1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মেজাজ হারাচ্ছেন মমতা

শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতা
৩১ মে ২০১৯

‘‌জয় শ্রী রাম’ ধ্বনি শুনলেই ক্ষেপে যাচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি৷ রাজ্যে নিজেদের প্রভাব বাড়াতে তৎপর বিজেপির যদি এটাই অন্যতম রণকৌশল হয়, তাহলে তারা সফল৷

https://p.dw.com/p/3JX4Q
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman

রাজ্যে বিজেপির অভূতপূর্ব নির্বাচনি সাফল্যের আগেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর ‘‌জয় শ্রী রাম’ ধ্বনির প্রতি এই তীব্র বিরাগ দেখা গিয়েছিল৷ মেদিনীপুরের ঘাটালে নির্বাচনি প্রচারে গিয়েছিলেন তিনি৷ রাস্তা দিয়ে তাঁর গাড়ির কনভয় যাওয়ার সময় একদল লোক ‘‌জয় শ্রী রাম’ বলে চেঁচিয়েছিল৷ গাড়ি থামিয়ে নেমে এসে তেড়ে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী৷ তখনকার মতো লোকগুলি পালালেও পরে বিজেপি তাদের খুঁজে বের করে এবং রীতিমতো সম্বর্ধিত করে৷ দুজনের মালা-পরা ছবি বিজেপির আইটি সেল ছড়িয়ে দেয় সোশাল মিডিয়ায়৷ এবং সম্ভবত সেই ঘটনা থেকেই বিজেপি বুঝে নিয়েছিল, মমতা ব্যানার্জিকে উত্যক্ত করার সহজতম উপায় কী!‌

রাজ্যে দুটিমাত্র লোকসভা আসন থেকে এবার ১৮টি আসন পেয়ে যাওয়ার পর বিজেপি স্বাভাবিকভাবেই তাদের রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি আরো বিস্তৃত করতে চাইছে৷ লোকসভা ভোটের ফল বেরোবার পর থেকেই শুরু হয়ে গেছে তৃণমূল কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পালা৷ ভাঙন ধরেছে তৃণমূল কংগ্রেসের দাপুটে নেতা অনুব্রত মন্ডলের খাসতালুক বীরভূম জেলায়৷ সেখানে তৃণমূলের প্রাক্তন বিধায়ক গদাধর হাজরা, যুব সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মহম্মদ আসিফ ইকবাল, যিনি আবার জেলায় তৃণমূলের সংখ্যালঘু মুখও বটে এবং আরেক নেতা নিমাই দাস নিজেদের দলবল নিয়ে যোগ দিয়েছেন গেরুয়া শিবিরে৷ দিল্লি গিয়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন বীরভূমের তৃণমূল বিধায়ক, বরাবরের সুযোগসন্ধানী মনিরুল ইসলাম৷ একদা বাম বিধায়ক মনিরুল রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকারের পতনের পর তৃণমূল কংগ্রেসের টিকিটে ভোটে জিতে নিজের বিধানসভা আসনটি ধরে রেখেছিলেন৷ এবার পরিস্থিতি বুঝে চলে গেলেন বিজেপিতে৷ আর এই দলবদলের আগের দিনই হুগলির বীজপুরের তৃণমূল বিধায়ক শুভ্রাংশু রায়, যিনি দলত্যাগী মুকুল রায়ের ছেলে, অন্তত ৫০ জন অনুগামী পৌর কাউন্সিলরকে নিয়ে যোগ দিয়েছেন বিজেপিতে, যার ফলে কমপক্ষে চারটি পুরসভা তৃণমূলের হাতছাড়া হতে চলেছে৷ শুভ্রাংশু ছাড়াও আরেক তৃণমূল বিধায়ক তুষারকান্তি ভট্টাচার্য এবং সিপিএম বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ রায় এদিন যোগ দেন বিজেপিতে৷ তারপর বিজেপির নেতারা খোঁচা মেরে বলেছেন, এবার যেমন সাত দফায় ভোট হলো, পশ্চিমবঙ্গেও সাত দফায় শাসকদলের অধিকাংশ নেতা-কর্মী এসে যোগ দেবেন বিজেপিতে৷

এসব শুনে স্বাভাবিক কারণেই ক্ষিপ্ত মমতা ব্যানার্জি নেমে পড়েছেন হারানো রাজনৈতিক জমি পুনরুদ্ধারে৷ হুগলি লোকসভা কেন্দ্রে জিতে গেছেন রাজ্যে বিজেপির মহিলা মোর্চার নেত্রী লকেট চ্যাটার্জি৷ জেলায় তৃণমূলের আরেক দলত্যাগী নেতা অর্জুন সিং এবার বিজেপির টিকিটে ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রে জিতেছেন৷ ফলে জেলার তৃণমূল কংগ্রেস কর্মীদের ওপর চাপ বাড়ছে৷ অনেক কর্মী ভয়ে ঘরছাড়া, অনেক জায়গায় তৃণমূলের পার্টি অফিস বিজেপি দখল করে নিয়েছে খবর পাওয়ার পর বৃহস্পতিবার মমতা নিজে নৈহাটি এলাকায় যাবেন বলে ঘোষণা করেন, যদিও নিরাপত্তার কারণে গোপন রাখা হয়েছিল মুখ্যমন্ত্রীর কনভয়ের যাত্রাপথ৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত অর্জুন সিংয়ের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়েই যেতে হয় মুখ্যমন্ত্রীকে৷ যাওয়ার পথে জগদ্দল এবং নৈহাটির মাঝে তিন জায়গায় চটকলের গেটে দাঁড়ানো বিজেপির পতাকা নিয়ে দাঁড়ানো শ্রমিকরা মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ি দেখেই ‘‌জয় শ্রী রাম’ স্লোগান দিতে থাকে৷ ধৈর্য হারান মমতা৷ ভাটপাড়ার রিলায়েন্স জুট মিলের সামনে তিনি নেমে আসেন গাড়ি থেকে এবং তেড়ে যান৷ রীতিমতো গালিগালাজ করেন বিজেপি কর্মীদের, যারা নাকি তাঁর কনভয়ের রাস্তা আটকানোর চেষ্টা করেছিল বলে অভিযোগ৷ এর পর আরো দু'‌বার একই ঘটনা ঘটে৷ টিভি চ্যানেলের দৌলতে এ ঘটনার ভিডিও প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ছড়িয়ে পড়ে সংবাদ মাধ্যমে এবং সোশাল মিডিয়ায়৷

ফলে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিরোধী রাজনৈতিক দলের সমর্থক চটকল-কর্মীদের ঠিক কী বলেছেন, গোপন রাখা যায়নি৷ এক জায়গায় তিনি বলে বসেন, ‘‘‌আমাদেরই খাবে, আমাদেরই পরবে (‌আর বিজেপিকে সমর্থন করবে)‌!‌’’ বলেছেন, ‘‘‌এরা কেউ বাঙালি নয়৷ সব বাইরের লোক৷’’ বলেছেন, ‘‘‌সব বন্ধ করে দেবো৷ একদিনে সব গুটিয়ে চলে যেতে হবে৷’’ অর্থাৎ চটকল বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী, যে রাজ্যে ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারের মহাপতনের অন্যতম কারণ ছিল বন্ধ কল-কারখানা, যে রাজ্যে এখনো বলার মতো কোনো বড় শিল্প হয়নি, বিনিয়োগ আসেনি৷ এবং বাঙালি-অবাঙালি, স্থানীয়-বহিরাগতর বিভাজনও করেছেন মুখ্যমন্ত্রী, যে অভিযোগ তিনি বিজেপির বিরুদ্ধে হামেশাই করে থাকেন৷ ফলে সাধারণ মানুষ, মুখ্যমন্ত্রীর এই উত্তেজিত প্রতিক্রিয়াকে ভালোভাবে নেয়নি৷ প্রশ্ন উঠে গেছে, যিনি আসামে নাগরিক সংশোধন তালিকা, অর্থাৎ, বিতর্কিত এনআরসির কট্টর বিরোধী, তিনি কী করে বলেন, বহিরাগত অবাঙালিদের রাজ্য থেকে বের করে দেওয়ার কথা!‌

Porträt - Sirsho Bandopadhyay
শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতাছবি: privat

এদিকে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দেওয়ার অভিযোগে ভাটপাড়া এলাকা থেকে ১০ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ৷ বদলি করা হয়েছে জগদ্দল থানার আইসি চন্দ্রশেখর দাসকেও৷

বস্তুত বিজেপি এখন চাইছে মুখ্যমন্ত্রীকে লাগাতার উত্যক্ত করে উত্তেজিত করতে, যাতে তিনি এ ধরনের মন্তব্য করে বসেন, যা তাঁর বিরুদ্ধেই কাজে লাগানো যায়৷ মমতার মন্ত্রীরাও যে সবসময় ঠিক কথা বলছেন, তা নয়৷ গত দু'‌দিনে তৃণমূল বিধায়ক, কাউন্সিলরদের দলত্যাগ প্রসঙ্গে মমতার অতি বিশ্বস্ত, রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম টিভি ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছেন, ‘‘জাহাজ যখন ঝড়ের মুখে পড়ে টলমল করে, সবার আগে পালায় ইঁদুর৷ কিন্তু তারা বোঝে না যে, তারা জাহাজ থেকে সমুদ্রে ঝাঁপ দিচ্ছে৷’’

যদিও চিরকালীন প্রবাদবাক্যটি একটু বদলে নিয়ে বলেছেন ফিরহাদ হাকিম, কিন্তু আসল কথাটা সবারই মনে পড়ে গেছে৷ জাহাজ যখন ডোবে, সবার আগে টের পেয়ে পালায় ইঁদুরেরা৷ দলত্যাগী নেতাদের তুচ্ছ করার জন্য তিনি ইঁদুর বলতেই পারেন, কিন্তু জাহাজ যে ডুবছে, প্রকারান্তরে সেটা স্বীকার করে নেওয়ার মধ্যেই বা কী বিচক্ষণতা, বা তৃণমূল কংগ্রেস কর্মীরা কথাটা শুনে আদৌ কতটা পুনরুজ্জীবিত হবে, সেটা লোকে বুঝতে পারছে না৷ বিশেষত যখন হাওয়ায় কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে, তৃণমূলের অনেক নেতা-কর্মী বিজেপিতে যাওয়ার জন্যে পা বাড়িয়েই আছেন!