1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘মব জাস্টিস-এর নামে যা হচ্ছে, সেটা কোনো জাস্টিস না, অন্যায়'

সমীর কুমার দে ঢাকা
১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪

কাউকে গণপিটুনি দেওয়া হচ্ছে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পিটিয়ে মেরেও ফেলা হচ্ছে; কাউকে জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে; আবার কাউকে জুতোর মালা পরিয়ে কান ধরে উঠবস করানো হচ্ছে৷

https://p.dw.com/p/4kcp9
ঢাকার ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের সামনে লাঠি হাতে কয়েকজন ব্যক্তি
মব জাস্টিসের নামে যা করা হচ্ছে সেটার বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন অনেকেছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS

এগুলোকে কেউ কেউ বলছেন ‘মব জাস্টিস'৷ এ নিয়েই ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী ব্যারিস্টার সারা হোসেন৷

ডয়চে ভেলে : আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে আমরা বিভিন্ন স্থানে অনেকের হামলা, গণপিটুনি, হত্যা, জোর করে পদত্যাগ করানোর মতো ঘটনা দেখছি৷ এগুলোকে অনেকে ‘মব জাস্টিস' বলে অভিহিত করছেন৷ কিন্তু আদৌ কি তা জাস্টিস?

ব্যারিস্টার সারা হোসেন : গণপিটুনির ঘটনা বাংলাদেশে দূভার্গ্যবশত নতুন না৷ আমরা প্রতি বছরই এই ধরনের ঘটনা দেখে আসছি৷ আমাদের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এগুলো নিয়ে ডকুমেন্টেশনও করে আসছে৷ ৫ আগস্টের পর আমরা দেখছি, কোনো কোনো ব্যক্তি অন্যের হাতে লাঞ্ছিত হচ্ছেন৷ অনেক স্কুল-কলেজে কাউকে কাউকে জোর করে পদত্যাগ করানো হচ্ছে৷ এগুলোকে যে ‘মব জাস্টিস' বলা হচ্ছে, সেটা ঠিক না৷ কারণ, এগুলো তো কোনো ধরনের জাস্টিস না৷ এটা স্রেফ নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়া৷ এটা অবিচার, অন্যায়৷ গত কয়েক সপ্তাহে আমরা এমন কিছু ঘটনা দেখেছি, যেগুলোর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত৷ একই সঙ্গে আমাদের এটাও স্মরণ করতে হবে যে, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস একাধিকার বলেছেন, কেউ নিজের হাতে আইন তুলে নেবেন না৷ সে কারণে আমরা আশা রাখতে পারি, এগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷ এখন পর্যন্ত দেশে অনেক কিছুই স্থিতিশীল হয়ে উঠেনি৷ ৫ আগস্টের আগে যেখানে শত শত মানুষের প্রাণ নাশ করা হয়েছে, সেখানেও অনেক জায়গায় বিচারের জন্য তাদের স্বজনরা মামলা করতে পারেননি৷ মামলা করার সাহস হচ্ছে না অনেকের৷ অনেকেই ভয়ের মধ্যে আছেন যে, বিচার চাইতে গেলে তাদের কী হতে পারে৷ এই পরিস্থিতিও আমাদের মাথায় রাখতে হবে৷

আগে বলা হতো, বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা নেই, সে কারণে এমন ঘটনা ঘটে৷ কিন্তু অভ্যুত্থানের পরে আসা সরকারের প্রতি তো জনগণ বা রাজনৈতিক দলগুলোর বড় অংশের সমর্থন আছে বলে ধরে নেয়া যায়৷ তারপরও কেন এসব হচ্ছে?

কোনো দেশের সংস্কৃতি বা কোনো দেশে যে কাজগুলো অনেকদিন ধরে হয়ে আসছে, সেগুলো তো রাতারাতি পরিবর্তন হয় না৷ ফলে আমরা সেটাই দেখছি৷ একই ব্যক্তি যখন অনেকদিন ধরে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তিনি এখন তার অনেকদিনের রোশ বা আক্ষেপ ঝাড়ছেন৷ আমরা এটাও দেখেছি যে, গত ৫ আগস্ট থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত যখন পুলিশ ছিল না, নিরাপত্তা বাহিনীর অবস্থানও খুব কম ছিল, সেই সময় বিভিন্ন ধরনের ঘটনা দেখেছি৷ রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অনেক ঘটনা, পাশাপাশি যারা খুবই দুর্বল বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তাদের উপর অনেক জায়গায় আক্রমণ হয়েছে৷ আমরা এ-ও দেখেছি, অনেকদিনের ভূমি-বিরোধ ছিল হয়ত, এখন সুযোগ বুঝে সেই প্রভাবশালীরা অন্যের ঘর-বাড়ি ভাঙছেন বা জমি দখল করে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন৷ একটা বড় পরিবর্তনের মধ্যে আমরা এসেছি৷ বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি এটার মধ্য দিয়ে আমরা অনেকদিন ধরে এসেছি৷ হঠাৎ করে কিন্তু এই সংস্কৃতি তৈরি হয়নি৷ বিচারবর্হিভূত হত্যাকাণ্ড বা গুমের ঘটনায় এতদিন তো কোনো বিচারই হয়নি৷ গুমের একেবারেই হয়নি৷ বিচার-বর্হিভূত হত্যাকাণ্ডের অল্প কয়েকটা হয়েছে৷ যেমন- কক্সবাজারে ওসি প্রদীপসহ কয়েকটা ঘটনা ছাড়া কিছুই হয়নি৷ কাউকে দিনের পর দিন নির্যাতন করার মতো কাজ তো কয়েক দশক ধরেই হয়ে আসছে৷ এটা নিয়ে তো অনেকেই কাজ করছেন৷ তারপরও তো আমরা কোনো পরিবর্তন দেখি নাই৷ মনে হচ্ছে, আমরা একই পরিস্থিতির মধ্যে আছি৷ এগুলো নিয়ে আমাদের সোচ্চার হতে হবে, প্রতিকার চাইতে হবে৷ এখনও হচ্ছে সেটাও বলা দরকার৷

এক্ষেত্রে মানবাধিকারকর্মী বা মানবাধিকার সংস্থাগুলো কি যথেষ্ট সোচ্চার বলে মনে করেন?

আমি নিশ্চিত নই, আপনি কাদের বোঝাচ্ছেন৷ অনেকেই আছেন যারা অনেক বছর ধরে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেছেন৷ আমাদের দেশে অনেক অনেক সংগঠন আছে৷ অধিকাংশ বেসরকারি সংস্থা, যারা বলতেন তারা মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেন, তারা কিন্তু এগুলো বলাও বন্ধ করে দিয়েছেন৷ এতদিন কথা বলার অধিকার, নাগরিক অধিকারের কথা কেউ বলতে গেলে তাকে বলা হতো আপনি কাজ করতে পারবেন না৷ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্থা দিয়ে তাদের উপর নজরদারি করা হতো৷ এই পরিস্থিতিতে যারা এই কাজগুলো করতেন, তারা তাদের কাজ অনেকদিন থেকে গুটিয়ে ফেলেছিলেন৷ নারী, শিশুর অধিকার নিয়ে কাজ করা অনেকেই কাজ করতে পারেননি৷ এখন অনেকে একটু কাজ করতে পারবেন, সুযোগ পাবেন৷ আমরা যে যেখানে আছি, সেখান থেকে আরো সোচ্চার হবো৷ মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের কথা আপনি একটু স্মরণ করেন৷ তারা কিন্তু মানবাধিকার বা সাংবিধানিক অধিকার নিয়ে কাজ করতেন৷ তাদের কোনো অনুদান পাওয়া সম্ভব ছিল না৷ কাজগুলো পরিচালনা করা সম্ভব ছিল না৷ তাদের অফিসের চারদিকে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন বসে থাকতো৷ ফলে তখন মানবাধিকার নিয়ে সোচ্চার হওয়ার সুযোগ ছিল না৷ এখন হয়ত অনেকে সংগঠিত হতে পারবেন, কাজ করার সুযোগ পাবেন৷

এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের ভূমিকাকে আপনি কীভাবে দেখছেন? তারা কি যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারছে? এসব এখনো ঠেকানো যাচ্ছে না কেন?

থানাগুলো কাজ শুরু করলেও সব জায়গায় পুলিশের উপস্থিতি যথার্থ না৷ একটা পট পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে আমরা গেছি৷ আগে যারা ক্ষমতায় ছিলেন, তাদের অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে৷ যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নেই, তারাও অনেকে শঙ্কিত আছেন৷ স্থিতিশীল অবস্থার মধ্যে তো আমরা নেই৷ সরকারের উপর থেকে প্রধান উপদেষ্টা বারবার বলছেন, কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না৷ কোনো প্রতিষ্ঠানই তো এখনো পুরোপুরি ঢেলে সাজানো হয়নি৷ বিভিন্ন ধরনের প্রভাব একেক প্রতিষ্ঠানের উপর খাটানো হচ্ছে৷ এই পরিস্থিতিতে হয়ত সরকার অনেক কিছু করতে পারে৷ তারা যখন দেখছে, কেউ কেউ হয়রানির শিকার হচ্ছে বা মিডিয়ায় আসছে অনেককে হত্যা মামলায় জড়ানো হচ্ছে, যারা কোনোভাবেই এইসব মামলায় থাকতে পারেন না৷ তদন্ত করলেই বোঝা যাবে, তারা এই ঘটনার সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত না৷ এই ঘটনাগুলো যাচাই-বাছাই করার জন্য নিশ্চয় নির্দেশনা দেওয়া যায়৷ আমরা দেখেছি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এই ধরনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে৷ আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, অনেকেই হয়রানির শিকার হচ্ছেন৷ এই হয়রানি যাতে না হয় বা পুলিশও যাতে তাদের মূল্যবান সময় এই হয়রানির পিছনে ব্যয় না করে, সে বিষয়ে সরকার হয়ত ব্যবস্থা নিতে পারে৷

সরকারের আরও পদক্ষেপ নেওয়া উচিত কোনো হয়রানি যাতে না হয়: ব্যারিস্টার সারা হোসেন

বিগত সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক মামলার মাধ্যমে বিরোধী দল, বিরুদ্ধ মত দমনের অভিযোগ ছিল৷ নতুন সরকার আসার পরে আপনি কি সেখানে পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছেন?

এখন পর্যন্ত আমরা দেখছি, অনেকে হয়রানির শিকার হচ্ছেন৷ আমরা যদি নাগরিক সমাজের কথা বলি, যারা রাজনৈতিক দলের সদস্য না তারা হয়ত কোনো নাগরিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বা সাংবাদিকও তারা হয়ত বিগত সরকার থেকে সুবিধা নিয়েছেন বা সরকারের অন্যায়কে সমর্থন দিয়েছেন, তাদের এমন সব মামলায় জড়ানো হয়েছে, সেটাকে অবশ্যই আমরা হয়রানিমূলক বলতে পারি৷ এক্ষেত্রে খেয়াল করতে হবে, মামলাগুলো সরকারের পক্ষ থেকে করা হচ্ছে না৷ তবুও সরকারের আরও পদক্ষেপ নেওয়া উচিত কোনো হয়রানি যাতে না হয়৷ এ ব্যাপারে তারা যেন ব্যবস্থা নেন৷ তবে একটা পার্থক্য আমরা দেখছি যে, আগে পুলিশ মামলা করেছে৷ বিচার ব্যবস্থা থেকে আমরা দেখেছি অনেক হয়রানিমূলক ব্যবস্থা সেখানেও হয়েছে৷ বিচার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে আমরা শুনছি, প্রধান বিচারপতির এ মাসেই একটা বড় ঘোষণা দেওয়ার কথা৷ বিচার ব্যবস্থা সংস্কারের ব্যাপারে একটা কমিশন গঠন করা হয়েছে৷ এটা খুবই জরুরিভাবে প্রয়োজন৷ আশা রাখছি, এসব জায়গায় থেকে হয়ত আমরা কিছু আশু পদক্ষেপ দেখবো৷

‘গণহত্যার' অভিযোগে  ক্ষমতাচ্যুত সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ অনেকের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার৷ এরই মধ্যে এই ট্রাইব্যুনালের নিয়োগপ্রাপ্ত চীফ প্রসিকিউটরকে নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে৷ এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?

এই ট্রাইব্যুনালে যারা আসবেন তাদের নিয়ে কারো কোনো ধরনের আশঙ্কা থাকা উচিত না যে, তারা ন্যায় বিচার করবেন না৷ প্রসিকিউটার তো বিচার করবেন না৷ তবে এখানে কেউ কোনো পক্ষপাত করবেন না, সেটা আমলে নিয়েই নিয়োগগুলো হওয়া উচিত৷

সার্বিকভাবে বাংলাদেশের বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতি ও বিচার ব্যবস্থা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী? পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য সরকারের কী কী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে মনে করেন?

আজকে আমরা যখন কথা বলছি এই সরকারের বয়স ৫ সপ্তাহ হয়েছে৷ আপনি যদি আমাকে এখন প্রশ্ন করেন দেশে আইনের শাসন আছে কিনা, তাহলে আপনাকে আমি প্রশ্ন করবো এই প্রশ্ন কি আপনি আমাকে এক মাস আগে করেছিলেন কিনা? যদি না করে থাকেন, তাহলে কোনো আলোচনা নেই৷ এক মাসের একটু বেশি আগে যে, অবস্থা হয়েছিল, সেখানে শত শত প্রাণ নাশ করা হয়েছে দুই সপ্তাহের ভেতরে৷ হাজার হাজার ছেলে-মেয়েরা বিশেষ করে ছেলেরা আহত হয়েছে, গুলিবিদ্ধ হয়েছে, অনেকের অঙ্গহানি হয়েছে, অনেকে অন্ধ হয়েছে৷ তারা এখন পর্যন্ত বিচার চাইতেও পারেনি৷ বিচার পাওয়া তো অনেক দূরের কথা৷ সেই পরিস্থিতি আমরা অতিক্রম করিনি, করছি৷ হাজার হাজার যে আটক হয়েছিল, গ্রেপ্তার হয়েছিল, তারা সপ্তাহের পর সপ্তাহ স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে পারেনি৷ আইনি সহায়তা পায়নি৷ এগুলো করা হয়েছিল রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে৷ একজন, দুইজনের পক্ষে মামলা করার কোনো অবস্থাও ছিল না৷ সারা পৃথিবী দেখেছে শত শত ছেলে-মেয়ে রাস্তায় পড়ে যাচ্ছে৷ তখন কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হয়নি৷ আমরা আদালতে গিয়েছিলাম, আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিলাম- এই ঘটনাগুলো বন্ধ করার জন্য৷ তখন কিন্তু কেউ আমাকে জিজ্ঞাসাও করেনি দেশে আইনের কী অবস্থা? এখন আমরা ওই পরিস্থিতি অতিক্রম করার চেষ্টা করছি৷ এখনো বিভিন্নভাবে মানবাধিকার লংঘন হচ্ছে৷ সেগুলো নিয়ে আমাদের সোচ্চার হতে হবে৷ অবশ্যই সরকারের কাছে, রাষ্ট্রের কাছে দাবি রাখতে হবে৷ যেখানে মানবাধিকার লংঘন হচ্ছে, সেটা যাতে না হয়৷ তবে আমরা ভুলে যেতে পারব না এতগুলো মানুষ যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের স্বজনরা কিন্তু এখনো কিছুই পাননি৷