1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

লাগাতার শিক্ষক-নির্যাতন, জোরপূর্বক পদত্যাগ ও নিন্দা-বিবৃতি

সমীর কুমার দে ঢাকা
৩০ আগস্ট ২০২৪

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সারাদেশে বিভিন্ন সেক্টরে ‘পদত্যাগের’ হিড়িক পড়েছে৷ ব্যতিক্রম নয় শিক্ষা সেক্টরও৷ কিছু ‘স্বেচ্ছায়’ পদত্যাগের ঘটনা ঘটলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্যাতন করে জোরপূর্বক পদত্যাগের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে৷

https://p.dw.com/p/4k7aD
বাংলাদেশে জোর করে পদত্যাগ করানোর বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে৷
প্রতীকী ছবিছবি: picture-alliance/Robert B.Fishman/ecomedia

অনেক শিক্ষক পালিয়ে বেড়াচ্ছেন৷ অনেক শিক্ষককে জোর করে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে৷ 

শিক্ষা ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ গত রবিবার বলেছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পদে দায়িত্বরতদের জোর করে পদত্যাগ করানোর সুযোগ নেই৷ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পদে যারা দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের কারো বিরুদ্ধে ন্যায়সংগত অভিযোগ থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷ নতুন করে পদায়ন ও নিয়োগের কার্যক্রম চলছে৷ জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করে অস্থিরতা সৃষ্টি করলে প্রশাসন ভেঙে পড়তে পারে৷ শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পেতে অসুবিধা হবে৷ একটি সফল অভ্যুত্থানের পর সুশৃঙ্খল সমাজে ফিরে যাওয়ার আকাঙ্খা ব্যক্ত করে উপদেষ্টা বলেন, শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যে ধরনের সম্পর্ক আশা করা হয়, সেটি ফিরিয়ে আনতে হবে এবং কাউকে অপমানিত করা যাবে না৷

‘এটা অবশ্যই কোনো ভালো বিষয় না’

নেত্রকোণার মোহনগঞ্জ উপজেলার হাছলা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তায়জুল ইসলামের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ তুলে পদত্যাগের দাবিতে মানববন্ধন করেছেন স্থানীয় কিছু লোকজন৷ গত মঙ্গলবার দুপুরে উপজেলা চত্বরে ওই শিক্ষকের পদত্যাগের দাবিতে মানববন্ধন করা হয়৷ স্কুলের কিছু শিক্ষার্থীও সেখানে ছিল৷ পরে এলাকার ছয়জনের স্বাক্ষরিত একটি লিখিত অভিযোগ উপজেলা নিবাহী কর্মকর্তার কাছে জমা দেন৷

অভিযোগে বলা হয়েছে, প্রধান শিক্ষক তায়জুল ইসলাম আত্মীয়করণ করে স্কুল পরিচালনা করে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতি করেছেন৷ তার বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ রয়েছে বলেও অভিযোগ করে তারা৷ উদ্ভুত পরিস্থিতিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেজওয়ানা কবির ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এলাকার লোকজন আমার কাছে এসে একটা অভিযোগ জমা দিয়েছেন৷ অভিযোগগুলো তদন্ত করা হবে৷ পরে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে৷ তদন্ত ছাড়া কারো বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া যায় না৷ তাদের দাবি অনুযায়ী সহকারী শিক্ষক বজলুর রহমান ঠাকুরকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে৷ আপাতত এক মাসের ছুটিতে পাঠানো হয়েছে প্রধান শিক্ষককে৷” 

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক তায়জুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের কারণে কিছু লোক আমার বিরুদ্ধে লেগেছে৷ সরকার পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তারা মিথ্যা অভিযোগ তুলে আমাকে স্কুল থেকে সরিয়ে দিতে চাইছে৷ অথচ আমি নিজে জায়গা দিয়ে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছি৷ এক একর ২৫ শতাংশ জমি আমি বিনা পয়সায় স্কুলকে লিখে দিয়েছি৷ আমি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক৷ ২২ বছর ধরে আমি এখানে আছি৷ আমার চাকরির আর দুই থেকে আড়াই বছর বাকি আছে৷ আমি চাই তাদের অভিযোগের তদন্ত হোক, প্রমাণিত হলে আমি স্বেচ্ছায় চলে যাবো৷ নিয়োগ বাণিজ্যসহ যতগুলো অভিযোগ করা হয়েছে- সবগুলো মিথ্যা৷ ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বকে এই সুযোগে কাজে লাগাতে চাইছেন কিছু মানুষ৷” 

একইভাবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও শিক্ষার্থী পরিচয় দিয়ে দিনাজপুরের বীরগঞ্জ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষের কক্ষে প্রবেশ করেন অন্তত ৪০ জন৷ বিভিন্ন অভিযোগ তুলে তারা অধ্যক্ষকে পদত্যাগে বাধ্য করেন৷ এ ঘটনা গত ২২ আগস্টের৷ পরে অধ্যক্ষ মাসুদুল হকের পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করার ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে৷ এর প্রতিবাদে পরদিন, অর্থাৎ বৃহস্পতিবার সকালে উপজেলা শহরের বিজয় চত্বরে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেন৷ পরে তারা অধ্যক্ষ মাসুদুল হককে কলেজে ফিরিয়ে আনেন৷ ২০২১ সালের আগস্টে মাসুদুল হক বীরগঞ্জ সরকারি কলেজে অধ্যক্ষ পদে যোগ দেন৷ শিক্ষকতার পাশাপাশি মাসুদুল হক কবি, মুক্তিযুদ্ধ ও লোকসংস্কৃতি বিষয়ক গবেষক হিসেবে পরিচিত৷

ব্যক্তিজীবনে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ছিলেন না মন্তব্য করে মাসুদুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, "শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হচ্ছে শেখার জায়গা৷ কোনো শিক্ষক যদি কলেজে অনিয়মিত হন, শিক্ষার্থীদের সঠিক পাঠদান না করেন, সে বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে ব্যক্তি আক্রোশের শিকার হলাম৷ আমার বিরুদ্ধে যদি কোনো অভিযোগ থাকে, সেটা বলুন, আমি এখান থেকে চলে যাবো৷ কিন্তু শিক্ষার্থীদের দিয়ে নোংরা রাজনীতির খেলা কেন? কতিপয় শিক্ষার্থী ও শিক্ষক অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য এ রকম একটি ঘটনার জন্ম দিলো৷”

শুধু এই দু'টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়, এমন অসংখ্য ঘটনা নিয়মিত ঘটছে৷ এ সম্পর্কে এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এটা অবশ্যই কোনো ভালো বিষয় না৷ শিক্ষকদের জায়গা তো মর্যাদার৷ সেটাই যদি না থাকে তাহলে শিক্ষা কিভাবে এগুবে? আগে তো আমরা এমন পরিস্থিতি দেখিনি৷ এবারই দেখছি, শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে৷ এর ফল কোনোভাবেই ভালো হবে না৷”

অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হকও মনে করেন, যেটা হচ্ছে, ভালো হচ্ছে না৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, "আসলে গত ১৫ বছরে সবকিছুতেই অবক্ষয় হয়েছে৷ শিক্ষকরা তো সমাজের বাইরের কেউ নন৷ ফলে তাদের উপরও দলীয় রাজনীতির একটা প্রভাব পড়েছে৷ এর ফলে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাতেই একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে৷ কারিকুলাম পরিবর্তনের নামে শিক্ষাকে নিয়ে নানা ধরনের কাটাছেঁড়া হয়েছে, যা ভালো হয়নি৷ শিক্ষকদের পদত্যাগের যে ঘটনাগুলো ঘটছে, সেটা দ্রুতই বন্ধ হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি৷”

শুধু পদত্যাগ নয়, অনেক জায়গায় শিক্ষক বা শিক্ষিকাকে অপমান করা হচ্ছে৷ ঢাকার সরকারি আজিমপুর গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক গীতাঞ্জলি বড়ুয়াকে গাছের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন করা হয়েছে৷ পরে তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে৷ দেশের বিভিন্ন জায়গায় এমন বহু শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার অভিযোগও মিলেছে৷

দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগ করানোর ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে জাতীয় ছাত্র পরিষদ৷ এক বিবৃতিতে সংগঠনের প্রধান সমন্বয়ক এলাহান কবীর বলেন, "ফ্যাসিবাদের পতন হওয়ার পর দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ও প্রভাবশালীরা জোরপূর্বক শিক্ষকদের পদত্যাগ করাচ্ছেন৷ বিষয়টি খুবই উদ্বেগজনক৷ আমরা এসব ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি৷ দেশে আইন-আদালত বিদ্যমান আছে৷ যদি কেউ অন্যায় করে থাকেন, তাহলে আইন অনুযায়ী বিচার হবে৷ কিন্তু প্রভাব খাটিয়ে বেআইনিভাবে কাউকে পদত্যাগ করানো কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়৷”

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালনরতদের জোরপূর্বক পদত্যাগ করানো, নারী প্রতিষ্ঠান প্রধানদের শারীরিকভাবে হেনস্তা ও বল প্রয়োগ করে পদত্যাগ করানো ও অপদস্থ করার প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি (বাকবিশিস)৷ একইসাথে দেশে বিরাজমান আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতেও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সংগঠনটি৷ গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই প্রতিবাদ জানানো হয়েছে৷ 

‘ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের কারণে কিছু লোক আমার বিরুদ্ধে লেগেছে’

এই পরিস্থিতিতে শিক্ষক সংগঠনগুলো কী করছে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইউনিভাসির্টি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি ওবায়দুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমরা মূলত কারিকুলাম নিয়ে কথা বলছি৷ বিগত সরকার শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে৷ আমরা সেটা পূর্ণগঠন করতে বলছি৷ আর শিক্ষক নির্যাতনের ঘটনায় আমরা একটা বিবৃতি দিয়েছি, সেখানে এই ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে সে কথা বলেছি৷ আমরা এভাবে পদত্যাগকে সমর্থন করি না৷ কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে সেটার বিচার হতে পারে৷”

বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে শিক্ষকদের অপমান এবং হেনস্তার শিকার হওয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি৷ কমিটির পক্ষে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়, "সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক, অধ্যক্ষ বা উপাচার্যকে শিক্ষার্থীরা জোরপূর্বক পদত্যাগ করতে বাধ্য করছে৷ জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করার জন্য শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা করছে না৷ এই হেনস্তা থেকে নারী শিক্ষকরাও রেহাই পাচ্ছেন না৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য ছাত্রদের ব্যবহার করা হচ্ছে৷ সারা দেশে সৃষ্ট এ ধরনের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাসমূহে সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি গভীরভাবে লজ্জিত, দুঃখিত এবং উদ্বিগ্ন৷ সামাজিক প্রতিরোধ কমিটি মনে করে, এসব ঘটনা সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা এবং পাঠদান প্রক্রিয়ায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে এবং শিক্ষা ব্যবস্থাকে দুর্বল করে ফেলবে৷

বাংলাদেশ শিক্ষক-কর্মচারী ঐক্য জোটের সভাপতি সেলিম ভূঁইয়া ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমরা এইসব ঘটনার প্রতিবাদ করেছি৷ তবে এ কথাও আমাদের মনে রাখতে হবে, ১৫ বছর যেভাবে অত্যাচার নির্যাতন হয়েছে তার রেশ কিছু পড়বেই৷ এখনো তো স্কুল-কলেজের গর্ভনিং বডির সদস্য যারা আছেন তারা তো আওয়ামী লীগ সরকারের নিয়োগ করা৷ সরকার এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র সভাপতি পদ থেকে দায়িত্বপ্রাপ্তদের সরিয়ে দিয়েছে৷ অন্যরা তো আছে৷ যা হচ্ছে সেটা তো তারাই করছেন৷ আর শিক্ষার্থীরা যদি ক্ষোভ থেকে কিছু করে সেটা আপনি ঠেকাবেন কিভাবে? আমরা সারাদেশে সবাই বলেছি, এই ঘটনা যাতে আর না ঘটে৷”