বিশ্বকাপ ফুটবল ও জার্মান জাতির ক্ষতি
১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯বিষয়টি হচ্ছে জাতীয়তাবাদ৷ এই লেখায় জাতীয়তাবাদের ভালোমন্দ নিয়ে কিছু কথা বলবো৷ কয়েকটি ঘটনার বর্ণনা দেয়ার চেষ্টা করবো৷ সেগুলো পড়ে হয়ত আপনার মনে হতে পারে, কেন আমি নেতিবাচক শিরোনাম দিলাম৷ মনে হতে পারে, শিরোনামটি ইতিবাচক হওয়া উচিত ছিল৷
যাই হোক, মূল প্রসঙ্গে ঢুকে পড়ি৷ শিরোনামে বিশ্বকাপ ফুটবলের কথা বলছিলাম৷ সেই বিশ্বকাপটি হয়েছিল ২০০৬ সালে, জার্মানিতে৷ তার আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে জার্মানদের পতাকা নিয়ে মাতামাতি করতে দেখা যেত না৷ ইহুদিদের বিরুদ্ধে হিটলারের নৃশংসতার কারণে জার্মানরা জার্মান পরিচয় দিতে লজ্জা পেতেন কিংবা দেশের প্রতি ভালোবাসা দেখানো উচিত হবে কিনা, তা নিয়ে নিশ্চিত ছিলেন না তাঁরা৷ তাই খেলাকে ঘিরে বাড়ির ছাদ কিংবা জানালা থেকে দেশের পতাকা ওড়ানো, মাথায় পতাকার রংয়ের টুপি পরা, গাড়িতে পতাকা ঝোলানো – এ সব করতেন না জার্মানরা৷
কিন্তু জার্মানিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ সেই ধারা বদলে দেয়৷ বিশ্বকাপের কারণে সারা বিশ্ব থেকে আসা সমর্থকদের নিজ নিজ দেশের পতাকা উড়িয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখে জার্মানরাও তা শুরু করে দেন৷ তাঁরাও পতাকা ওড়ানো থেকে শুরু করে জাতীয় দলের জার্সি পরে হৈচৈ করে বড় স্ক্রিনে খেলা দেখা শুরু করেন৷
হঠাৎ করে জার্মানদের এমন আচরণ বিশ্ববাসীর কাছে এতটাই অস্বাভাবিক ঠেকেছিল যে নিউইয়র্ক টাইমস, গার্ডিয়ানের মতো পত্রিকায় সেই খবর প্রকাশিত হয়েছিল৷
জার্মানির পত্রপত্রিকায়ও বিষয়টি উঠে এসেছিল৷ রেডিওতে টেলিফোন করে অনেক জার্মানকে বলতে শোনা গিয়েছিল যে, অবশেষে তাঁরা নাকি নিজেদের জার্মান হিসেবে ভাবতে গর্ব বোধ করছেন৷
সেই থেকে শুরু৷ এখন অন্য জাতির মতোই জার্মানরা নিজ দেশ নিয়ে গর্বিত৷
আপাতদৃষ্টিতে জার্মানদের এই জাতীয়তাবাদী আচরণ নিয়ে বিশ্ববাসীর চিন্তিত হওয়ার কিছু ছিল না৷ কিন্তু দিন যতই যাচ্ছে এই আচরণের নেতিবাতক প্রভাব দেখা যাচ্ছে৷ যেমন ইউরোজোনের বিরোধিতা করে ২০১৩ সালে এএফডি (জার্মানির জন্য বিকল্প) নামক একটি দলের জন্ম হয়৷ সেই সময় সংকটে থাকা গ্রিসকে সহায়তা করতে কোটি কোটি টাকা দেয়া হচ্ছিল৷ এর মধ্যে জার্মানদের করের টাকাও ছিল৷ অন্য দেশকে কেন নিজেদের টাকা দিতে হবে, সেই প্রশ্ন তুলেছিল এএফডি৷
২০১৩ সালের জার্মান নির্বাচনের আগে গড়ে ওঠা দলটি ঐ নির্বাচনে পাঁচ শতাংশের কম ভোট পাওয়ায় সংসদে যেতে পারেনি৷ তবে চার বছর পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে উঠে আসে তারা৷ ১২.৬ শতাংশ ভোটারের সমর্থন পায় এএফডি৷ এই চার বছরে ইউরোজোনের বিরোধিতা করার পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক শরণার্থীকে জার্মানিতে আশ্রয় দেয়ার সমালোচনাও করে তারা৷
এএফডির ভোট বাড়ার কারণে জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের দল ও তাঁর জোটসঙ্গী দলের ভোট কমে যায়৷ ব্যক্তি হিসেবে ম্যার্কেলের সমর্থনও কমতে থাকে৷ এক পর্যায়ে পরিস্থিতি এমন হয়ে ওঠে যে, ম্যার্কেলকে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সমাপ্তির ঘোষণা দিতে হয়েছে৷
জাতীয় নির্বাচন ছাড়াও রাজ্য নির্বাচনগুলোতে প্রধান দুই দলকে চিন্তায় ফেলে দেয়ার মতো ফল করেছে এএফডি৷
এর মানে হচ্ছে, অভিবাসন ও ইসলামবিরোধী দল হিসেবে পরিচিত এএফডির প্রতি ভোটারদের আগ্রহ বাড়ছে৷ এই অবস্থায় অনেক জার্মানের আলোচনায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার পরিস্থিতি উঠে আসছে৷ সেই সময় হিটলারের প্রতি জার্মানদের অন্ধ সমর্থনের পরিণতি কী হয়েছিল, তা নিয়ে কথা হচ্ছে৷
প্রিয় পাঠক, এতক্ষণ পড়ে কি আপনার মনে হচ্ছে, কেন যে ব্লগটা পড়তে গেলাম? এসব কথাবার্তাতো নিউজেই পড়ি৷ ব্লগে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা না থাকলে সেটা আবার ব্লগ কীসের?
তাহলে শুনুন, আমার জার্মানিতে আসা প্রায় দশ বছর হয়ে যাচ্ছে৷ অর্থাৎ এএফডির জন্মের আগে জার্মানিতে এসেছি৷ তখন বিদেশি হিসেবে সাধারণ জার্মানদের কাছ থেকে যেমন আচরণ পেয়েছি, এখন তার অভাব অনুভব করছি৷ আগে সকালবেলায় অপরিচিত জার্মানরাও হাসিমুখে ‘গ্যুটেন মর্গেন' বা শুভ সকাল বলতেন৷ এখন তেমনটা হয় না বললেই চলে৷ সুপারমার্কেটে গেলে অনেক ক্যাশিয়ারের আচরণেও অবাক হই৷ জার্মান কারও সঙ্গে কথা বলার পর যখন তাঁরা বিদেশি বা বাদামি রংয়ের কারও চেহারা দেখতে পান, সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের মুখের অভিব্যক্তিতে পরিবর্তন চলে আসে৷
এছাড়া প্রাথমিক স্কুলপড়ুয়া ছেলের অভিজ্ঞতা থেকেও অনেক কিছু জানতে পারছি৷ যেমন তার ক্লাসের এক জার্মান সহপাঠী নাকি একবার বাদামি কারও পাশে সে বসবে না, বলে মন্তব্য করেছিল৷
আরেকবার বাইরে থেকে নতুন আসা এক শিক্ষার্থী ঠিকমতো জার্মান বলতে না পারায় তারই একদল জার্মান সহপাঠী তাকে বলেছিল, ‘‘এই ছেলে, তুমি জার্মানিতে আছ, তোমাকে জার্মান বলতে হবে৷''
অনেক পাঠক হয়ত এই কথায় ঐ জার্মান ছেলেগুলোর কোনো দোষ দেখবেন না৷ কিন্তু যখন জানবেন, ঐ কথা বলার সময় তাদের কণ্ঠে শ্লেষের ছোঁয়া ছিল, তখন জানবেন, বিষয়টি চিন্তার৷ কারণ অল্পবয়সি এই শিশুদেরতো এখনই এভাবে ভাবার কথা নয়৷ নিশ্চয় তাদের পরিবারে বিষয়গুলো এভাবেই আলোচিত হয়ে থাকে, তাই তারাও এভাবে বেড়ে উঠছে৷
আর এএফডির জনপ্রিয়তা থেকে বোঝা যায়, এমন পরিবারের সংখ্যা কম নয়৷ এভাবে বর্তমান প্রজন্মের আচরণ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যেও ঢুকে পড়ছে৷ সে কারণেই বিষয়টি চিন্তার হয়ে উঠছে৷
জার্মান সরকার এই পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছে৷ প্রেসিডেন্ট, চ্যান্সেলরসহ অন্য রাজনীতিবিদরা জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে সবাইকে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন৷ দেখা যাক, কী হয়৷
প্রিয় পাঠক, এবার লেখার শিরোনামে ফিরে যান৷ বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় জার্মান জাতির মনে জাতীয়তাবাদ জেগে ওঠায় কি ভালো হয়েছে, নাকি তাদের আগের মানসিক অবস্থাটাই ভালো ছিল, তা এবার নিজেই ভেবে দেখুন৷
জাহিদুল হকের ব্লগ-পোস্টটি কেমন লাগলো জানান বন্ধুরা, লিখুন নীচের ঘরে৷