বেসরকারি খাতে জ্বালানি তেল আমদানিতে লাভ কার?
১৪ ডিসেম্বর ২০২২বাংলাদেশে বেসকারি খাতকে জ্বালানি তেল আমাদানির অনুমতি দেয়া হবে। চাইলে তারা এলএনজিও আমদানি করতে পারবে। এখন আমদানি করে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)। তবে পওয়ার প্ল্যান্টগুলো শর্ত সাপেক্ষে আমদানি করতে পারে।
বেসরকারি খাতে রিফাইনড, না ক্রুড আমদানির অনুমতি দেয়া হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। জ্বালানি তেল আমদানি, রিফাইন ও বাজারজাতকরণ কেমন হবে তাও স্পষ্ট নয়। এনিয়ে নীতিমালার খসড়া তৈরি করছে জ্বালানি বিভাগ।
তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন,"আগে সিদ্ধান্ত নিতে ক্রুড, না রিফাইন অয়েল আমদানি করার সুযোগ দেয়া হবে। তারপর ঠিক করতে হবে দাম কীভাবে নির্ধারণ করা হবে। আপাতত ক্রুড অয়েল আমদানি বেসরকারি খাতে সম্ভব নয়। তাহলে তাদের রিফাইনারি স্থাপন করতে হবে যা সময়সাপেক্ষ। আর বিপিসির দামেই যদি বিক্রি হয় তাহলে ভোক্তা লাভবান হবে না।”
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গত সপ্তাহে বলেছেন." কম দামে জ্বালানি নিশ্চিত করাই এখন মূল সমস্যা। তাই সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও চাইলে জ্বালানি তেল আমদানি করতে পারবে। সরকার দাম ঠিক করে দেবে।”
তিনি আরো জানান,"এলএনজিও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আমদানি করতে পারবে। আর আগামী জুন থেকে ডিজেল চালিত সব বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হবে। এরইমধ্যে এক হাজার মেগাওয়াট ডিজেল উৎপাদিত বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।”
আলোচনায় যা আছে
বেসরকারি খাতে জ্বালানি তেল আমদানির বিষয়টি প্রথম সামনে আসে গত নভেম্বরে। তখন মন্ত্রিপরিষদে ‘‘বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২২'' অনুমোদনের জন্য ওঠে। ওই বৈঠকে প্রথম বেসরকারি খাতে জ্বালানি তেল আমদানির অনুমোদন দেয়ার বিষয়টি আলোচনা হয়। তখন বেসরকারি আমদানিকারকেরা রিফাইন অয়েল আমদানি করবে, না রিফাইন করে নিজেরাই খোলা বাজারে বিক্রি করবে তা আলোচনা হয়। সরকারের কাছে বিক্রি করবে কি না সেটি আলোচনা হয়। বলা হয়, নিজেরা রিফাইন করলে এক্ষেত্রে বিএসটিআইকে মনিটরিং রাখতে হবে যাতে মান ঠিক থাকে।
বেসরকারি আমদানিকারকেরা ক্রুড অয়েল আমদানির পর বিটুমিনসহ অন্যান্য যে উপজাত পণ্য আসবে এগুলো হয় তারা স্থানীয় বাজারে বিক্রি করবে অথবা বাইরে রপ্তানি করবে। বাজারজাত পদ্ধতি নিয়েও কথা হয়। তখন বলা হয় যে, এমনও হতে পারে তারা ক্রুড অয়েল আমদানির পর বিপিসির কাছে বিক্রি করবে। বিপিসি তা রিফাইন করে দেশের বাজারে বিক্রি ও রপ্তানি করবে। আমদানি করা তেলের দাম ঠিক করে দেবে সরকার। আলোচনায় বেরসরকারি পর্যায়ে রিফাইনারি স্থাপনের ওপর জোর দেয়া হয়। জানা যায়, এই বিষয়গুলো এখনো চূড়ান্ত হয়নি। আমদানিকারকদের লাইসেন্সেরও প্রশ্ন আসবে। তবে বাংলাদেশে এলপিজি ও লুব অয়েল বেসরকারি খাতে আমদানি হয়। লুব অয়েলের বড় আমদানিকারকেরা বিপিসির সহায়তায়ই তা বাজারে দেয়। আর ছোট আমদানিকারকেরা নিজেরাই বাজারজাত করেন।
পরিস্থিতি কী?
এখন বিশবাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমছে। কিন্তু এর আগে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি এবং ডলার সংকটের কারণে বিপাকে পড়ে বাংলাদেশ। তেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বলতে গেলে বন্ধ করে দেয়া হয়। মন্ত্রী নিজেও বলেছেন জুনের পর ডিজেল চালিত সব বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে মোট এক হাজার ২০৫ কোটি ৮০ লাখ বা ১২ বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের জ্বালানি তেল আমদানি করা হয়েছে। এর মধ্যে অপরিশোধিত তেল আমদানিতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৮৭ কোটি ডলার। পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করা হয় প্রায় এক হাজার ১১৯ কোটি বা ১১.১৯ বিলিয়ন ডলারের। তবে এই জ্বালানি তেল সব বিপিসি আমদানি করেনি। পাওয়ার প্ল্যান্টগুলোও আমদানি করেছে। বিপিসি আমদানি করেছে ৬৬ লাখ ৭ হাজার ২২৪ টন জ্বালানি তেল। মোট ব্যয় হয়েছে প্রায় ৫৫৪ কোটি ৯০ লাখ বা প্রায় ৫.৫৫ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশে জ্বালানি তেলে ভর্তুকি দেয়। এই ভর্তুতি কমিয়ে আনা তুলে দেয়ার চাপ আছে। বেসরকারি খাতে জ্বালানি তেল আমদানি করা হলে সেটা বাজার দরেই বিক্রি হবে। যদিও সরকার বলছে আন্তর্জাতিক বাজার দেখে তারা ভ্যাট, ট্যাক্স, আমদানি খরচ ধরে লাভসহ খুচরা বাজার দাম ঠিক করে দেবে।
যেভাবে লাভ হবে
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ম. তামিম বলেন, "বেসরকারি খাতে জ্বালানি তেল আমদানি করতে হলে বড় ধরনের রিস্ট্রাকচারিং করতে হবে। তবে যদি তারা আমদানি করে বিপিসির কাছে বিক্রি করে তাহলে লাভ দেখি না।”
তার কথা, "তারা যদি আমদানি করে নিজস্ব ডিষ্ট্রিবিউশন পদ্ধতিতে বিক্রি করতে পারে তাহলে বাজার প্রতিযোগিতামূলক হবে। বাজারে অনেক প্রতিযোগী থাকবে। ভোক্তা যুক্তিসঙ্গত দামে তেল পাবে। তা না হলে লাভ হবে না।”
তার এই কথা পরিশোধিত জ্বালানি তেল নিয়ে । তবে ক্রুড অয়েল আমদানির ক্ষেত্রে তিনি বলেন, "সেটা রিফাইন করার মতো ব্যবস্থা নেই। রিফাইনারি আছে সরকারের। বেসরকারি খাতে রিফাইনারি স্থাপন অনেক সময় ও বিনিয়োগের ব্যাপার। সেটা যখন করা যাবে তখন আরো সুবিধা হবে। রি-এক্সপোর্ট করা যাবে।”
আর দাম নির্ধারণে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের একটি ভূমিকা থাকতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
দাম নির্ধারণ করবে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন
এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের সদস্য মকবুল-ই-ইলাহী বলেন,"আগে জ্বালানি তেল আমদানির ব্যাপারে নীতিমালা তৈরি করে প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে। তা না হলে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হবে। এখন ৯৮ ভাগ এলএনজি বেসরকারি খাত আমদানি করে। দাম আমরাই ঠিক করে দিই। এলএনজি আমদানির অনুমতির সময় কেউ না বুঝতে পেরে জ্বালানি তেলও আমদানি করেন। কিন্তু তারা তা বিক্রি করতে পারেননি।”
পাকিস্তান আমলে বেসরকারি খাতে জ্বালানি তেল আনা হতো। তখনও দাম নিয়ে সমস্যা হয়নি।”
বেসরকারি খাতকেই তাদের মতো করে আমদানি ও বিপণন করতে দিতে হবে।”
ম. তামিম বলেন,"ভারতে বেসরকরি খাতে জ্বালানি তেল আনা হয়। তাতে ভোক্তারা লাভবান হচ্ছে, তাদের চেষ্টা থাকে কম দামে এনে কম দামে বিক্রি করার। কিন্তু এখানে যদি বেসরকারি খাতে আমদানি করে বিপিসির কাছে বিক্রি করা হয় তাতে লাভ হবে না।”