ভারতীয়রা কেন বলকান রুট হয়ে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করছেন?
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২সার্বিয়ার হাঙ্গেরি ও রোমানিয়া সীমান্তে অবস্থিত কিকিন্দা শহরের অভিবাসী শিবিরে প্রায় একশজন ভারতীয় রয়েছেন৷ জানা গেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশে প্রবেশ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন তারা৷
ক্যাম্পের কর্মকর্তা আন্দ্রেয়া মার্সেঙ্কো ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের এ ক্যাম্পটিতে ৫৪০ জনের থাকার ব্যবস্থা আছে৷ তবে বর্তমানে এখানে আছেন মোট ৫৫০ জন আশ্রয়প্রার্থী৷ এর মধ্যে ৩৬০ জন বাংলাদেশি আর প্রায় একশজন ভারতীয় নাগরিক৷''
এই কর্মকর্তার মতে, অভিবাসনের জন্য ভারতীয় নাগরিকদের এভাবে আসার বিষয়টি বেশ নতুন৷ গত কয়েক মাস ধরে এটি দেখা যাচ্ছে৷
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসন বিষয়ক সংস্থা আইওএম কিকিন্দার এই ক্যাম্পটি পরিচালনা করছে৷ পরিদর্শনে দেখা গেছে, ক্যাম্পটিতে খেলাধুলার ব্যবস্থাও রয়েছে৷ দক্ষিণ এশিয়া থেকে আসা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের অনেকে আবার এখানে ক্রিকেটও খেলছেন৷
‘পুলিশের নির্যাতনের শিকার'
ভারতের পাঞ্জাবের হারজিন্দার কুমার কয়েক মাস আগে সার্বিয়া এসেছেন৷ মায়ের চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে ঋণের চাপে পড়েন তিনি৷
‘‘একদিন ইউরোপের কোনো দেশে পৌঁছাবো এমন ইচ্ছা থেকেই আমি সার্বিয়ায় আসি৷ ইউরোপে পৌঁছানোর পর ঋণের সব টাকা পরিশোধ করার ইচ্ছা আমার৷’’
ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশে পৌঁছানোর চেষ্টা করে বেশ কয়েকবার ব্যার্থ হয়েছেন তিনি৷ ডয়চে ভেলেক বলেন, ‘‘অবৈধ পথ পাড়ি দিতে গিয়ে মানবপাচারকারীকে প্রায় দুই হাজার ডলার দিয়েছি৷ কিন্তু মনে হয় সার্বিয়াতে আটকে গেছি৷’’
হারজিন্দার কিকিন্দার ওই ক্যাম্পে বিরিয়ানি বিক্রি করেন৷ ‘‘আমি ও আমার বন্ধুরা এর মাধ্যমে পকেট খরচের টাকা জোগাড় করি৷''
শিবিরটি পরিদর্শনে গিয়ে দেখা গেল,অভিবাসনপ্রত্যাশীদের অনেকেই ক্যাম্পের মূল ভবনের ভেতরে থাকেন৷ কিন্তু ভারতীয়দের বেশিরভাগই ক্যাম্পটির এক কোণায় অবস্থিত একটি সাদা তাঁবুতে বাস করছেন৷
কেন তারা এভাবে আলাদা বাস করছেন সে বিষয়ে কিছু জানায়নি কর্তৃপক্ষ৷
হারজিন্দ কুমারের মতো কয়েক মাস আগে সার্বিয়ায় এসেছেন ২৭ বছর বয়সের জাসবির সিং৷ নিজ দেশে চাকরি না পেয়ে অভিবাসনের চেষ্টা পাঞ্জাবের এ যুবকের৷
জাসবিরের দাবি, ইউরোপের দেশে পৌঁছাতে তিনি মানবপাচারকারীদের প্রায় ১২ হাজার ইউরো দিয়েছেন৷
তিনি জানান, সার্বিয়া থেকে অবৈধভাবে হাঙ্গেরি, রোমানিয়া ও ক্রোয়েশিয়া পৌঁছানোর চেষ্টা করলেও সীমান্ত পুলিশের নজর এড়াতে না পারায় তিনি বার বার ব্যর্থ হয়েছেন৷ সেসময় সীমান্ত পুলিশের হাতে নাজেহাল হয়েছেন বলেও দাবি তার৷
ডয়চে ভেলেক তিনি বলেন, ‘‘ইউরোপের পুলিশ আমাদের প্রতি মোটেই শ্রদ্ধা দেখায় না৷ সীমান্তে চেক করার সময় তারা আমাদের মাথার পাগড়ি খুলে ফেলে এবং দাড়িতে ধরে টানা-হ্যাঁচড়া করে৷’’
‘‘তারা আমাদের কাপড়চোপড়ও খুলে ফেলে এবং ঠান্ডার মধ্যে হেঁটে হেঁটে সার্বিয়ায় ফেরত আসতে বাধ্য করে৷’’
‘বলকান রুট' ধরে কেন আসছেন ভারতীয় অভিবাসনপ্রত্যাশীরা
২০১৫ ও ২০১৬ সালে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে হাজার হাজার আশ্রয়প্রার্থী গ্রিস হয়ে ইউরোপের অন্যান্য দেশে আশ্রয় নেন৷ তাদের অনেকেই বসনিয়া এবং সার্বিয়া হয়ে ইউরোপের দেশ জার্মানিতে আশ্রয় নিয়েছেন৷ ইউরোপের অভিবাসনের এ পথটি ‘বলকান রুট' নামে পরিচিত৷
আর ২০১৭ সাল থেকে এ পথ ধরে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ, যেমন বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান থেকে অভিবাসনপ্রত্যাশীরা ইউরোপে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন৷
তবে ভারতীয়দের জন্য সার্বিয়া ইউরোপের এমন একটি দেশ, যেখানে তারা ভিসা ছাড়াই প্রবেশ করতে পারে৷ আর এ কারণে এ পথ ধরে ইউরোপে পৌঁছানোর চেষ্টা তাদের জন্য অনেক সহজ হয়ে থাকে৷
ধারণা করা হচ্ছে, অভিবাসনের আশায় ভারতীয়দের অনেকেই সার্বিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে পৌঁছে সেখান থেকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশে প্রবেশের চেষ্টা করে থাকে৷
কিকিন্দার অভিবাসী ক্যাম্পের কমর্কর্তা আন্দ্রেয়া মার্সেঙ্কো বলেন, ভারত থেকে আসা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের কেউ কেউ গ্রিসে থাকার চেষ্টা করেন৷ চলতি মাসের শুরুর দিকে উত্তর মেসিডোনিয়ার পুলিশ ১৬ জন ভারতীয়কে আটক করে৷ তারা গ্রিস সীমান্ত দিয়ে তারা ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করছিলেন৷
জানা গছে, অনেক ভারতীয় অভিবাসনপ্রত্যাশী বসনিয়া-হ্যারৎসেগোভিনা সীমান্ত পার হয়ে ক্রোয়েশিয়ায় প্রবেশের চেষ্টা করে থাকেন, কেননা সার্বিয়া ও বসনিয়ার সীমান্ত অবৈধ পথে পাড়ি দেওয়া অনেক সহজ বলে মনে করেন তাদের কেউ কেউ৷
এদিকে, বসনিয়ার বিহাচে অবস্থিত লিপা ক্যাম্পে কয়েক ডজন ভারতীয় অভিবাসনপ্রত্যাশী রয়েছেন৷ ইউরোপে পৌঁছানোর লক্ষ্যে তারা বসনিয়া এসেছেন আর অর্থনৈতিক কারণেই তাদের ইউরোপে পৌঁছানোর চেষ্টা বলে জানান তারা৷
লিপা ক্যাম্পে অবস্থানরত ভারতীয় অভিবাসনপ্রত্যাশী ভুপিন্দর ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গত মাসে আমি দুইবার ক্রোয়েশিয়ায় প্রবেশ করেছি৷ কিন্তু ক্রোয়েশিয়ার সীমান্ত পুলিশের কারণে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশে পৌঁছাতে পারিনি৷’’
ভুপিন্দর জানান, অভিবাসনের এ চেষ্টায় তিনি কোনো মানবপাচারকারীকে টাকা দেননি৷ বরং গুগল ম্যাপের সহযোগিতায় গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করছিলেন তিনি৷
তবে বলকানের এই পথ ধরে অবৈধভাবে ইউরোপে পৌঁছানোর চেষ্টা নিরাপদ নয় বলে জানান তিনি৷ ‘‘ভারতে যদি আমার একটি চাকরি থাকতো, তাহলে আমি এভাবে বসনিয়া আসতাম না৷’’