মারাদোনা, তোমারে সেলাম
চলে গেলেন ফুটবলের মহারাজা ও জাদুকর দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা। মাত্র ৬০ বছর বয়সে। রেখে গেলেন অসংখ্য ভক্ত। আর ভিডিওতে ধরা রইল ফুটবল মাঠে কিংবদন্তী হয়ে যাওয়া তাঁর ড্রিবল, পাস, গোল।
গরিব পরিবারের হীরে
আর্জেন্টিনায় ১৯৬০ সালের ৩০ অক্টোবর জন্ম মারাদোনার। চার মেয়ের পর বাবা-মায়ের প্রথম ছেলে। পরে তাঁর আরো দুই ভাই হয়েছিল। তাঁর পরিবার ছিল গরিব। কষ্টের মধ্যে বড় হতে হয়েছে মারাদোনাকে।
আট বছর বয়সে
তাঁর ফুটবল প্রতিভা চেনা গিয়েছিল মাত্র আট বছর বয়সে। সেই সময় একটি ক্লাবের খেলায় মারাদোনাকে দেখে একজন ট্যালেন্ট স্কাউট তাঁকে চিহ্নিত করেন। তারপর বুয়েনস আইরেসের আর্জেন্টিনা জুনিয়ার্স দলের ছোটদের টিমে নিয়মিত সদস্য হন তিনি। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি মারাদোনাকে।
তখনও ১৬ হয়নি
মারাদোনার বয়স তখনো ১৬ হয়নি। দশ দিন বাকি। ১৯৭৬ সালে তিনি প্রবেশ করলেন পেশাদার ফুটবলের জগতে। আর্জেন্টিনা জুনিয়ার্স-এর হয়ে মাঠে নামলেন ১৬ নম্বর জার্সি গায়ে। আর্জেন্টিনার প্রিমিয়ার লিগের ইতিহাসে সব চেয়ে কম বয়সী ফুটবলার হিসাবে। পরে মারাদোনা বলেছিলেন, ''সেদিন মনে হয়েছিল, যেন আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছি।''
পাঁচ বছর পর বোকা জুনিয়ার্স
আর্জেন্টিনা জুনিয়ার্সে পাঁচ বছর ছিলেন মারাদোনা। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮১। ১৬৭ ম্যাচ খেলে ১১৫ গোল করেছিলেন। তারপর ৪০ লাখ ডলার নিয়ে বোকা জুনিয়ার্সে। এখানে খেলবেন বলে রিভার প্লেটের অফার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। যোগ দেয়ার দুই দিনের মধ্যে ম্যাচে নেমে দুই গোল করেন। রিভার প্লেটের বিরুদ্ধে সুপার ক্ল্যাসিকোয় এক গোল দেন।
এ বার বার্সেলোনা
এক বছর পর ১৯৮২-র বিশ্বকাপ শেষ হলে মারাদোনা যোগ দেন স্পেনের বার্সেলোনায়। রেকর্ড ফি নিয়ে। মাঠে ফুটে উঠলো ফুটবলের জাদুকর মারাদোনার শিল্প। বার্সেলোনা তখন অপ্রতিরোধ্য। রিয়েল মাদ্রিদের বিরুদ্ধে সুপার ক্ল্যাসিকোতে স্কিল দেখালেন মারাদোনা। মাদ্রিদের কোচ মারাদোনার প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছিলেন গণমাধ্যম।
অসুখ, আঘাত ও সংঘাত
বার্সেলোনায় থাকার সময় প্রথমে তাঁর হেপাটাইটিস হয়। তারপর লা লিগার ম্যাচে গোলকিপারের সঙ্গে সংঘর্ষে পা ভাঙে। আর ১৯৮৩-৮৪ সিজনের শেষদিকে হলো তাঁর বিখ্যাত ঢুঁ। বিলবাও-এর সঙ্গে ম্যাচ। মারাদোনাকে বারবার মারা হচ্ছিল। জাতিগত গালাগালি দেয়া হচ্ছিল। এক সময় মেজাজ হারিয়ে তিনি একজন প্লেয়ারকে ঢুঁ মেরেছিলেন, একজনকে কনুই দিয়ে আঘাত করেছিলেন। সেটাই ছিল বার্সেলোনার জার্সিতে তাঁর শেষ ম্যাচ।
নাপোলিতে দক্ষতার শীর্ষে
বার্সেলোনা থেকে নাপোলি। সেখানেই পেশাদার ফুটবলে দক্ষতার শীর্ষে উঠলেন মারাদোনা। ক্যাপ্টেন হলেন। বহু প্রতিযোগিতায় নাপোলিকে জেতালেন।
৮৬-র বিশ্বকাপ ও হ্যান্ড অফ গড
৮৬-র বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ান হয়েছিল ক্যাপ্টেন মারাদোনার জন্যই। গোটা বিশ্বকাপ জুড়ে ছড়িয়ে ছিল মারাদোনার অসাধারণ ফুটবল। তবে যুক্তরাজ্যের বিরুদ্ধে ম্যাচে প্রথম গোল তিনি হাত দিয়ে করেছিলেন। মারাদোনা হেড করতে উঠেছিলেন। মাথায়. বল না পেয়ে দ্রুত হাত দিয়ে বল গোলে পাঠিয়েছিলেন। প্রথমে বলেছিলেন হ্যান্ড অফ গড। পরে ২০০৫ সালে তিনি বলেন, ইচ্ছে করেই হাত দিয়ে গোল করেছিলেন তিনি।
আর্জেন্টিনার হয়ে
নিজের দেশের জাতীয় দলের হয়ে ৯১টি ম্যাচ খেলে ৩৪টি গোল করেছেন মারাদোনা। ১৯৭৭ সালে ১৬ বছর বয়সে হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে তাঁর দেশের হয়ে খেলা শুরু। কিন্তু বয়স কম বলে কোচ তাঁকে ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপ দলে রাখেননি। ১৮ বছর বয়সে ফিফা ওয়ার্ল্ড ইয়ং চ্যাম্পিয়ানশিপে খেললেন।
বিশ্বকাপে মারাদোনা
১৯৮২-র বিশ্বকাপে প্রথম খেললেন মারাদোনা। পাঁচটি ম্যাচ খেলেছেন। প্রতিটি ম্যাচে বিপক্ষ দলের মার হজম করতে হয়েছে তাঁকে। সারা জীবন ধরে এই দুর্ভাগ্য সঙ্গী হয়েছে তাঁর। বিপক্ষ ফুটবলাররা তাঁর প্রতিভার ধারেকাছে ছিলেন না। তাই মেরেধরে তাঁকে থামাবার চেষ্টা করা হয়েছে। সে বার অর্জেন্টিনার খেলার ফল ভালো হয়নি। বেশ কয়েকটি ম্যাচে হারতে হয়েছিল মারাদোনার দেশকে।
গোল অফ দ্য সেঞ্চুরি
হ্যান্ড অফ গড-কে ভুলিয়ে দিয়েছিল গোল অফ দ্য সেঞ্চুরি। যুক্তরাজ্যের ম্যাচে নিজেদের হাফে বল পেয়ে পাঁচজন যুক্তরাজ্যের প্লেয়ারকে কাটিয়ে এক দৌড়ে ১১টি টাচের পর গোলে বল ঠেলে দেন মারাদোনা। ২০০২ সালে এটাই গোল অফ দ্য সেঞ্চুরি বলে চিহ্নিত হয়। ওই বিশ্বকাপে মারাদোনাকে ৫৩ বার ফাউল করা হয়েছিল। আর তিনি ৯০ বার ড্রিবল করে বিপক্ষ প্লেয়ারকে কাটিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। ১৪টি গোলের মধ্যে ১০টি হয় তিনি করেছেন, বা করিয়েছেন।
মাদক বিতর্ক
মাদক বিতর্ক জীবনভর জড়িয়ে ছিল মারাদোনার। ৯৪ এর বিশ্বকাপে দুইটি ম্যাচের পর ডোপ টেস্টে পজিটিভ হওয়ায় তিনি আর খেলতে পারেননি। ক্লাব ফুটবল খেলার সময়েও কোকেন বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। মাদক ও মদের প্রতি আসক্তির জন্য বার বার সমস্যায় পড়েছেন তিনি।
পেলে না মারাদোনা
বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ফুটবলার কে? পেলে না মারাদোনা? দীর্ঘদিন ধরে এই বিতর্ক হয়েছে। ফুটবল দুনিয়া দুই ভাগ হয়ে গিয়েছে এই প্রশ্নে। তবে দুজনেই মহান ফুটবলার। দুজনেই ফুটবল সম্রাট। দুই সময়ের দুই ফুটবলার মাঠে ছড়িয়ে গিয়েছেন শিল্পের নমুনা। মন্ত্রমুগ্ধ করেছেন ভক্তদের। মারাদোনার চলে যাওয়ার খবরে পেলে বলেছেন, প্রিয় বন্ধুকে হারালাম। এরপর দুই জনে আকাশে ফুটবল খেলব।
ফুটবল-বিশ্ব শোকস্তব্ধ
অকালে বিদায় নিলেন মারাদোনা। অসম্ভব প্রতিভাধর, মেজাজি, বিতর্কিত মানুষ। কিন্তু ফুটবলের মাঠে তিনি রাজা। তাঁর বিদায়ে তাই শোকস্তব্ধ ফুটবল দুনিয়া। মেসি বলেছেন, ''দিয়েগো অবিনশ্বর।'' ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর মতে, ''বিস্ময়কর প্রতিভা বিদায় নিলেন।'' কোচ মেনোত্তি জানিয়েছেন, তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।