পশ্চিমবঙ্গে ব্লাড ব্যাংকে রক্তের আকাল
১২ জুন ২০১৭রক্ত সমস্যার সমাধানে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীকেও এগিয়ে আসতে হয়েছে৷ তাঁর নির্দেশে গরমের কটাক্ষ এড়িয়ে শুরু হয়েছে সান্ধ্যকালীন রক্তদান শিবির৷
পুলিশ থেকে পুরসভা, সাধারণ নাগরিক থেকে সমাজসেবী— সকলকেই একবাক্যে সান্ধ্যকালীন রক্তদানের উদ্যোগকে বাহবা দিয়েছেন৷ কিন্তু স্রেফ বাহবা বা পিঠ চাপড়ানি নয়, এগিয়ে আসতে হবে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে৷
এ সত্য সবাই বুঝেছেন কি? পশ্চিমবঙ্গে রক্তদানের আসল চেহারাটাই বা এখন কেমন?
বছরে ১১ লক্ষ বোতল রক্ত দরকার হয় রাজ্যে৷ এই বিপুল পরিমাণ রক্ত সংগ্রহের জন্য স্বেচ্ছা রক্তদান শিবিরের ওপরই ভরসা করতে হয়৷ কিন্তু ইদানীং তথাকথিত স্বেচ্ছা রক্তদানের ক্ষেত্রে উঠে এসেছে উপহার বিনিময়ের অভিযোগ৷ রক্তদানের বিনিময়ে প্রেসার কুকার, রান্নার বাসন, ট্রলি ব্যাগ ঘরে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠছে রক্তদাতাদের বিরুদ্ধে৷
রক্তদানের আসল শক্তিই হচ্ছে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ততা৷ উপহারের বাড়বাড়ন্তে সেই স্বতঃস্ফূর্ততায় পড়ছে ব্যাঘাত৷ দীর্ঘদিন ধরে প্রচার চালিয়ে রক্তদান আন্দোলন নিয়ে মানুষের মনে একটা সচেতনতা গড়ে তোলা হয়েছে৷ উপহার কেনায় আর্থিকভাবে অসমর্থ ছোট ক্লাব বা সংগঠনগুলি ছিল তার মূলে৷ রক্তদানে উপহার প্রথার আগমনে অনেকেই ছোট ক্লাবে বিনা উপহারে যেতে নারাজ৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শাসক গোষ্ঠীর লোকজন উপহার দেওয়ায় জড়িত বলে জানা যায়৷ নিছক ওয়াটার ফিল্টার বা প্রেসার কুকার পাওয়ার লোভে এখন রাজ্যে রক্তদান শিবির পরিণত হয়েছে প্রতিযোগিতা আর উৎসবে৷
এর ফলে রক্তদানের সঙ্গে যুক্ত সংগঠন এবং ব্লাড ব্যাঙ্কের সদস্যরা প্রমাদ গুনছেন৷ তবে উপহারের তত্ত্ব খারিজ করে এগিয়ে এসেছেন দুর্গাপুজোর উদ্যোক্তারা৷ ‘মায়ের জন্য রক্তদান’ শীর্ষক শিবিরের আয়োজন করে তাঁরা হাত বাড়িয়েছেন রক্ত সঙ্কটের মোকাবিলা করতে৷ এখানে রক্তদাতারা পাবেন দুর্গাপুজোর ভিআইপি পাস৷ চলতি সপ্তাহে ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে মায়ের জন্য রক্তদান শিবির বসেছিল৷ সেখানে ৯০০ জন রক্ত দিয়েছিলেন৷ এছাড়া কলকাতা পুরসভার তরফে দক্ষিণ কলকাতায় ব্লাড ব্যাঙ্ক খোলার কথাও জানানো হয়েছে৷ এর ফলে রক্তের সঙ্কট অনেকটাই মিটবে বলে আশা করা হচ্ছে৷
পশ্চিমবঙ্গের রক্তদান আন্দোলন অনেক পুরনো৷ এ ব্যাপারে অগ্রণী সংগঠন ‘অ্যাসেসিয়েশন অফ ভলান্টিয়ারি ব্লাড ডোনার্স, ওয়েস্ট বেঙ্গল’৷ এই সংগঠনের পক্ষে বরুণ কুমার পাণ্ডা জানান, ১৯৮০ সালের ২০ জানুয়ারি তাঁদের প্রতিষ্ঠানের পথ চলা শুরু৷ এই ধরণের সংগঠন মূলত চারটি ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে৷ এক, জনতাকে সচেতন করতে হবে৷ তাদের রক্তদানের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে হবে৷ দুই, সাধারণ মানুষকে রক্তদানের জন্য অনুপ্রেরণা জোগানো৷ অর্থাৎ তাদের মধ্যে রক্তদানের আগ্রহ জাগিয়ে তোলা৷ তিন, রক্তদান শিবির সংগঠন৷ সচেতন ও রক্তদানে আগ্রহী ব্যক্তি যদি রক্ত দিতে চান, তাহলে কোথায় দেবেন? সে জন্য তার বাড়ির কাছাকাছি শিবিরের আয়োজন করা হয়৷ চার, রক্তদানের স্বীকৃতি৷ একজন ব্যক্তি বছরে চারবার রক্ত দিতে পারেন, সংগঠকরা পদক বা প্রশংসাপত্রের মাধ্যমে রক্তদানকারীকে স্বীকৃতি দেন, যাতে তিনি ফের শিবিরে এসে রক্তদান করেন৷
যিনি রক্ত দিলেন, তাঁর সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি অন্যের জীবন বাঁচানোর গৌরব ও সামাজিক দায়িত্ব পালনের তৃপ্তি৷ একইসঙ্গে রক্তদানের ফলে তাঁর হাতে আসা কার্ডটি বিপদে-আপদে রক্তদানকারী বা তাঁর প্রিয়জনের জীবনরক্ষা করতে পারে৷
অনেক শিবির ঘিরে উপঢৌকন বিতরণের অভিযোগ উঠলেও নিষ্কাম রক্তদানের পরিমাণই বেশি৷ কলকাতার বাইরে রক্তের চাহিদা মেটাতে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে-গঞ্জে এখনও স্বেচ্ছা রক্তদান শিবিরের আয়োজন করা হয়৷ অবশ্য সেসব শিবিরের বিরুদ্ধে প্রায়ই অপরিচ্ছন্নতা বা সুরক্ষাহীনতার অভিযোগ ওঠে৷
উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ ব্লাড ব্যাঙ্কের ডাক্তার রাজকুমার সিং এ প্রসঙ্গে ডয়চে ভেলেকে জানালেন, ‘‘উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতে রক্তের চাহিদা খুবই৷ সে জন্য রক্তদান শিবিরের আয়োজন করতেই হয়৷ তবে সেগুলি যথেষ্ট স্বাস্থ্যবিধি মেনেই আয়োজিত হয়৷ এইচআইভি, হেপাটাইটিস বি ও সি, ম্যালেরিয়াসহ গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি পরীক্ষা না করে রক্তগ্রহণ করা হয় না৷’’ তবে রক্তদান শিবিরে প্রশিক্ষিত যুবক-যুবতীর অভাব কখনো কখনো সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়৷ এ তথ্য মেনে নিয়েছেন অ্যাসেসিয়েশন অফ ভলান্টিয়ারি ব্লাড ডোনার্সের বরুণ পাণ্ডা৷
উত্তরবঙ্গের বিশিষ্ট সমাজসেবী তথা কলকাতা পুলিশকর্মী বাপন দাস রক্তদান আন্দোলনের অগ্রণী সৈনিক৷ সারা বছর রক্তদান শিবিরের আয়োজন করে তিনি উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রক্তের জোগান দেন৷ ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে এমনকি পুরুষের পাশাপাশি মহিলাদেরও উৎসাহ দিতে তাঁর জুড়ি নেই৷
সংখ্যালঘুদের মধ্যে সরকারি টিকা গ্রহণের ব্যাপারে একটা ছুঁৎমার্গ থাকে৷ তাঁদের অনেকে মূলত শিক্ষার অভাবের কারণেই মনে করেন, এই টিকা কর্মসূচি আদতে তাঁদের জন্ম নিয়ন্ত্রণের কৌশল৷ এ কারণে পালস পোলিও টিকাকরণ থেকে তাঁরা মুখ ফিরিয়ে ছিলেন৷ এখন পরিস্থিতি বদলেছে৷ বাপন দাস বলেন, ‘‘গত ফেব্রুয়ারি মাসের একটি রক্তদান শিবিরে ৬৮ জনের মধ্যে ৬২ জনই ছিল সংখ্যালঘু (মুসলিম) সম্প্রদায়ের৷’’
রক্তদান আন্দোলনে মহিলাদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো৷ উত্তরবঙ্গের মহিলারাও রক্তদানে এগিয়ে এসেছেন৷ একটি শিবিরে ৭২ জন স্বেচ্ছায় রক্তদাতার মধ্যে ২২ জনই ছিলেন মহিলা৷ বিধাননগর ওয়েলফেয়ার সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা বাপনের মতো অনেকে গ্রীষ্মকালীন রক্ত সঙ্কট মেটাতে সক্রিয় রয়েছেন৷ বাপনের মত, প্রচণ্ড গরমের জন্য এ সময় শিবির বন্ধ থাকে৷ ফলে রক্তের অভাব দেখা দেয়৷ সে কারণেই সান্ধ্য শিবিরের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন তিনি৷ গরম এড়িয়ে রক্ত দিলে অভাব মিটবে৷ তবে ইদানীংকালের উপহার দেওয়া-নেওয়ার পরম্পরা বাপন দাসের মতো উদ্যোক্তাদের আহত করে বৈকি!