রোদে, বৃষ্টিতে সহায় ছাতার আদ্যোপান্ত
ছাতা, ছত্র, ছত্রী বা ছাতি শুধু রোদের তাপ বা বৃষ্টি থেকেই নয়, ক্ষতিকর অতি বেগুনি রশ্মি থেকেও শরীর এবং ত্বককে রক্ষা করে। তার আদ্যোপান্ত জানুন, দেখুন ছবিঘরে...
কবে, কোথায়
ছাতা ও ছাতার ইংরেজি Umbrella শব্দ এসেছে যথাক্রমে লাতিন শব্দ ‘টগইজা’ ও ‘আমব্রা’ থেকে, যার অর্থ ‘ছায়া’। ছাতার আবিষ্কার তা নিয়ে নানা বক্তব্য রয়েছে। তবে প্রায় চার হাজার বছর আগে মিসর, গ্রিস ও চীন দেশের চিত্রকর্মে এর উপস্থিতি দেখা যায়, খ্রীষ্টপূর্ব ২৪০০- ২৫০০র দিকে রাজা ও দেবতাদের ছায়াদানের জন্য চারকোণা সমতল ছাতা ব্যবহার করা হতো। তবে ছাতা তৈরি হয়েছিল সূর্যের তাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য।
দেশে ছাতা তৈরি
পুরান ঢাকার চক মোগলটুলিতে ১৯৫৪ সালে ছাতা বিক্রি শুরু করেন তাজ উদ্দিন আহমেদ। ধারণা করা হয়, দেশে ওটাই ছিল ছাতার প্রথম বাজার। ভারত থেকে আনা হতো হাতল, শিক, রানার, স্ট্রেচার ইত্যাদি। দেশের বাজার থেকে সংগ্রহ করা হতো ছাতার শীর্ষভাগের খাঁজ, কালো কাপড়, কাঠের হাতল ও এর বাঁকা অংশ। ভারত এবং স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা বিভিন্ন অংশ নিজের দোকানে বসে জোড়া লাগিয়ে ছাতা বানিয়ে দেশের বাজারে বিক্রি করতেন তাজ উদ্দিন আহমেদ।
একসময়ের কুটির শিল্প
বাপ-দাদার আমল থেকে ছাতা ব্যবসার সাথে জড়িত এমন ব্যবসায়ীদের অনেকেই বলেন , একটা সময় ছাতা তৈরিকে কুটিরশিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল, তবে সে সময় দেশেই তৈরি হতো স্থানীয়ভাবে ব্যবহার্য ছাতাগুলো। কিন্তু চীনা ছাতার আধিপত্যের কারণে সে শিল্প এখন প্রায় হারিয়েই গেছে। ব্যবসার মন্দার কারণে অনেকে অন্য পেশায় জড়িয়ে পড়েছেন।
‘বাংলা ছাতা’
লম্বা বাঁটের সাবেকি ছাতা ‘বাংলা ছাতা’র চল এখন কমে এসেছে। বাংলা ছাতা তৈরি হয় বাংলাদেশেই। সেই আদিকালের কাঠের বাঁটওয়ালা কালো সুতি কাপড়ের ছাউনি দেওয়া ৮ শিক বিশিষ্ট ২৬ থেকে ৩০ ইঞ্চি ঘেরের ছাতার দাম ১৪০ থেকে ১৮০ টাকা বলে জানান বৈশাখী ছাতার দোকানের স্বত্ত্বাধিকারী সুমন আহমেদ। তবে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা জানান, বর্তমানে বাংলা ছাতার বিক্রি খুব কম।
বর্ষা ছাড়া বিক্রি নেই
জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে ছাতার একটা চালান বিক্রি হয় বলে জানান অ্যাটলাস ছাতা কারখানার তত্ত্বাবধায়ক নিয়াজ আহমেদ। ছাতার বিক্রেতারা জানান, তাদের ছাতা বিক্রির তারতম্য নির্ভর করে বৃষ্টির তীব্রতার উপর। বৃষ্টির ভরা মৌসুমে দোকানিদের ফুরসত নেওয়ার জো থাকে না। তবে এবছর ঢাকায় বৃষ্টি সেভাবে শুরু না হওয়ায় এখনো ছাতার বাজার জমে ওঠেনি। গত ৩-৪ বছর ধরে ছাতার বাজার মন্দা যাচ্ছে বলেও জানান বিক্রেতারা।
দাম ও প্রকারভেদ
অন্যতম বৃহৎ দুটি পাইকারি বাজার চক মোগলটুলি ও নবাবপুরে চীনের তৈরি ভাঁজ করা ছাতা বিকোচ্ছে প্রচুর। এসব ছাতা দুই থেকে পাঁচ ভাঁজ পর্যন্ত করে রাখা যায়। এছাড়া রয়েছে গার্ডেন ছাতা, কান ছাতা, মুঠি ছাতা ইত্যাদি। চীনা ছাতাগুলো ম্যানুয়াল, সেমি-অটোমেটিক ও অটোমেটিক - এই তিন ক্যাটাগরির উপর দাম নির্ধারিত হয়। শংকর ছাতা ২৫০ থেকে ৪৫০, দেশি ছাতা ১৪০ থেকে ১৮০, গার্ডেন ছাতা ৬০০ থেকে ১২০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।
ছাতার বিকল্প পলিথিন
বৃষ্টিতে নিম্নবিত্তদের খুব একটা ছাতা ব্যবহার করতে দেখা যায় না। ছাতার পরিবর্তে তারা পলিথিন এবং ফুটপাথ থেকে সস্তায় কেনা রেইনকোট ব্যবহার করেন। ছাতা না থাকার কারণ জানতে চাইলে আবুল হোসেন নামের এক ভ্যানগাড়ি চালক বলেন, ‘‘ছাতার যে দাম তাতে আমগো পোষায় না। তাছাড়া আমরা কাম কইরা খাই, ফুলবাবুর মতো ছাতা নিয়া কাম করা সম্ভব না। আমরা হস্তা ৫০-১০০ টেকা দিয়া প্লাষ্টিক বা রেইনকুট কিনা লয়া কাম চালাই।’’
বাজারে চায়না ছাতার জয়জয়কার
গত ১৫-২০ বছর ধরে দেশি ছাতার বাজার চীন দখল করে নিয়েছে। এমনকি এখন বিখ্যাত দেশি ব্র্যান্ডগুলোও চীন থেকে শিক, রড, রানার, সুতা, কাপড় ইত্যাদি উপকরণ আমদানি করে নিজেদের কারখানায় জোড়া দিয়ে নিজেদের কোম্পানির নামে বিক্রি করছে। চায়না ছাতাগুলো সহজে বহনযোগ্য, ব্যবহারোপযোগী এবং হাল ফ্যাশনের হওয়ায় তরুণ ক্রেতাদের মধ্যে এসব ছাতার ব্যাপক চাহিদা।
এখনো মুরুব্বিদের পছন্দ দেশি ছাতা
পুরান ঢাকার চক মোগলটুলির বৈশাখী ছাতার স্বত্বাধিকারী সুমন আহমেদ বলেন, ‘‘বর্তমানে বাজারে ৩-৪টি কোম্পানির দেশি ছাতা আছে। আমাদের দেশি ছাতাগুলো গ্রামের মুরুব্বিরাই বেশি পছন্দ করেন। দেশি ছাতার পাশাপাশি রয়েছে ‘মহেন্দ্র দত্তের’ ছাতা, যা এখন বেশ দুর্লভ। গ্রাম-গঞ্জে চাহিদার পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোনাকাটার ক্ষেত্রে দেশি ছাতা কিনে থাকে।’’
যেসব ছাতার বিক্রি বেশি
ছাতা বিক্রেতাদের মতে, এ মুহূর্তে ছাতার অন্যতম জনপ্রিয় ব্র্যান্ড শংকর ছাতা। বর্তমানে শংকরের ২৫ ধরনের ছাতা পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া মুন, অ্যাটলাস, রহমান, আলম, বিএমডাব্লিউ, শরিফ এসব ব্র্যান্ডের ছাতার খুব ভালো বিক্রি হচ্ছে। ছাতার আকার, ভাঁজ, ব্র্যান্ড, শিকের সংখ্যা, কাপড় ইত্যাদির ভিন্নতার উপর ছাতার দাম নির্ভর করে।
বদলে যাচ্ছে রুচি
আঠারো শতক পর্যন্ত ছাতা ছিল বড়, ওজনও ছিল বেশি। তখন অনেক সময় ছাতা বানানো হতো তিমিমাছের কাঁটা, সোনা, রুপা, চামড়া, হাতির দাঁত ইত্যাদি দিয়ে। প্রথম ভাঁজযোগ্য ছাতা তৈরি করেন জার্মানির হ্যানস হাপট, ১৯২০ সালে। এ যুগে ছাতার হাতল, কাপড়ের নকশা ও রঙে এসেছে বৈচিত্র্য, সঙ্গে নিত্য-নতুন প্রযুক্তিগত সুবিধাও যুক্ত হচ্ছে। বাংলা ছাতা, মহেন্দ্র দত্তের ছাতা বেশি টেকসই হলেও দিনে দিনে মানুষের রুচি-অভ্যাস বদলে যাচ্ছে।
প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার
ছাতার পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা জানান, দেশি ছাতার মান ভালো হলেও প্রতিযোগিতায় টিকতে পারেনি স্থানীয় ছাতাশিল্প। ভালো মানের ভাজযোগ্য ছাতা তৈরি করার জন্য প্রয়োজন বড় মাপের বিনিয়োগ। হাকিম ট্রেডিং সেন্টারের মালিক মোঃ সিদ্দিক বলেন, ‘‘সরকার যদি প্রণোদনা ও ছাতার খুচরা অংশ আমদানিতে করমুক্ত সুবিধা দেয়, তাহলে এখানেও ছাতাশিল্পে উন্নতি করার বিশাল সুযোগ রয়েছে।’’