রানা প্লাজা ধসের ৬ বছর পর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত
৬ বছর আগে ঢাকার সাভারে রানা প্লাজা ধ্বসে মৃত্যু হয় ১,১৩৪ জন শ্রমিকের৷ বিশ্বে তৈরি পোশাক শিল্পের ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাণঘাতী এ দুর্ঘটনার পর বড় ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে দেশের প্রধান রপ্তানি খাতটিকে৷
অনিয়মের ভবন
আট তলা একটি ভবন, যার চার তলাই নির্মাণ করা হয়েছে অনুমোদন ছাড়া৷ ভবনটির নকশা করা হয়েছিল দোকান আর অফিসের জন্য, কিন্তু সেখানে গড়ে ওঠে একাধিক কারখানা৷ ভারি যন্ত্রপাতি আর সেগুলোর কম্পন বহন করার সক্ষমতা ছিল না ভবনটির৷ রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা ছিলেন স্থানীয় যুবলীগের সদস্য৷
দুর্ঘটনা, না হত্যা?
২৩ এপ্রিল, ২০১৩ সাল৷ ফাটল দেখা দেয়ায় ভবনটি খালি করে দেয়া হয়৷ বন্ধ করে দেয়া হয় নীচ তলার দোকান আর ব্যাংকের কার্যালয়৷ স্থানীয় গণমাধ্যমে সোহেল রানা তখন দাবি করেন, ভবনটি সম্পূর্ণ নিরাপদ৷ বেতন কাটার হূমকি দিয়ে পরের দিন জোর করে কাজে যোগ দিতে বাধ্য করা হয় শ্রমিকদের৷ সেদিন সকালেই ধসে পড়ে রানা প্লাজা৷
মৃত্যুর মিছিল
২৪ এপ্রিল, ২০১৩ সাল৷ ৩১২২ জন শ্রমিক রানা প্লাজায় ব্যস্ত ছিলেন পোশাক তৈরিতে৷ তাঁদের নিয়েই ধসে পড়ে বিশাল ভবনটি৷ প্রাণ হারান ১১৩৪ জন শ্রমিক৷ বাকিরা বেঁচে গেলেও, অনেকেই পঙ্গু হয়ে যান৷ অনেকে আজও ভুগছেন মানসিক যাতনায়৷
ক্ষতিপূরণ প্রক্রিয়া
আহত ও নিহতদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য রানা প্লাজা ধসের ৬ মাস পর জেনেভায় একটি উদ্যোগ নেয় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও৷ পরবর্তীতে সরকার, আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডসহ বিভিন্ন পক্ষকে নিয়ে গঠিত হয় ‘রানা প্লাজা কো অর্ডিনেশন কমিটি’, যার মাধ্যমে ২০১৫ সালে এসে ক্ষতিপূরণ দেয়ার প্রক্রিয়াটি চূড়ান্ত হয়৷ মোট ৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার দেয়া হয়েছে নিহতদের পরিবার ও আহতদের৷
চাপে ব্র্যান্ড
রানা প্লাজায় যে ৫ টি কারখানা ছিল, সেগুলোর ক্রেতাদের মধ্যে ছিল ওয়ালমার্ট, সিঅ্যান্ডএ, কিক-এর মতো কয়েকটি বৈশ্বিক ব্র্যান্ড৷ পোশাক কারখানাগুলোর কর্মপরিবেশ নিয়ে এ সময় তারা ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে পড়ে৷ ইউরোপ, অ্যামেরিকার সাধারণ ক্রেতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংগঠন এসব ব্র্যান্ডের স্টোরের সামনে বিক্ষোভ করেন৷
সংস্কারের উদ্যোগ
সমালোচনার মুখে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানাগুলো পরিদর্শন ও সংস্কারের উদ্যোগ নেয় আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ও বিভিন্ন সংগঠন৷ ইউরোপীয় ব্র্যান্ডগুলোর নেতৃত্বে গঠিত হয় অ্যাকর্ড আর অ্যামেরিকার ব্র্যান্ডগুলোর প্রাধান্যে গড়ে ওঠে অ্যালায়েন্স৷ যেসব কারখানা থেকে ব্র্যান্ডগুলো পোশাক কেনে, সেগুলোর ত্রুটি বের করে সংস্কারের নির্দেশনা দেয় এই দুটি জোট৷
নিরাপদ কর্মপরিবেশের নিশ্চয়তা
অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের অধীনে আছে ২২৫৪ টি কারখানা৷ ৫ বছরে তারা ত্রুটির প্রায় ৯০ ভাগই সারিয়েছে৷ যেসব কারখানা ঝুঁকিপূর্ণ ছিল, সেগুলো বন্ধ করে দিয়েছে সরকার৷ সংস্কার না করায় ১৯৪ টি কারখানাকে ব্যবসার অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে৷ ৬২৫ টি কারখানা প্রাথমিক সংস্কারের কাজ পুরোপুরি শেষ করেছে৷
অ্যাকর্ড নিয়ে জটিলতা
সরকারের সাথে চুক্তি অনুযায়ী গত বছর পর্যন্ত কাজের মেয়াদ ছিল অ্যাকর্ড ও অ্যলায়েন্সের৷ এর মধ্যে অ্যালায়েন্স নিজেদের গুটিয়ে নিলেও মে ২০২১ সাল পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধি করেছে অ্যাকর্ড, যার বিরোধিতা করে আসছেন কারখানা মালিকরা৷ মামলাও করেছে একটি প্রতিষ্ঠান৷ কয়েক দফা পেছানোর পর ১৯ মে যার পরবর্তী শুনানির তারিখ নির্ধারণ করেছে সুপ্রিম কোর্ট৷
শক্তিশালী রপ্তানি প্রবৃদ্ধি
রানা প্লাজা ধসের পর অনেকেই মনে করেছিলেন বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে এর বড় ধরণের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে৷ তেমনটা না হলেও পোশাক কারখানা সংস্কারের উদ্যোগ আর অনেক কারখানা বন্ধ হওয়ায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি তলানিতে নেমে যায়৷ তবে গত দুই বছরে তার গতি আবার বেড়েছে৷ চলতি অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত রপ্তানি বেড়েছে সাড়ে ১২ ভাগের বেশি৷
এখনো ভুগছেন তাঁরা
আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশনএইড সম্প্রতি একটি জরিপ করেছে৷ তাদের জরিপ অনুযায়ী রানা প্লাজা ধসে আহত শ্রমিকদের ৫১ ভাগ এখনো বেকার৷ ৭৪ ভাগ শারীরিক কারণে আর ২৭ ভাগ মানসিক দুর্বলতার কারণে এখনো কাজ করতে পারছেন না৷ আহতদের সাড়ে দশভাগ এখন ট্রমায় রয়েছেন৷