1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মানুষ বাঁচে আশায়

রুমা মোদক
রুমা মোদক
৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪

গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা কী তার কোনো হিসাব-নিকাশ আমাদের কাছে ছিল না৷

https://p.dw.com/p/4kNDz
ছাত্র আন্দোলন
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের যাত্রা শুরু হয়৷ ফাইল ফটোছবি: Rajib Dhar/AP/picture alliance

কোটা আন্দোলনের সূত্র ধরে সরকার পরিবর্তনের পর, কিংবা আওয়ামী রেজিমের পতনের পর দেশ তিন দিন সরকারবিহীন ছিল৷ তখনো জনগণ জানতো না কে বা কারা হতে যাচ্ছে নতুন সরকার৷

দীর্ঘ ১৫ বছর একটি শাসনে একই সাথে অভ্যস্ত এবং অতিষ্ঠ  হয়ে যাওয়ার পর জাতির প্রত্যাশা আকাশচুম্বী ছিল, কিন্তু সেই প্রত্যাশাগুলো সুনির্দিষ্ট ছিল না৷ হঠাৎ কয়েকদিনের আন্দোলনে নির্বিচার হত্যায় সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হলে মানুষ, বলা যায়, অধিকাংশ মানুষ, যারা মুক্তিপ্রত্যাশী ছিল, কিংবা আওয়ামী রেজিমের ভিক্টিম ছিল, তারা কেউ নতুন সরকারের কাছে কী কী চাইবে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশিকা তৈরি করতে পারেনি৷ যারা আন্দোলনে জড়িত ছিল, আন্দোলনকে সংগঠিত করেছে, বৈষম্য বিহীন বাংলাদেশের কথা বলেছে, তারাও জাতির সামনে কোনো মেনুফেস্টো দিতে পারেনি বা দেয়নি যে, আগামীতে কী হতে পারে রাষ্ট্র কাঠামো৷ কিংবা মানুষের কী কী প্রত্যাশা তারা পূরণ করতে পারে- এ ব্যাপারে কোনো দিকনির্দেশনা আন্দোলনে ছিল না৷

একটি গণঅভ্যুত্থান স্বভাবতই যে গণ অভ্যুত্থানের চেহারা আমাদের আগের যেকোনো অভ্যুত্থানের চেয়ে ভিন্ন, সেই অভ্যুত্থান পরবর্তী ভিত্তিভূমিতে দাঁড়িয়ে মানুষের প্রত্যাশা ক্রমে আরো ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকে মানুষ আশা করতে থাকে- আমরা এমন এক নতুন বাংলাদেশের সন্ধান পাবো যে, বাংলাদেশে কোনো বৈষম্য থাকবে না৷ এই ‘বৈষম্য' শব্দটি আপেক্ষিক৷ কারণ, যে দেশে সুযোগ সমান নয়, সেই দেশে বৈষম্য থাকবে, এটা অনিবার্য৷  ৫৪ বছর বয়সে একটি রাষ্ট্র  সব প্রান্তের সব মানুষের জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে পারেনি৷ কাজেই বৈষম্য দূরীকরণের প্রক্রিয়াটি ঠিক কোন জায়গা থেকে শুরু হবে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট রূপরেখা জাতির কাছেও নেই, রাষ্ট্রের কাছেও নেই এবং আন্দোলনকারীদের কাছেও ছিল কিনা বিষয়টি স্পষ্ট নয়৷

আন্দোলন পরবর্তী যখন নতুন সরকার গঠিত হয়, তখন বয়সভেদে অবস্থানভেদে মানুষে মানুষে চাহিদার পার্থক্য ঘটে, যারা তরুণ, কিংবা ছাত্র যারা এই আন্দোলনের সাথে সরাসরি জড়িত, তারা এর আগে কোনো রাষ্ট্রীয় পট পরিবর্তনের চাক্ষুষ দৃষ্টান্ত দেখিনি৷ ১৫ বছর এক ধরনের শাসন দেখে তারা মনে করেছিল যে, তারা এমন একটি দেশ তৈরি করবে যে, দেশে কোনো অনাচার-অবিচার বৈষম্য নীতিহীনতা ইত্যাদি কোনো কিছুই থাকবে না, কিন্তু একটি জাতি, একটি রাষ্ট্র যার রন্ধে রন্ধ্রে দুর্নীতি, তাকে রাতারাতি পরিবর্তিত করা মোটেই সম্ভব নয়- এই বিষয়টি বোঝার মতো রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, কিংবা অভিজ্ঞতা কিছুই এই তরুণ প্রজন্মের নেই৷ তাদের আছে স্বপ্ন, তাদের আছে প্রতিবাদে ফেটে পড়ার মতো এনার্জি আর কাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যৎ পাওয়ার প্রত্যাশা৷

কিন্তু যারা বয়স্ক, যারা এই দেশের নানা পট পরিবর্তনগুলো দেখেছেন, তারা অভিজ্ঞতা থেকে জানেন- সরকার আসে, সরকার যায়, কিন্তু সিস্টেম, কাঠামো কিছুই বদলায় না৷ ধনীরা আরো ধনী হয়, গরিবেরা আরো গরিব হয়৷ লুটপাটের ফন্দিফিকির আরো বিস্তৃত হয় ৷এই গণ অভ্যুত্থানটির চেহারা অন্য যেকোনো গণঅভ্যুত্থানের চেয়ে ভিন্ন৷ ছাত্ররা এর নাম দিয়েছে- স্বাধীনতা, কিন্তু এই স্বাধীনতাপরবর্তী বাংলাদেশ নিয়ে এদের স্বপ্ন আছে, কিন্তু সেই স্বপ্ন সুনির্দিষ্ট না হলেও বলা যায় এই স্বপ্ন নিশ্চয়ই জাতির জনকল্যাণমুখীই হবে৷

‘দল হিসেবে আওয়ামী লীগ চলবে’

কিন্তু আওয়ামী সরকার পতনের পর আমরা দেখলাম দেশব্যাপী অরাজকতা, হত্য, লুটপাট ভাংচুর, জ্বালাও -পোড়াও, অর্থাৎ একটি রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল ও অকার্যকর করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা৷  নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর জাতি আশায় বুক বেঁধেছে যে, সরকারবিহীন দেশে যে অরাজকতা ঘটেছে, তার হয়ত বা পরিসমাপ্তি ঘটবে৷

কিন্তু নতুন সরকারকেও গত এক মাসে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি৷ দেশব্যাপী যে অরাজকতা, তা কখনো কখনো কোথাও ভয়াবহ মাত্রা ধারণ করেছে৷ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষাক্ষেত্র৷ একের পর এক শিক্ষকদেরকে ধরে ধরে পদত্যাগ করানো দেশের শিক্ষাঙ্গনকে এক অনিশ্চিত  ভবিষ্যতের মুখোমুখি ঠেলে দিয়েছে,সেই সাথে আজন্ম মূল্যবোধে ধ্বস নামিয়ে দিয়েছে৷ প্রতিদিন কোথাও না কোথাও অসন্তোষের কথা শোনা যাচ্ছে, শোনা যাচ্ছে ওষুধ শিল্প, পোশাক শিল্পসহ নানাবিধ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা৷ অনেকগুলো সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে পরিকল্পিত, কিংবা অপরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হয়েছে৷ এই যে ধ্বংস,অগ্নিসংযোগ, লুটপাট-  যদিও বলা হচ্ছে তা মানুষের পুঞ্জিভূত  ক্ষোভের বহিপ্রকাশ, কিন্তু এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষই৷ মানুষ চাকরি হারাচ্ছে, যা ক্রমাগত দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে৷

এই অরাজক পরিস্থিতির রাতারাতি উন্নতি করতে না পারলেও আমরা আশা করেছিলাম নতুন সরকার প্রতিটি ক্ষেত্রে নতুন স্বপ্ন দেখাবে৷ অন্ততপক্ষে তাদের করণীয় সম্পর্কে একটি সুনির্দিষ্ট ধারণা দেবে৷ কিন্তু আমরা এখনো পর্যন্ত তা পাইনি৷ আন্দোলনের স্টেক হোল্ডাররা সরকারকে সময় দেয়ার পক্ষপাতী আমরাও মনে করি লুটপাট দুঃশাসন ইত্যাদি পরবর্তী একটি দেশকে সংস্কারের জন্য অবশ্যই নতুন সরকারকে সময় দেয়া প্রয়োজন৷ কিন্তু সেটা কতদিন? কতদিন পর নতুন সরকার দেশকে এবং জাতিকে একটি স্থিতিশীল জায়গায় নিয়ে যেতে পারবে, কিংবা পারার ব্যাপারে কোনো টাইমফ্রেমসহ পথ নির্দেশনা দিতে পারবেন৷ আমরা এখনো পর্যন্ত কোনো  টাইমফ্রেম পাইনি৷

এখনো দেশে যে ছাত্র-জনতা হত্যা করা হয়েছে, তাদের মূল আসামিকে চিহ্নিত না করে একের পর এক মামলা দেওয়া হয়েছে, যার অধিকাংশই রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার লক্ষ্যে৷ একটি দল ক্ষমতা থেকে অপসারিত হবার সাথে সাথেই আরেকটি দল তাদের শূন্যস্থান দখল করে নিয়েছে৷ মামলা আয়রোজগারের ধান্দা হয়ে উঠেছে৷ দেশব্যাপী যে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর হয়েছে, সে ব্যাপারে এখনো আসামিদেরকে চিহ্নিত করা যায়নি৷ শহিদদের তালিকা আমরা এখনো পাইনি৷ গণহারে মামলা করে মূল আসামিদেরকে বরং আড়াল করার চেষ্টা করা হচ্ছে৷ দেশব্যাপী সংখ্যালঘুদের উপরে যে অনাচারগুলো ঘটেছে, সেগুলোর ব্যাপারে এখনো কোনো পদক্ষেপ আমরা দেখতে পাইনি৷ আদিবাসীদের ব্যাপারে কোনো মতামত আমরা জানি না৷ আমরা এখনো জানি না এই সরকার কতদিন থাকবে, কোনদিন নির্বাচন দেবে, কিংবা রাজনৈতিক দল গঠন করে  নতুন কোনো পথের নির্দেশনা জাতিকে দিতে পারবে কিনা৷

সরকার গঠনের পরপরই দেশে নেমে এসেছে সর্বগ্রাসী বন্যা৷ নবগঠিত সরকার এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছে৷ মোকাবেলা করছে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের টানাপোড়েন৷ আরব আমিরাতে শাস্তিপ্রাপ্ত শ্রমিকদের উদ্ধার করেছে৷ চলছে প্রশাসন পুনর্গঠনের কাজ৷ আর আমরা আশায় বুক বেঁধে আছি৷

মানুষের আশাবাদী হওয়াই পরম লক্ষ্য৷ আশাবাদী না হলে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না, টিকে থাকতে পারে না৷ আমরা আশা করে আছি নতুন সরকার সব পরিস্থিতি সামলে নিয়ে একটা নতুন নির্দেশনা জাতির সামনে শিগগিরই তুলে ধরতে সক্ষম হবে৷ অতি আশা আর আশাভঙ্গের আশঙ্কায় চারপাশে মানুষের হতাশা ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য