলে তিনি জানান৷ তাঁর দাবি, আর সব সরকারি স্কুলের মতোই স্বাভাবিক পড়াশোনার পদ্ধতি অনুসরণ করেই ভালো ফল করে তাঁর স্কুল৷ তিনি বলেন, ‘‘এখানে নিয়মিত পড়াশোনার পাশাপাশি নানা ক্লাব রয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থীরা নিজেদের সৃ্জনশীল কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত রাখে৷'' এর মধ্যেও চলতি বছর তাঁর স্কুলের এসএসসি পাস করা শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে ৫৬ জন সরকারি বৃত্তির তালিকাভূক্ত হয়েছে বলে জানানা তিনি৷ এটি চাপমুক্ত অর্জন বলেও দাবি তাঁর৷
এদিকে অভিভাবকদের চাপের অভিযোগ অস্বীকার করে সাউথ পয়েন্ট স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল জেরিনা ফেরদৌ্স বলেন, ‘‘ আলাদা করে কোনো স্কুল চাপ দিচ্ছে এমনটি বলা যাবে না৷ এখানে বড় চাপ হচ্ছে সৃ্জনশীল কারিকুলাম৷ এটি শেষ করতেই শিক্ষার্থীরা বড় চাপে থাকে৷ তবে আমাদের চেষ্টা থাকে সহজ করে তাদের সামনে সিলেবাস তুলে ধরার৷ আমাদের প্রতি ক্লাসে ২৫-৩৫ জন শিক্ষার্থী থাকে সর্বোচ্চ৷''
যদি ফেসবুক, টেলিভিশন ও ইন্টারনেট আসক্তি না থেকে থাকে, তবে কোনো কোচিংয়ের প্রয়োজন নেই বলেও মনে করেন তিনি৷ তবে তিনি মনে করেন, ‘‘অভিভাবকদের একটি সামাজিক সমস্যার নাম কোচিং৷ তাঁরা প্রায়ই বলেন, অমুকের ছেলে তিন বিষয়ে কোচিং করছে, আমার ছেলে এক বিষয়ে করছে, তাকে বঞ্চিত করছি কিনা৷ এমন মানসিকতা থেকেই কোচিং বাণিজ্যের পেছনে ছোটেন অভিভাবকরা৷ নতুবা এমনটি হওয়ার কথা নয়৷ স্কুলগুলো ভালো কিছু করার চেষ্টা করে সবসময়৷''
অভিভাবক ও স্কুলের প্রতিযোগিতামূলক আচরণ পরিবর্তনের কথা বললেনগতানুগতিক ধারার বাইরের স্কুল সহজপাঠ-এর ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য পারভেজ হোসেন৷ তিনি বলেন, ‘‘প্রথমত আমরা একটি নির্ভয়ের স্থান তৈরি করেছি স্কুলকে৷ এখানে শিশুদের শিক্ষকদের সঙ্গে ভালোবাসার ও নির্ভয়ের সম্পর্ক৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘আমাদের শিশুরা নম্বর পাওয়ার জন্য পড়ে না৷ তারা জানার ও বোঝার জন্য পড়ে৷ এখানে চাপ ছাড়াই শিক্ষাবোর্ডের কারিকুলামে ভালো ফল করা সম্ভব৷'' এ প্রসঙ্গে তিনি নালন্দা স্কুলের উদাহরণ টানেন৷ তিনি বলেন, ‘‘ইতোমধ্যে ৬টি ব্যাচ বের হয়েছে। তারা সবাই ভালো ফল করেছে৷ সুতরাং এটি সম্ভব৷''