1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মুখোশ আর ছৌ নাচের গ্রাম

পায়েল সামন্ত কলকাতা
২৭ ডিসেম্বর ২০১৮

রাস্তার দু'ধারে সারি সারি মুখোশের দোকান৷ সাধারণ মুখোশ নয়, ছৌ নাচের মুখোশ৷ ছৌ নাচ আর মুখোশের জন্যই সুপরিচিত পাহাড়ের কোলে সুন্দর-শান্ত গ্রাম চড়িদা৷

https://p.dw.com/p/3Ahgs
Indien Handwerkskunst in Chorida village | Chhau mask shop in Chorida
ছবি: DW/P. Samanta

ছৌ নাচের সাজসজ্জায় প্রধান উপকরণ মুখোশ৷ রংবেরঙের মুখোশ তৈরির জন্য প্রসিদ্ধ পুরুলিয়ার চড়িদা৷ এই গ্রামের মুখোশ শিল্পীদের সবাই এখন কেমন আছেন?

ভারতের সীমা পার করে আন্তর্জাতিক স্তরে খ্যাতি পেয়েছে পুরুলিয়ার ছৌ নাচ৷ গ্রামের গরিবগুর্বো মানুষের নিজস্ব এই নৃত্যশৈলী হয়ে উঠেছে গবেষণার বিষয়৷ ছৌ নাচের দর্শকদের সবার আগে যে বিষয়টি নজর কাড়ে, সেটি হলো শিল্পীদের সাজ৷ এই সাজের প্রধান উপকরণ মুখোশ৷ বিভিন্ন মুখোশ পরে শিল্পীরা মঞ্চে হাজির হন৷ মূলত পৌরাণিক কাহিনীর উপর নির্ভর করে তৈরি হওয়া ছৌ নাচের পালায় কখনো সেই মুখোশ হয় দুর্গা-মহিষাসুরের, কখনো বা রাম-লক্ষ্মণ-সীতার৷ পশ্চিমবঙ্গের মতো ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশার ময়ূরভঞ্জের ছৌ বিখ্যাত৷ কিন্তু, ময়ূরভঞ্জে মুখোশ ব্যবহার করা হয় না৷ মুখোশের জন্য পুরুলিয়ার ছৌ বিশিষ্টতা পেয়েছে বৈকি৷ এই মুখোশই তৈরি হয় পুরুলিয়ার গ্রাম চড়িদায়৷

কিশোর সূত্রধর

অযোধ্যা পাহাড়ের কোলে সুন্দর-শান্ত গ্রাম চড়িদা৷ একসময় মাওবাদী উপদ্রুত বাঘমুণ্ডি থানার অধীন এই এলাকা এখন স্বাভাবিক ছন্দে ফিরেছে৷ গ্রামে ঢোকার পথেই রাস্তার দু'ধারে ছৌ মুখোশের সারি সারি দোকান৷ শুধু দোকান বললে ভুল হবে, এগুলি একাধারে শিল্পালয়৷ এখানে বসেই দিন-রাত মুখোশ তৈরির কাজ করেন শিল্পীরা৷ এই গ্রামের বাসিন্দাদের জীবিকা বলতে এই একটাই— ছৌ মুখোশ তৈরি৷ তাঁদের তৈরি মুখোশ শুধু নাচেই ব্যবহৃত হয় না, এখন দেশ-দেশান্তরের সুসজ্জিত ড্রইংরুম আলো করে থাকে চড়িদার মুখোশ৷ পুরুলিয়ায় ছৌ দলগুলি এই গ্রাম থেকেই সারা বছরের প্রয়োজনীয় মুখোশ সংগ্রহ করে৷

সার দেওয়া শিল্পালয়ের দাওয়ায় বসে শিল্পীরা শীতের রোদ মেখে কাজ করছিলেন৷ বড়দের সঙ্গে হাত লাগিয়েছে ছোটরাও৷ এখানকার অন্যতম বড় শিল্পালয় সুচাঁদ মুখোশঘর-এর এ প্রজন্মের কর্ণধার কিশোর সূত্রধরকে পাওয়া গেল৷ কাগজ, কাপড়, মাটির প্রলেপে রঙের তুলি বুলিয়ে মুখোশকে জীবন্ত করে তোলেন কিশোররা৷ তুলি না থামিয়ে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পুরুলিয়ার প্রায় শ-দেড়েক ছৌ দল আমাদের কাছ থেকে মুখোশ নেয় প্রতি বছর৷ আমাদের তৈরি মুখোশ দিয়ে ৬০-৭০টি নাইট ছৌয়ের পালা হেসেখেলে অভিনয় করা যায়৷ প্রতি বছর একটি দল এর থেকে বেশি পালাও করে৷'' এখন শহরের ঘেরা মঞ্চে ছৌ প্রদর্শন হলেও গ্রামীণ এলাকায় মুক্ত মঞ্চেই এই পালা উপস্থাপিত হয়৷ ছৌ নাচের অন্যতম বৈশিষ্ট্য শারীরিক কসরত৷ এর ফলে মেঠো মঞ্চ থেকে ধুলো ওড়ে৷ তাতে মুখোশ নষ্ট হতে থাকে৷ একটা মরশুমের বেশি চালানো যায় না৷ এই মুখোশের দাম কত? কিশোর জানান, দল যেমন চায় সেই দামে তৈরি করা হয়৷ চার হাজার হতে পারে, ছয় হাজারও৷ কী দিয়ে মুখোশ তৈরি হচ্ছে তার উপর দাম নির্ভর করে৷

সজল দত্ত

মাওবাদী উপদ্রব শুধু নয়, একসময় রোজগারের অভাবে ছৌ নৃত্য সঙ্কটে পড়েছিল৷ দলের সংখ্যা ক্রমশ কমে আসছিল৷ এর ফলে মুখোশ বিক্রিতে ভাটা পড়েছিল৷ পরিস্থিতি অনেকটা বদলেছে রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্তে৷ এখন ছৌ শিল্পীদের মাসিক এক হাজার টাকা করে ভাতা দেওয়া হয়৷ এই অর্থের একাংশ তাঁদের দল চালানোর পুঁজি হিসেবে কাজ করছে৷ এখন ছৌয়ের দল বেড়েছে৷ ফলে বেড়েছে মুখোশের চাহিদাও৷ কিশোরের বাবা দ্বিজেন সূত্রধর বলেন, ‘‘বছরে লাখ দেড়েক টাকা খরচ লাগে একটি দলের সাজসজ্জা বাবদ৷ শুধু মুখোশ নয়, তার সঙ্গে পোশাকও আছে৷ এই টাকা জোগাড় করা মুশকিল হতো৷ ভাতা মেলায় শিল্পীদের সেই সমস্যা মিটেছে৷''

একটা সময় ছৌ দলের শিল্পীদের জন্য মুখোশ তৈরিই একমাত্র কাজ ছিল চড়িদার মানুষদের৷ কিন্তু ছৌ জনপ্রিয়তা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এর মুখোশের চাহিদা বাড়তে লাগল৷ এর ফলে চড়িদার অনেক শিল্পালয়ে এখন ঘর সাজানোর মুখোশ তৈরি হচ্ছে৷ এগুলি স্বাভাবিকভাবেই নাচের মুখোশের থেকে অনেক ছোট ও কম দামি৷ এই গ্রামে নিত্য পর্যটকদের আনাগোনা লেগে থাকে৷ তাঁরাই সফরের স্মৃতি হিসেবে এই মুখোশ সংগ্রহ করে নিয়ে যান৷ এর ফলে এখানকার গড়পরতা শিল্পীদের আর্থিক অবস্থা উন্নত হয়েছে৷ প্রবীণ শিল্পী সজল দত্ত একটি মুখোশে নীল রং করছিলেন৷ তাতে চোখ রেখেই ডয়চে ভেলের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আমি আগে গ্রামের ভিতর বাড়িতে এই কর্মশালা চালাতাম৷ কিন্তু সড়কের উপর দিয়ে পর্যটকরা যাতায়াত করেন বলে এখানে বিক্রি বেশি৷ সদ্য এখানে দোকান খুলেছি৷ ভালোই হচ্ছে বিক্রিবাটা৷''

ঝর্ণা্ সূত্রধর

এখন মুখোশ বিপণনের ব্যবস্থাও প্রসারিত হয়েছে৷ যদিও বাজারের অভাব পুরোপুরি দূর হয়নি৷ পুরুলিয়া জেলা প্রশাসনের ই-গ্রামীণ হাটের মাধ্যমে অনলাইনে মুখোশ কেনার ব্যবস্থা থাকলেও ছৌ নাচের দলগুলি এখনো চড়িদা আসে মুখোশ কিনতে৷ ছৌ শিল্পী জগন্নাথ চৌধুরী তাঁর নিজের দলের জন্য মুখোশ কিনতে এই গ্রামে যেতে পছন্দ করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘শিল্পীদের মুখের মাপের সঙ্গে মিলিয়ে মুখোশ কিনতে হয়৷ তাই অনলাইনে কেনা যায় না৷ তাই চড়িদা যেতেই হয়৷'' ২০১৪ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গ খাদি ও গ্রামীণ শিল্প পর্ষদ ও রুরাল ক্রাফ্ট হাবস অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল-এর যৌথ উদ্যোগে চড়িদায় ছৌ মুখোশের মেলা হচ্ছে৷ আয়োজনে চড়িদা ছৌ মুখোশ শিল্পী সূত্রধর সমিতি ও বাংলা নাটক ডট কম৷ এই সংস্থার তরফে অমিতাভ ভট্টাচার্য ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শুধু শিল্পের প্রচার হলেই শিল্পী বাঁচে না৷ গ্রাম, শিল্পী ও শিল্প এই তিনটের একটি ইউনিট হিসেবে প্রচার ও প্রসার করতে হবে৷ আগে ছৌ নাচের ২০টি দল ছিল৷ তা থেকে আজ ৩০০ দল হয়েছে৷ তেমন ভাবেই যে ছৌ মুখোশ শিল্পটা ধুঁকছিল, তা চাঙ্গা হয়েছে৷ এর ফলে এই শিল্প নির্ভর গ্রামে অর্থনীতিও পাল্টেছে৷''

অমিতাভ ভট্টাচার্য

চড়িদায় শ'-খানেক পরিবার ছৌ মুখোশ তৈরি করে৷ শিল্পীর সংখ্যা ৩০০-র মতো৷ কোনো পরিবার শুধু ঘর সাজানোর ছোট মুখোশ, কোনোটি আবার দু-ধরনেরই মুখোশ বিক্রি করে৷ মোটের উপর পরিস্থিতি একটু ভালো হলেও সবার ঘরে যে হাসি ফুটেছে, এমন নয়৷ সুচাঁদ মুখোশঘরের বিপরীত দিকে একটি দোকান দেখে তেমনটাই মনে হচ্ছিল৷ ঝর্না সূত্রধরের পরিবার এই দোকানটি চালায়৷ দশ বছরের মেয়ে, ছয় বছরের ছেলে তাঁকে এ কাজে সাহায্য করে৷ কাজে হাত লাগান তাঁর শাশুড়িও৷ ৩০ থেকে ১৩০ টাকা, এই সামান্য দামে এক-একটি মুখোশ বিক্রি করেন তিনি৷ ঝর্না বলেন, ‘‘পর্যটকরা শীতের মরশুমে এসে কেনাকাটা করলে কিছুটা উপকার হয়৷ মাসে হাজার দুয়েক টাকা  এই সময় রোজগার করি৷ এই টাকা জমিয়ে সারা বছর চালাতে হয়৷ আজ ঘরে সামান্য টাকা রয়েছে, কাল বিক্রি না হলে মুশকিলে পড়ব৷''

এই বক্তব্যই প্রমাণ করছে, ছৌ নাচের কিংবদন্তি শিল্পী পদ্মশ্রী প্রাপ্ত গম্ভীর সিং মুড়ার গ্রাম চড়িদায় অভাব একেবারে মুছে যায়নি৷ মুখোশ শিল্পীরা তাই দাবি তুলছেন, রাজ্য সরকার তাঁদের কথা একটু ভাবুক৷ দ্বিজেন সূত্রধরের বক্তব্য, ‘‘ছৌ শিল্পের অঙ্গ আমরাও৷ কিন্তু, ছৌ শিল্পীদের ভাতা আছে, আমাদের নেই৷ আমাদের জন্যও ভাতার ব্যবস্থা করা হোক৷ এ ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানানো হয়েছে৷''

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য