কেশবিন্যাস পরিণত হচ্ছে ‘কেশ-বিনাশে’
১১ আগস্ট ২০১৭গত দু'সপ্তাহ ধরে মহিলারা কখনও ঘরের মধ্যে হঠাৎই শুনছেন অচেনা সুর৷ তার পরে অবশ হয়ে আসছে শরীর৷ আবার কখনও বা আশেপাশে কোনো মোটাসোটা চেহারার নড়াচড়া টের পাওয়া যাচ্ছে! তার পরে অসহ্য মাথা যন্ত্রণা৷ কারও কারও ক্ষেত্রে আবার এ সব কিছুই নয়৷ বন্ধ ঘরের ভেতরে ‘ব্যাখ্যাহীন’ ঘটনার শিকার ভারতের বহু নারী৷ আট থেকে আশি — সব বয়সের মহিলাদের চুলের ঝুঁটি নাকি ‘কেউ’ এসে সম্পূর্ণ অজ্ঞাতসারে কেটে দিয়ে যাচ্ছে! নানা দিকে অভিযোগের ঢল৷
কিন্তু ‘চুল-চেরা’ বিশ্লেষণের পরেও এই আজব ঘটনার রহস্যভেদ করতে পারেনি পুলিশ৷ ফলে আরও দ্রুত ছড়াচ্ছে গুজব এবং ত্রাস৷ এমনকি হিংসার ঘটনাও ঘটছে৷
যেমন চুল কেটেছেন এই সন্দেহে উত্তর প্রদেশের আগ্রায় এক ষাটোর্ধ্ব দলিত মহিলা মালা দেবীকে পিটিয়ে খুন করেছে গ্রামবাসীরা৷ আবার নেহাৎ টাকার লোভে নিজেরাই নিজেদের চুল কেটে নেওয়ার ঘটনাও ঘটছে৷ এক অদ্ভুত গুজব ছড়ায় উত্তর প্রদেশে৷ রটে যায়, যে সমস্ত মহিলাদের বিনুনি কেটে নেওয়া হচ্ছে, তাঁদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১ লক্ষ টাকা দিচ্ছে সরকার৷ এই গুজবে কান দিয়ে ১৭ বছরের কিশোরীর বিনুনি কেটে ফেলে তারই পরিবার৷
চিকিৎসক তথা লোকসভার সাংসদ ডা. কাকলি ঘোষদস্তিদার বলছেন, ‘‘এর পেছনে রয়েছে অশিক্ষা৷ যে এলাকায় এমন ঘটনা ঘটছে সেগুলি তুলনামূলক ভাবে পিছিয়ে পড়া এলাকা৷ দীর্ঘদিন ধরে সমাজের অবহেলিত একটা অংশ নিজেরা গুরুত্ব পেতে এমন এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটাচ্ছেন৷ নিজেরাই নিজেদের চুল কাটছেন৷’’ গত সপ্তাহে দিল্লির একটি গ্রামে রহস্যজনক ভাবে তিনজন মহিলার বেণী কেটে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে৷ তাঁরা প্রত্যেকেই বলেছেন, আচমকাই মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করেন৷ এরপরই তাঁরা অচেতন হয়ে পড়েন৷ আর যখন জ্ঞান ফেরে তখন দেখতে পান, তাঁদের পাশেই মাটিতে পড়ে রয়েছে তাঁদের চুলের বেণীর কাটা অংশ৷
এর আগে, গুরুগ্রাম এবং হরিয়ানার পালওয়াল ও মেওয়াটে এই ধরনের প্রায় ১৫টি ঘটনার খবর পাওয়া গেছে৷ দিল্লির চাওয়ালায় প্রথম এই ঘটনার শিকার হন ৫৫ বছরের এক প্রৌঢ়া৷ নিজের ফার্ম থেকে সকাল ১০.৩০টা নাগাদ বাড়ি ফিরছিলেন ওই মহিলা৷ হঠাত্ই তিনি মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা অনুভব করেন৷ তারপর গেটে তালা দিয়ে আছড়ে পড়েন বিছানায়৷ তিনি জানান, ‘‘আচমকাই আমার মাথায় খুব যন্ত্রণা হতে শুরু করে৷ আমি চিত্কার করে নাতি-নাতনিদের ডাকতে থাকি৷ তবে কুলারের শব্দে কেউ শুনতে পায়নি৷’’ কিছুক্ষণ পরে নাতনি ওই ঘরে গিয়ে দেখে যে ওই মহিলা অচেতন অবস্থায় পড়ে আছেন৷ তাঁর লাল চুলের বেণীর কাটা অংশ পড়ে আছে মাটিতে৷ ওই প্রৌঢ়া জানিয়েছেন, ‘‘আমি যখন বাড়ি ফিরছিলাম, তখন কারও সঙ্গে দেখা হয়নি৷ কেউ অনুসরণও করছিল না৷ যখন বিছানায় শুয়ে পড়ি, তখনও কেউ স্পর্শও করেনি৷ কেউ চুল কেটে নিচ্ছে, এমন কিছু মনেও পড়ছে না৷’’
অন্যদিকে, পশ্চিম দিল্লির মায়াপুরীর ঘটনাটি আরও চমকপ্রদ৷ রাতে দরজা বন্ধ করে ঘুমোচ্ছিলেন ৩৭ বছরের মনিকা এবং তাঁর তিন মেয়ে৷ শেষ রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে মনিকাদেবী দেখেন, তাঁর বালিশে পড়ে রয়েছে চুলের গোছা৷ ভয় পেয়ে মেয়েদের ঘুম থেকে তুলে দিয়ে তাঁর চোখে পড়ে একই কাণ্ড! মনিকা জানিয়েছেন, ‘‘আমি নিজে দরজায় খিল দিয়ে শুয়েছি৷ কারও ঢোকার কোনো সম্ভাবনাই নেই৷ এমনকি কুকুর বেড়ালেরও নয়৷’’ আপাত ‘যুক্তিহীন’ এমন ঘটনার শিকার পূর্ব দিল্লির পাণ্ডব নগরের ৫০ বছর বয়স্ক মালতীদেবী৷ পুজো করছিলেন সন্ধ্যাবেলায়৷ বাড়িতে একাই ছিলেন৷ হঠাৎ মনে হল, কালো মতো ভারী শরীরের কেউ একজন তাঁর গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে৷ এর পরেই সংজ্ঞা হারান তিনি৷ জ্ঞান ফিরতে দেখেন, মাটিতে সাজানো রয়েছে তাঁরই মাথার চুল৷
বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করছেন, সমস্যা যত না আইন-শৃঙ্খলার, তার চেয়ে বেশি মানসিক৷ অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্সেস-এর মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তন প্রধান সুধীর খান্ডেলওয়াল বলছেন, ‘‘এখন পর্যন্ত যা যা তথ্য মিলেছে তার ভিত্তিতে বলা যেতে পারে, মহিলারা নিজেরাই নিজেদের চুল কাটছেন৷ জ্ঞাতসারে বা কোনো ঘোরের মধ্যে৷ অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করা অথবা অবদমিত ইচ্ছে প্রকাশের জন্যই হয়ত এই পন্থা অবলম্বন করছেন তাঁরা৷’’
আবার মনোবিজ্ঞানীরা এ-ও বলছেন, ‘‘দিল্লি ‘গণ হিস্টিরিয়ার’ শহর৷ পূর্বে এর ইতিহাস রয়েছে৷ গুজবে গা-ভাসানোর ঘটনা কম ঘটেনি এখানে৷ এটা তার নয়া সংযোজন৷’’
তবে এবার এই ‘গুজব’-এর পেছনে কে বা কারা যুক্ত, তার কিছুই ঠাহর করতে পারছে না পুলিশ৷ ঝড়ের বেগে ছড়িয়ে পড়ছে নানা রকম রটনা৷ স্বভাবতই আতঙ্ক তাড়া করে বেড়াচ্ছে সাধারণ মানুষকে৷ আর এরই সুযোগ নিয়ে কিছু লোক ডাইনি, জড়িবুটি ও তুকতাকের পিছনে ছুটতে শুরু করেছেন৷
প্রিয় পাঠক, আপনি কিছু বলতে চাইলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে...