লোড শেডিং আরও বাড়ছে, বাড়ছে মানুষের ভোগান্তি
১০ অক্টোবর ২০২২গত কয়েকদিনের ব্যবধানে বিদ্যুতের লোড শেডিং কোথাও কোথাও প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে ৷ দিনের পাশাপাশি গরমের মধ্যে রাতও কাটাতে হচ্ছে বিদ্যুৎহীন অবস্থায় ৷ ফলে গরমের মধ্যে হাঁপিয়ে উঠতে হচ্ছে মানুষকে ৷ বিদ্যুতের অভাবে রাজধানীতে পানি সংকটেও ভুগতে হচ্ছে অনেককে ৷
বিতরণকারী সংস্থাগুলো বলছে, সংকটের মধ্যে অক্টোবরে গরম বেড়েছে, যা পরিস্থিতি নাজুক করে তুলছে ৷ চাহিদা বাড়লেও উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না, ফলে কর্তৃপক্ষও অসহায় ৷
রোববার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল রাজশাহী ও চুয়াডাঙ্গায় ৩৫ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস ৷ ঢাকায় পারদ উঠেছিল ৩৫ দশমিক ৫ ডিগ্রিতে ৷ আরও কয়েক দিন এমন গরম থাকবে বলেই আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে ৷
দেশে এখন দিনে বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে ১৫ হাজার মেগাওয়াটের মতো, সেখানে উৎপাদন হচ্ছে ১২ হাজার থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ১৩ হাজার মেগাওয়াট ৷ চাহিদার তুলনায় দেড় থেকে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি থাকায় লোড শেডিং বেড়েছে ৷
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত দেশে ১২ হাজার ১৮৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ৷ আর রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৩ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট অর্থাৎ প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াটের মতো ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে ৷
সরকারের কর্মকর্তারা লোড শেডিং বাড়ার জন্য জ্বালানি সংকটের পুরনো কারণগুলোর সঙ্গে সাম্প্রতিক জাতীয় গ্রিড বিপর্যয়কেও কারণ দেখাচ্ছেন ৷
২৪ ঘণ্টায় লোড শেডিং 'চার-পাঁচবার'
ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে একজন কর্মকর্তা বলেন, গ্রিড বিপর্যয়ের পর থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর প্রকৌশলী, টেকনিশিয়ানরা সাবধানতার ‘চরম নীতি' অনুসরণ করছেন ৷ সেজন্য খুবই সতর্কতার সঙ্গে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালানো হচ্ছে ৷ সে কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে ৷
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ২১০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে যেখানে ১৮০-১৯০ মেগাওয়াট উৎপাদন হত, গ্রিড বিপর্যয়ের পর সেখানে ১২০-১৫০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে না ৷ গত ৪ অক্টোবর বিদ্যুতের জাতীয় সঞ্চালন লাইনে সমস্যার পর অন্তত ৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন ছিল রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিশাল এলাকা ৷
জ্বালানি সংকটে জুলাইয়ে সরকার সূচি অনুযায়ী লোড শেডিংয়ের যে পরিকল্পনা দিয়েছিল, উৎপাদন কম হওয়ায় শুরু থেকেই তা ভেস্তে যায় ৷ ঘাটতি বাড়তে থাকার মধ্যেই জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয় ঘটে ৷ এরপর সঞ্চালন লাইন সচল হলেও লোড শেডিং আগের তুলনায় বেড়ে গেছে ৷সম্প্রতি জাতীয় গ্রিডে সমস্যার কারণে বিদ্যুৎহীন অবস্থায় হাসপাতালে রোগীদের ভোগান্তিও চরমে ওঠেছে ৷
অসহনীয় ভোগান্তি
এই অবস্থায় রাজধানীবাসীকে দিনের অনেকটা সময় বিদ্যুৎহীন অবস্থায় পার করতে হচ্ছে ৷ ঢাকার বাইরের পরিস্থিতি আরও নাজুক ৷ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, দিনের পাশাপাশি এখন মধ্যরাতেও কয়েক দফায় লোডশেডিং হচ্ছে ৷
মিরপুরে কিছুদিন আগেও দৈনিক গড়ে ৩-৪ বার লোডশেডিং হলেও এখন হচ্ছে ৬-৭ বার এবং বিদ্যুৎ আসছে আগের তুলনায় বেশি সময় পরে ৷
মিরপুর ১২ নম্বরের বাসিন্দা একরামুল কবির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, শনিবার রাত ১২টার পর থেকে বিকাল পর্যন্ত ৪ বার লোড শেডিং হয়েছে ৷ ‘‘গতকাল রাত ১ টা থেকে ২টা, পৌনে ৭টা থেকে পৌনে ৮টা, সকাল পৌনে ১২টা থেকে পৌনে ১টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ ছিল না ৷ দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত আরও দুইবার বিদ্যুৎ গেছে ৷ মাঝরাতে যদি দুইবার বিদ্যুৎ চলে যায়, ঘুমাব কীভাবে? আগে তো রাতের দুর্ভোগটা ছিল না, এখন সেটা শুরু হল ৷” লোড শেডিং থাকবে না সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে, আশা প্রতিমন্ত্রীর৷
লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ায় বেশি দুর্ভোগে পড়েছে শিশু ও বয়স্করা ৷ কবির বলেন, ‘‘আমার তিন বছরের মেয়ে আর সাড়ে ছয় মাসের ছেলেটা কারেন্ট চলে যাওয়ায় অস্থির হয়ে পড়েছে ৷ রাতে বাচ্চা দুইটা একদম ঘুমাতে পারেনি ৷ দিনের বেলায়ও তো বিদ্যুৎ যাচ্ছে ৷”
মোহাম্মদপুর, কল্যাণপুর, শ্যামলী, আজিমপুর, মগবাজার, মালিবাগ, রামপুরা, বাসাবো, গোড়ান এলাকায় গতকাল রাত ১২টার পর থেকে সন্ধ্য পর্যন্ত ৫-৬ বার বিদ্যুৎ যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে ৷
জাতীয় গ্রিড বিপর্যয়ের আগে দক্ষিণ গোড়ান এলাকায় ২-৩ বার লোড শেডিং হলেও শনিবার থেকে ৬-৭ বার বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে এবং এক থেকে দেড় ঘণ্টা পরে আসছে ৷
দক্ষিণ গোড়ানের বাসিন্দা গৃহিনী মোর্শেদা আক্তার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘দুদিন ধরে একদম অসহ্য হয়ে যাচ্ছি লোড শেডিংয়ে ৷ একে তো অনেক গরম, তার উপরে এত বার বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে, যেটা বলার না ৷ রাত ১২টার পরে সকাল পর্যন্ত তিন বার লোড শেডিং হল ৷
‘‘আমরা মধ্যবিত্তরা আইপিএস বা জেনারেটর চালানোর মতো অবস্থায় নাই ৷ চার্জার ফ্যান-লাইট যে কিনব, সব কিছুর দাম এত বেশি, সংসার চালাতেই হিমশিম খাচ্ছি ৷ এগুলোর জন্য আলাদা বাজেট করার মতো অবস্থা নাই ৷’’ তিনি বলেন, ‘‘আমরা কোনোরকম সহ্য করে নিচ্ছি কিন্তু আমার শ্বাশুড়ি বয়স্ক মানুষ, ডায়াবেটিস, হাই প্রেসার-নানা ধরণের রোগে ভুগছেন ৷ লোডশেডিংয়ে ওনার অনেক কষ্ট হয়ে যাচ্ছে ৷ জানি না কমে এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে ৷’’
ঢাকার রামপুরায় গত কয়েকদিন ধরে তিন ঘণ্টা পর পর লোড শেডিং হচ্ছে ৷ রামপুরার বাসিন্দা তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘‘তার মানে দৈনিক ৮ বার লোড শেডিং ৷ এটা ভাবা যায়! বিদ্যুৎ না থাকলে গরমে একে তো নাভিঃশ্বাস অবস্থা, তার উপরে পানির সংকটও তৈরি হয়েছে ৷ চলাটা কঠিন হয়ে পড়েছে ৷’’
ফের গ্রিড বিপর্যয় কেন? বিদ্যুৎ বিভাগও অন্ধকারে
আজিমপুরের শেখ সাহেব এলাকার বাসিন্দা শাহনাজ পারভীন লোড শেডিংয়ে গরমের দুর্ভোগের পাশাপাশি ফ্রিজ নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝামেলায় পড়েছেন ৷
‘‘এই এলাকা তো এমনিতেই ঘিঞ্জি ৷ আলো-বাতাস ঢোকে না একেবারে ৷ গরমে তো কষ্ট হচ্ছেই, তার উপরে বিদ্যুতের আসা-যাওয়ার কারণে ফ্রিজটাও নষ্ট হয়ে গেল ৷ দুই বছরও ভালোভাবে চালাতে পারলাম না ৷ লোড শেডিংয়ে ক্ষতির কথা বলে বোঝানো যাবে না ৷বাচ্চারা পড়তে বসলে ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেলে, পরে আর পড়ায় মনোযোগ দেয় না ৷ খুব সমস্যা হচ্ছে ৷’’
আগারগাঁওয়ের বাসিন্দা মমিনা ইসলাম বলেন, ‘‘বেশ গরমের মধ্যেও দিনে চার-পাঁচবার বিদ্যুৎ চলে যায়, এজন্য মাঝে মাঝে বাসায় পানিরও সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। একদিকে গরম, একই সঙ্গে মশার উপদ্রব, তার সাথে দেখা দিয়েছে পানির সঙ্কট ৷ এইসব নিয়ে আমরা দিন পার করছি ৷’’
এ নিয়ে কর্তৃপক্ষ যা বলছে
বিদ্যুৎ কর্মকর্তারা বলছেন, যখন প্রচুর বিদ্যুতের প্রয়োজন, তখন বেশ কয়েকটি কারণ মিলে সংকট তীব্র হয়েছে ৷ তাদের ভাষ্য, বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনেকগুলো ইউনিট কারিগরি কারণে বন্ধ আছে ৷ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ আরও কমেছে ৷ বেশ কিছু বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র পূর্ণ উৎপাদনে যেতে পারছে না ৷
আন্তর্জাতিক বাজারে ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ৪-৫ মাসের বিল বকেয়া রয়েছে, সে কারণে তারা উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে বলে জানা গেছে ৷
বিতরণকারী কর্তৃপক্ষ বলছে, বিদ্যুৎ কম উৎপাদন হওয়ার মধ্যে গরমে চাহিদা বেড়েছে ৷ গরম না কমলে পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার আশা দেখছেন না তারা ৷
ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘কয়েকদিন ধরে গরমটাও অসহনীয় মাত্রায় বেড়েছে ৷ মানুষ ফ্যান, এসি এগুলো বেশি ব্যবহার করছে ৷ লোড অনেক বেড়ে গেছে ৷
‘‘সাধারণত ছুটির দিনে আমাদের চাহিদা থাকে ১৪৫০-১৫০০ এর মতো কিন্তু আমরা পাচ্ছি ১১০০-১২০০ এর মতো ৷ আমরা বরাদ্দ কম পাচ্ছি, তাই লোডশেডিং দিতে হচ্ছে ৷ ’’
ডেসকোর এমডি কাউসার আমির আলীও বলেন, ‘‘আমরা যতটুকু বরাদ্দ পাচ্ছি, সে অনুযায়ী বিতরণ করছি ৷ পিডিবি আমাদের যা দিচ্ছে, আমরা তাই দিচ্ছি কিন্তু চাহিদা আরও বেশি ৷’’
সংকটের কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘‘পিডিবি আমাদের জানিয়েছে, তারা গ্যাস পাচ্ছে না ৷ তরল জ্বালানি প্রাপ্তিতে সমস্যা হওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে ৷ উৎপাদন কম হওয়ায় আমরা চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারছি না ৷’’
এনএস/কেএম (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)