1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

রাজনীতির খেলা বন্ধ হোক, চাই সত্যিকারের অভিভাবক

শামীমা নাসরিন
শামীমা নাসরিন
২৮ জানুয়ারি ২০২২

একাডেমিকভাবে তুখোড়, প্রশাসনিক কাজে দারুণ দক্ষ বা শিক্ষার্থীপ্রিয় শিক্ষক নন বরং দলীয় আনুগত্য এখন বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য নিয়োগে প্রধান যোগ্যতা হয়ে উঠেছে৷

https://p.dw.com/p/46Due
উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন
(সাম্প্রতিক ছবি) উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনছবি: bdnews24.com

কয়েক দশক ধরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়োগ পাওয়া উপাচার্যদের তালিকা দেখলেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠে৷ ওই তালিকায় ক্ষমতাসীন দলের আশীর্বাদপুষ্ট শিক্ষকেরাই অবস্থান করছেন৷ নিয়োগ পেয়েছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য পদে৷

অরাজনৈতিক এ পদটি যেন অঘোষিত রাজনৈতিক পদে পরিণত হয়েছে৷ সরকারকে সন্তুষ্ট করে যেহেতু পদটি পাচ্ছেন, তাই উপাচার্যরা ভয়ডরহীনভাবে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন৷ তারা জানেন, স্বয়ং সরকার তাদের রক্ষা করবে৷

বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতি বা শিক্ষার্থীদের আস্থাভাজন হওয়ার চাইতে উপাচার্যরা তাই সরকারের তোষামদে বেশি ব্যস্ত থাকছেন৷ এটাকে তারা চেয়ার বাঁচানোর সহজ পথ ভাবছেন৷

ক্ষমতাসীনরাও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রশাসনিক পদে নিজেদের মতাদর্শের মানুষদের নিয়োগ দিচ্ছে৷ কে দলের প্রতি কতটা আনুগত্য প্রমাণ করতে পেরেছেন তার ভিত্তিতে পদ পাচ্ছেন, এক্ষেত্রে দক্ষতা ও নৈতিকতাবোধকে বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে না৷ সত্যিকারের যোগ্যরা রাজনীতির এই পিচ্ছিল খেলায় হয় নিজেদের জড়াচ্ছেন না নতুবা পেরে উঠছেন না৷

ক্লাস ফেলে মিটিং-মিছিল করে বেড়ানো, শিক্ষক হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন না করে নানা জায়গায় আদর্শের বুলি আউড়ে বেড়ানোরাই এই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ প্রসাশনিক পদে আসীন হচ্ছেন৷ বিশ্ববিদ্যালয়কে বানিয়ে ফেলছেন বাণিজ্যশালা৷ স্বেচ্ছাচারিতার চরমে উঠে শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয় বরং পুরো দেশের সম্মান ক্ষুন্ন করছেন৷ 

গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছেন৷ যে তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি)৷ সেখানে উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আমরণ অনশন পর্যন্ত করেছেন৷

অথচ, আপাত দৃষ্টিতে ছোট একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল৷ উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন চাইলে শুরুতেই পরিস্থিতি সামাল দিতে পারতেন৷ কিন্তু তিনি তা না করে ক্ষমতার দম্ভ দেখালেন৷ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পুলিশ ডেকে শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা, গুলি বর্ষণ, সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ার মতো ঘটনা ঘটালেন৷

অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন ২০১৩ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত টানা চারবার আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্যানেল নীল দল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন৷ তাকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দিতে এই যোগ্যতাকেই কি সবচেয়ে বড় করে দেখা হয়েছে? না হলে তার তো এমনকি কোনো পিএইচডি ডিগ্রিও নেই৷

বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত হতে শিক্ষকদের সংগঠনগুলোর সদস্য হওয়া, রাজনৈতিক দল সমর্থিত নীল-সাদা-হলুদ দলের নেতা হওয়া এবং পুরস্কার হিসেবে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্যের পদ পাওয়া, এ যেন এখন এক সরল সমীকরণে পরিণত হয়েছে৷

ফরিদ উদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষার্থীরা যখন আমরণ অনশনে নেমে অসুস্থ হয়ে একে একে হাসপাতালে যাচ্ছেন৷ তখন সরকার থেকে বলা হচ্ছে, তার পদত্যাগের দাবি ‘অযৌক্তিক'৷ তার বিরুদ্ধে নাকি অনিয়ম ও দুর্নীতির ‘সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই'৷

ফরিদ উদ্দিনের নিয়োগের বিষয়ে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকার শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেছেন, ‘‘সরকারের রাজনৈতিক স্বার্থ বিরোধী কোনো ব্যক্তিকে যদি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ করা হয় তাহলে সেখানে শৃঙ্খলা বজায় রাখা কঠিন হয়ে যায়৷”

মোদ্দাকথা, একজন উপাচার্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক৷ পাশাপাশি তিনি শিক্ষার্থীদেরও অভিভাবক৷ সেই অভিভাবকই যখন নিজ ক্যাম্পাসে পুলিশ ডেকে নিজের সন্তানসম শিক্ষার্থীদের পেছনে লেলিয়ে দেন তখন তিনি কি আসলেই আর অভিভাবক থাকার যোগ্যতা রাখেন?

একই কাণ্ড আমরা জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য ড. ফারজানা ইসলামের বেলাতেও দেখেছি৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পে বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ ২০১৯ সালে তার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা প্রায় দুই মাস ধরে আন্দোলন করেছিল৷ আন্দোলন দমনে সেখানেও পেশীশক্তিরই ব্যবহার হয়েছে৷ তখনও ক্ষমতাসীনরা শিক্ষার্থীদের নয় বরং উপাচার্যের পক্ষ নেয়৷ এখনো পদে বহাল ড. ফারজানা ইসলাম৷

ওই বছর গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য খোন্দকার নাসিরউদ্দিনকে নিয়েও কম হট্টগোল হয়নি৷ ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ তুলে তার পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন হয়৷ তার বিরুদ্ধে এমনকি দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সহায়তার জন্য গড়া দুর্যোগ ও ছাত্র কল্যাণ তহবিলের টাকা এমন সব খাতে খরচ করার অভিযোগ ছিল যেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন শিক্ষকরাও৷

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন-ইজিসি নাসিরউদ্দিনের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম, দুর্নীতি ও নৈতিকস্খলনের অভিযোগ তদন্ত করে তার দোষ পায় এবং তাকে উপাচার্যের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার সুপারিশ করে৷ পরে রাতের অন্ধকারে পুলিশি পাহারায় ক্যাম্পাস ছাড়েন নাসিরউদ্দিন৷

একই বছর পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য এম রোস্তম আলী বিরুদ্ধে ‘ঘুস নিয়ে শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার' অভিযোগ ওঠে৷ তার ‘ঘুস নেওয়ার অডিও’ ছড়িয়ে পড়ার পর তদন্তের দাবিতে বিক্ষোভে নামে শিক্ষার্থীরা৷

উপাচার্যদের এতসব কাণ্ডের কোনটিই একজন শিক্ষককে শোভা পায় না৷ এ সব অপকর্ম তো আসলে কোনো মানুষকেই শোভা পায় না৷ দুর্নীতিতে আকণ্ঠ ডুবে থাকা এসব উপাচার্যরা কিভাবে সুষ্ঠুভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করবেন৷

ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আলমগীর বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, ইউজিসি গত তিন বছরে ১২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম এবং দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে তদন্ত করেছে৷

বাংলাদেশে বর্তমানে ৫২টির মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে৷ তারমধ্যে ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগে নির্দিষ্ট আইন আছে৷ তারা ১৯৭৩ অ্যাক্ট (ঢাকা) অনুযায়ী চলে৷ ওই অ্যাক্টে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের অধ্যাদেশ ১১ (১) ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, উপাচার্য পদের জন্য সিনেট থেকে প্রথমে তিন জনকে নির্বাচিত করে তাদের নামের তালিকা আচার্যের (রাষ্ট্রপতি) ‍কাছে পাঠানো হবে এবং আচার্য সেই তিনজনের মধ্যে একজনকে চার বছরের জন্য উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেবেন৷ উপাচার্য হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে অবশ্যই দ্বিতীয় মেয়াদে চার বছরের জন্য দায়িত্ব পালন করার উপযুক্ত হতে হবে৷

কিন্তু ১৯৮৬ সালের ২৫ অগাস্ট অধ্যাদেশে আসা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১ (১) ধারায় ‘সিনেট' শব্দটিকে বাইরে রেখে বলা হয়, উপাচার্য আচার্য কর্তৃক নির্ধারিত শর্তে চার বছরের জন্য নিযুক্ত হবেন৷ সেখানে উপাচার্য কোথা থেকে আসবেন সে বিষয়ে কিছু বলা হয়নি৷

খুলনা এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের ধারায়ও প্রায় একই ধরনের বাক্য লেখা আছে৷ নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও একই পথে হেঁটেছে৷

উপাচার্য কোথা থেকে আসবেন সে বিষয়ে সুস্পষ্ট নীতিমালা না থাকার কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে ‍অনেক বিতর্কের সৃষ্টি হচ্ছে৷

DW-Mitarbeiterin Shamima Nasrin
শামীমা নাসরিন, সাংবাদিকছবি: privat

গত প্রায় তিন দশক ধরে উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিচয়ই প্রাধান্য পাচ্ছে৷ সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও সরকার মনোনীত ব্যক্তিদের সরাসরি উপাচার্য পদে নিয়োগ পেতে দেখা যাচ্ছে৷

বাংলাদেশে অপেক্ষাকৃত নবীন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য পদে নিয়োগপ্রাপ্তরা অন্যকোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যান এবং তারা অবশ্যই ক্ষমতাসীনদের মদদপুষ্ট থাকেন৷

সরকারের কাছে অবশ্য তাদের এ কাজের ব্যাখ্যা আছে৷ তারা বলেন, পুরনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যাওয়া অধ্যাপকরা অপেক্ষাকৃত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের দায়িত্ব নিয়ে নিজেদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ভালোভাবে পরিচালনা করবেন৷

কিন্তু গত তিন বছরে ‘অভিজ্ঞৎ ওই শিক্ষকদের যা কাণ্ডকীর্তি দেখছি তাতে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় ‍তাদের ‘দক্ষতা' নিয়ে বড়সড় প্রশ্ন উঠেছে৷ না হলে একজন হল প্রভোস্টের পদত্যাগের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন দক্ষ হাত সামাল দিতে না পারায় আজ তা উপাচার্যের পদত্য‍াগের দাবিতে একদফা আন্দোলনে পরিণত হয়ছে৷

উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ আসলেই পদত্যাগ করবেন কিনা তা সময়ই বলে দেবে৷ বাতাসে ভাসছে তিনি হয়তো পদত্যাগ করবেন৷ কিংবা ছুটি বা অন্য কিছু দেখিয়ে তাকে সরিয়ে দেয়া হতে পারে৷

অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন সরে গেলে নতুন যিনি উপাচার্য হয়ে আসবেন৷ তিনিও সরকারের পছন্দের প্রার্থীই হবেন৷ শিক্ষার্থীদের অভিভাবক হয়ে না উঠে তিনিও হয়তো ক্ষমতার দম্ভ দেখিয়ে সবাইকে শায়েস্তা করতে চাইবেন৷

বাংলাদেশে অনেক অধ্যাপক আছেন যারা একাডেমিকভাবে তুখোড়৷ তাদের কেউ কেউ নীতি-নৈতিকতার প্রশ্নেও অনড়৷ শিক্ষার্থীরা তাদের ভালোবাসেন, চোখ বন্ধ করে তাদের উপর আস্থা রাখতে পারেন৷ দলীয় আনুগত্য দিয়ে নয় বরং সবার আস্থাভাজন কাউকে উপাচার্য নিয়োগ দিন৷ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মানুষ গড়ার ক্ষেত্র হয়ে উঠুক৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান