1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
দুর্নীতিবাংলাদেশ

বাদামি খাম দিয়ে সাংবাদিক কেনা যায়, সাংবাদিকতাকে নয়

৫ জুলাই ২০২৪

​​​​​​ছাগল-কাণ্ডে জড়িত এনবিআরের কর্মকর্তা মতিউর রহমানের স্ত্রী লায়লা কানিজের একটি বক্তব্য বাংলাদেশের সাংবাদিক সমাজ ও সংগঠনগুলোর মধ্যে বেশ হৈ চৈ ফেলে দিয়েছে৷

https://p.dw.com/p/4hu12
হাতবদল করা সাদা খামের ভেতরে ৫০ ইউরোর কয়েকটি নোট
অনুকূল সংবাদ কাভারেজ বা নেতিবাচক তথ্য দমন করতে সাংবাদিকদের আর্থিক বা অন্যান্য প্রণোদনা গ্রহণ করার চর্চা বাদামি খাম সাংবাদিকতা নামে পরিচিতছবি: Josef Horazny/CTK/picture alliance

মতিউর ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে টানা গণমাধ্যমে খবর পরিবেশন করে আসছিল৷

এরইমধ্যে হঠাৎ করে লায়লা কানিজ বলেন, ‘বড় বড় সাংবাদিককে কিনেই তারপর এসেছি, সব থেমে যাবে'৷ তার এই বক্তব্য যদি সত্যি হয় তাহলে ‘ইঁদুর-বেড়ালের বন্ধুত্বের' মতো একটি অতিশয় অস্বাভাবিক ঘটনা বাংলাদেশের গণমাধ্যম জগতে ঘটেছে বলে ধরে নেয়া যেতে পারে৷ প্রশ্ন হলো, সাংবাদিককে কি সত্যি কেনা যায়? একটু ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করা যায়, সাংবাদিক কি বিক্রি হয়? উত্তর হলো, বাংলাদেশে সাংবাদিক কেনা-বেচা হয়, তবে সাংবাদিকতা কেনা-বেচা করা যায় না৷ এটা শুধু বাংলাদেশে না, কোনো দেশেই সাংবাদিকতাকে কেনা যায় না৷ যেমনটা বলা হয়, প্রভাবশালীরা একটি স্টোরিকে ধামাচাপা দিতে পারে, একজন সাংবাদিককে মেরে ফেলতে পারে, কিন্তু সাংবাদিকতা খুন করতে পারে না৷ কবি মহাদেব সাহার ভাষায় যেটি হলো, ‘যতোই চাও না কেন আমার কণ্ঠ তুমি থামাতে পারবে না, যতোই করবে রুদ্ধ ততোই দেখবে আমি ধ্বনি-প্রতিধ্বনিময়৷‘ সাংবাদিকতার বিনাশ হয় না৷ কারণ জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনো পেশার বিনাশ সম্ভব নয়৷

সাংবাদিক কেনা নিয়ে লায়লা কানিজের বক্তব্যটিকে তিনভাবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে৷ একটি ইতিবাচক, অন্যটি নেতিবাচক এবং তৃতীয়টি আশঙ্কাজনক৷ ইতিবাচক দিকটি হলোদুর্নীতিবাজরা সাধারণত প্রশাসন, দুদক, পুলিশ ও বিচার বিভাগকে ম্যানেজ করেই নিজেদের দুর্নীতির কাহিনী লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতে চান৷ সেক্ষেত্রে এই প্রথম কেউ একজন বললেন, তিনি সাংবাদিকদের ম্যানেজ করে তার ও তার পরিবারের দুর্নীতির কাহিনীর প্রচার থামিয়ে দিতে পারবেন৷ অর্থাৎ বাংলাদেশে দুর্নীতিবাজদের জন্য এখন চক্ষুশূলের বিষয় হলো সাংবাদিকতা আর শত্রু হলো সাংবাদিকরা যাদের কিনতে পারলেই প্রশাসন, দুদক ও বিচার বিভাগ কোনো সমস্যা নয়৷ সেদিক থেকে তার এই বক্তব্যের একটি অর্থ হতে পারে বাংলাদেশে এখনও জনস্বার্থ বিষয়ক সাংবাদিকতার ইতি ঘটেনি৷ কিছু গণমাধ্যম এবং সাংবাদিক এখনও দুর্নীতিবাজদের আড়াল করে রাখা তথ্য জনসমক্ষে আনার জন্য কমবেশি চেষ্টা যে করেন সেটি প্রতীয়মান হয়৷

নেতিবাচক দিকটি হলো, লায়লা কানিজের এই বক্তব্য আমাদেরকে বার্তা দেয় যে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের কেনা যায় বা তারা বিক্রি হয়৷ বাংলাদেশের সাংবাদিক সমাজের মধ্যে একেবারেই নিজস্ব আড্ডায় এতদিন ধরে সাংবাদিকদের দুর্নীতি নিয়ে ফিসফাস আলোচনা হতো৷ কিন্তু লায়লা কানিজের বক্তব্যে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি কোনো এক-দুইজন সাংবাদিকের কথা বলেননি৷ বরং তিনি বড় বড় সাংবাদিককে কেনার কথা বলেছেন৷ বাংলাদেশের সাংবাদিকদের মধ্যে যারা মতমোড়ল টাইপের, যাদেরকে আমরা গেটকিপার হিসেবে বিবেচনা করি অর্থাৎ যারা সিদ্ধান্ত নেয়ার ও পরিবর্তনের ক্ষমতা রাখেন, ক্ষমতাসীনদের সাথে অনেক দহরম-মহরম থাকে এমন সাংবাদিকদের বাংলাদেশের বর্তমান গণমাধ্যম ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে বড় বড় বা রাঘববোয়াল সাংবাদিক বলা যায়৷ এসব রাঘববোয়াল সাংবাদিকদের কেনা সম্ভব হয়েছে বলে লায়লা কানিজ যে মন্তব্য করেছেন সেটি বাংলাদেশের সাংবাদিকদের ব্যক্তিগত দুর্নীতির চেয়ে গণমাধ্যম ব্যবস্থার সামষ্টিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পেশাগত অবনমনের চিত্র সম্পর্কে আলোকপাত করে৷ অন্যদিকে আশঙ্কাজনক দিকটি হলো, লায়লা কানিজের বড় বড় সাংবাদিক কেনার এই মডেল যদি সফল হয় তাহলে সেটির চর্চার প্রসার ঘটাতে দুর্নীতিবাজরা আরো বিনিয়োগ করবে৷

যে কোনো মন্তব্য, বাক্য ও শব্দ নানা অর্থ ধারণ করতে পারে, নানা বোধ ছড়াতে পারে৷ কনটেক্সট বা প্রেক্ষাপটের আলোকে বাক্য ও শব্দের ব্যাপকতার এই ভিন্নতা অনেক ধরনের মাত্রা পেয়ে থাকে৷ গরু-ছাগলের বিরাট হাটের মতো আপাতদৃষ্টিতে এমন কোনো হাট নেই যেখানে ছোট-বড় সাংবাদিক বিক্রি হয়৷ বড় বড় সাংবাদিক কেনার অর্থ হলো এমন নতজানু গণমাধ্যম ব্যবস্থা যেখানে প্রভাবশালীরা নানা উপায়ে নিজেদের মত করে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের এজেন্ডা নির্ধারণ করতে পারে৷ গত এক-দুই দশকে বাংলাদেশের সাংবাদিকতার পেশার মানের যে অবনমন ঘটেছে সেটা বুঝার জন্য খুব বেশি পণ্ডিত হওয়ার দরকার নেই৷ এই অবনমনের মাত্রা যে বেশ দ্রুত ঘটছে তার প্রতিফলন লায়লা কানিজের মন্তব্য৷ দু-একজন সাংবাদিকের দুর্নীতি কিংবা কিছু ভুঁইফোঁড় সাংবাদিকের চাঁদাবাজির ঘটনার জন্য পেশার এমন পদ্ধতি ও প্রক্রিয়াগত অবনমন ঘটতে পারে না৷ কারণ গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতা শুধু একটি পেশা নয়৷ এটি একটি ব্যবস্থা ও প্রক্রিয়া৷ একটি দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা – রাজনৈতিক ব্যবস্থার সাথে এটি অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্পর্কিত৷

লায়লা কানিজ বড় বড় সাংবাদিক কেনার যে মন্তব্য করেছেন গণমাধ্যম নীতিশাস্ত্রে তার একটি নাম আছে৷ সেটি হলো ব্রাউন এনভেলপ জার্নালিজম বা বাদামি খাম সাংবাদিকতা, যাকে সংক্ষেপে বিইজে বলে৷ বিশ্বব্যাপী অনুকূল সংবাদ কাভারেজ বা নেতিবাচক তথ্য দমন করতে সাংবাদিকদের আর্থিক বা অন্যান্য প্রণোদনা গ্রহণ করার চর্চাকে বিইজে বলা হয়৷ তানজানিয়া, নাইজেরিয়া, ঘানা ও কুয়েতে সাম্প্রতিক সময়ে বিইজে নিয়ে বেশ কিছু গবেষণা হয়েছে৷ সাংবাদিকদের এই চর্চার দেশভিত্তিক বিভিন্ন নামও আছে৷ যেমন ঘানায় সোলি, ক্যামেরুনে গাম্বো নামে পরিচিত৷ যে নামেই পরিচিত হোক না কেন গবেষণা থেকে এটি প্রমাণিত হয়েছে যে, বিইজের চর্চা বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা বা অভ্যাস নয়৷ বরং একটি দেশের গণমাধ্যম ব্যবস্থার সাথে রাজনৈতিক ব্যবস্থার নিয়ত নিবর্তনমূলক সম্পর্কের দীর্ঘমেয়াদি চর্চার কারণে ধীরে ধীরে বিইজে একটি সংক্রামক অভ্যাসে পরিণত হয়৷ অর্থাৎ বিইজে প্রতিষ্ঠার মুখ্য ক্রীড়ানক দুর্নীতিপরায়ণ সাংবাদিক নয়, বরং দুর্নীতিগ্রস্ত গণমাধ্যম ব্যবস্থাই সাংবাদিকদের কেনার পরিবেশ তৈরি করে দেয়৷ যার অর্থ হলো নতজানু গণমাধ্যম ব্যবস্থাই দুর্নীতিবাজ সাংবাদিকের জন্ম দেয়৷  

বাংলাদেশের সাংবাদিক ও গণমাধ্যম ব্যবস্থায় সামষ্টিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নতজানু ব্যবস্থার বিস্তার হঠাৎ করে হয়েছে এমনটা নয়৷ স্বাধীনতার পর থেকে নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত বাংলাদেশের গণমাধ্যম ব্যবস্থাকে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল৷ কিন্তু রাষ্ট্রীয় চাপের কারণে তখন দেশের প্রধান সারির পত্রিকাগুলোকে ভেঙ্গে পড়তে আমরা দেখিনি৷ বরং স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলন বেগবান হওয়ার পেছনে গণমাধ্যমের অবদান কোনো অংশে কম ছিল না৷ তবে বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের পেশাগত সামষ্টিক দুর্নীতির গোড়াপত্তন হয়েছিল ২০০৭ সালে ওয়ান ইলেভেনের পর৷ দুটো প্রক্রিয়া এই গোড়াপত্তনের সাথে জড়িত ছিল৷ এক, দুর্নীতি দমনের নামে সেনাসমর্থিত সরকারের সরবরাহকৃত তথ্য যাচাই-বাছাই ছাড়া প্রকাশ করা; এবং দুই, ওই সেনাসমর্থিত সরকারের তালিকায় থাকা দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলাদের বাঁচাতে সাংবাদিকদের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা পালন৷ এই দুটি ধারায় বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় যে নতজানু অভ্যাসের চর্চা শুরু হয়েছিল সেটি ধীরে ধীরে সংক্রামক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে৷ ওয়ান ইলেভেনের সময় একটি রাষ্ট্রীয় সংস্থার দেয়া তথ্য অবাধে প্রকাশ করতো দেশের বেশিরভাগ জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী গণমাধ্যমগুলো৷  ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর প্রায় সবগুলো রাষ্ট্রীয় সংস্থার দেয়া তথ্য যাচাই-বাছাই ছাড়া প্রকাশ করা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে৷ বিশেষ করে ২০১৫ সালে রাষ্ট্রীয় একটি সংস্থার হস্তক্ষেপে বাংলাদেশের দুটি প্রধান পত্রিকার বেসরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনার পর থেকে নতজানু সাংবাদিকতার বিস্তার ঘটেছে বেশি৷   

২০০৭ সালের আগে বাংলাদেশের গণমাধ্যম ব্যবস্থা রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর কর্তৃত্ব করতো৷ রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে সরকারি সংস্থাগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ ও  মতামতকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতো৷ গণমাধ্যমের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী রাষ্ট্রের রাজনীতি ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিজেদের কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতো৷ গণমাধ্যম শাস্ত্রের ভাষায় এটিকে বলা হয়, মিডিয়াটাইজেশন অব পলিটিক্স বা রাজনীতির গণমাধ্যমীকরণ৷ রাজনীতির গণমাধ্যমীকরণ ঘটলে গণমাধ্যম ব্যবস্থার দুর্বৃত্তায়ন সম্ভব হয় না৷ কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে বাংলাদেশের গণমাধ্যম ব্যবস্থা ঠিক উল্টো চিত্র ধারণ করেছে৷ গত এক দশকে শুধু রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দল নয়, সাথে রাষ্ট্রীয় সংস্থার মর্জিমত সংবাদ ও তথ্য পরিবেশন গণমাধ্যমের নিয়ত চর্চায় পরিণত হয়েছে৷ যেটি আগে ছিল সখ্যতার সম্পর্ক সেটি এখন ক্লায়েন্টের সম্পর্কে রূপ নিয়েছে৷ ফলশ্রুতিতে পলিটিক্যাল প্যারালিজমের সাথে ক্লায়েন্টিলিজমের এক অদ্ভুত মিশ্রণ ঘটেছে বাংলাদেশের গণমাধ্যম ব্যবস্থায় যেটি সচরাচর অন্যান্য দেশে দেখা যায় না৷ গণমাধ্যম শাস্ত্র অনুযায়ী এ দুটির মিশ্রণ যখন ঘটে তখন পলিটিক্যাল ইন্সুট্রুমেন্টালাইজেশন বা গণমাধ্যমের রাজনৈতিক প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ রূপ লাভ করে৷ যখন সামষ্টিক এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গণমাধ্যম ব্যবস্থার রাজনীতিকরণ হয় তখন সে দেশের সাংবাদিকদের বাদামি রঙের খাম দিয়ে কেনার চর্চা বাড়তে থাকে৷

বাংলাদেশের গণমাধ্যম ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো সরকারের ডিএফপি নির্ধারিত পত্রিকার প্রচার সংখ্যা৷ ডিএফপির যে কর্মকর্তা পত্রিকার প্রচার সংখ্যায় স্বাক্ষর করেন তিনিও জানেন বাংলাদেশের মানুষের শিক্ষা ও অর্থনৈতিক সক্ষমতা বিবেচনা করলে বাস্তবে এত পত্রিকা ও পাঠকসংখ্যা থাকা বিজ্ঞানসম্মত নয়৷ কিন্তু দিনের পর দিন এমন অবাস্তব পত্রিকার সংখ্যা ও এগুলোর প্রচারসংখ্যা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে৷ এটি বাংলাদেশের গণমাধ্যম ব্যবস্থার পলিটিক্যাল প্যারালিলিজম ও ক্লায়েন্টিলিজমের বড় উদাহরণ৷ আবার গত দুই দশকে যতগুলো টিভির লাইসেন্স দেয়া হয়েছে সেগুলোর একমাত্র বিবেচনা রাজনৈতিক সখ্যতা৷ যে কারণে টিভি চ্যানেলগুলোর বেশিরভাগই সরকার ও মালিকপক্ষের রাজনৈতিক ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে৷ রাজনৈতিক বিবেচনায় লাইসেন্স পাওয়া এসব কম বাজেটের গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে ‘ক' লিখতে ‘কলম' ভেঙ্গে যাওয়ার মত সাংবাদিক অহরহ জন্ম নিচ্ছে৷ পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের সাংবাদিকরা পেশাগত পরিচয় সঙ্কটের মধ্যে ভুগছেন৷ সাংবাদিকতা যখন পেশাগত ‍আত্মপরিচয়ের সঙ্কটে ভুগে তখন ছদ্মবেশী আবরণের মধ্যে পড়ে যায়৷ এই ছদ্মবেশের মুখোশ খুলে গেলে বাদামি খামের গল্প প্রকাশ পায়৷ 

একটি দেশের গণমাধ্যম ব্যবস্থা কতটা শক্তিশালী তা নির্ভর করে সে দেশের সাংবাদিক, সংবাদপ্রতিষ্ঠান ও সাংবাদিক সংগঠনগুলো কতটা পেশাদারিত্বে ভিত্তিতে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে তার উপর৷ এর সাথে সততা, বস্তুনিষ্ঠতা এবং নিরপেক্ষতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত৷ শুধু সংবাদপ্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষ এবং কর্তাব্যক্তিরা নয়, বাংলাদেশের সাংবাদিক সংগঠনগুলোর দিকে তাকালেও দেখা যাবে, গত দুই দশকে বেশিরভাগ সাংবাদিক সংগঠনে কীভাবে দলীয়করণ ও দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে৷ বাংলাদেশে এখন গ্রাহক সক্ষমতার চেয়ে গণমাধ্যমের সংখ্যা বেশি, গণমাধ্যম অনুপাতে সাংবাদিক বেশি, সাংবাদিক অনুপাতে সাংবাদিক সংগঠনের সংখ্যা বেশি৷ বর্তমানে প্রতিটি জেলায় যেমন একাধিক প্রেস ক্লাব আছে তেমনি প্রতিটি বিটে একটি করে সাংবাদিক সংগঠন আছে৷ এসব সংগঠনের বেশির ভাগ পিকনিক, বার্ষিক কর্মসূচি পালনের নামে এক ধরনের নীরব চাঁদাবাজিতে জড়িত বলে অভিযোগ আছে৷ এসব সংগঠনের কোনো জবাবদিহি নেই৷ বাংলাদেশে এতগুলো সাংবাদিক সংগঠন থাকা সত্ত্বেও অল্প কয়েকটি সংগঠন লায়লা কানিজের বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছে৷ অথচ পুরো পেশা ও পেশাজীবীদের বিরুদ্ধে এমন ঢালাও অভিযোগের পর অবশ্যই সাংবাদিক সংগঠনের পক্ষ থেকে মানহানির অভিযোগে মামলা দায়ের করা উচিত ছিল৷

পেশার ধরন ও চরিত্র হিসেবে সাংবাদিকরা থাকবেন দল নিরপেক্ষ৷ নৈতিকতার মানদণ্ডে পেশাদারিত্ব ও দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করতে হলে এটাই স্বাভাবিক৷ কিন্তু বাংলাদেশের সাংবাদিক নেতারা দুই ভাগে ভাগ হতেই বেশি পছন্দ করেন৷ এ ধরনের চর্চা ধারাবাহিক অনুশীলনে পরিণত হলে বাদামি খামের সাংবাদিকতা বিস্তার লাভ করবে এমনটাই স্বাভাবিক৷ যেমন, গত মে মাসে বাংলাদেশে একটি বেসরকারি ব্যাংক সংবাদ সম্মেলন শেষে নাস্তার প্যাকেটের ভেতরে সাংবাদিকদের পাঁচ হাজার টাকার একটি প্যাকেট দিয়েছিল৷ এতে অনেক সাংবাদিক বিব্রত হলেও একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এমন উদ্যোগ আসলে দীর্ঘদিন ধরে গণমাধ্যম ব্যবস্থার নতজানু ও সখ্যতার চর্চার বহিঃপ্রকাশ৷ অনেকদিন বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের একটি অভিযোগ হলো, মানুষ তার কণ্ঠস্বর এখন আর গণমাধ্যমে শুনতে পায় না৷ সংবাদমাধ্যমে যা কিছু প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, তার একটি বড় অংশই অসত্য, বিকৃত ও বিভ্রান্তিকর৷ এতে আস্থার সংকট বাড়ছে যেটি সাংবাদিকদের পেশাগত সঙ্কটগুলোর পরিধি ও ব্যাপকতা বাড়িয়ে দিচ্ছে৷

বাংলাদেশে এমন কোনো পেশা নেই যেখানে অসৎ লোক নেই৷ ফলে বাংলাদেশে সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের পেশাজীবীদের মধ্যে দুর্নীতিপরায়ণ লোক আছে৷ এটা শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর অন্য দেশেও আছে৷ কোনো পেশার এক বা দুইজন ব্যক্তির দুর্নীতির কারণে ওই পেশার সেবাগ্রহীতার সাময়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে৷ তাতে পুরো পেশার মান ও সেবা সার্বিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে না৷ কিন্তু যখন একটি পেশার উঁচুস্তরের লোকজন, পেশার মান নির্ধারকগণ, পেশাটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংগঠন এবং সংগঠনের কর্তাব্যক্তিরা, পেশা সম্পর্কিত পরিচালনা কাঠামো এবং ব্যবস্থার সাথে জড়িত সরকারি-বেসরকারি কর্তাব্যক্তিরা একইসাথে দুর্নীতি আর অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন তখন সেই পেশায় পঁচন ধরতে বাধ্য৷ মনে রাখতে হবে, সাংবাদিকতা কখনই মানুষকে রক্ষা করতে না পারে যদি দেশের রাজনীতি ও গণমাধ্যম ব্যবস্থা সাংবাদিকতাকে রক্ষা না করে৷ এত সঙ্কটের মধ্যে বাংলাদেশে জনস্বার্থমূলক ও জবাবদিহিমূলক সাংবাদিকতা হচ্ছে৷ এই পেশার সাথে জড়িত সবাই খারাপ হলে নাস্তার প্যাকেটে যে খাম দেয়া হয়েছিল সেটি পেয়ে উপস্থিত সকলেই গদগদ হয়ে যেতো৷ রাষ্ট্র, রাষ্ট্রীয় সংস্থা, রাজনৈতিক দল, নেতা সকলেই চান দেশের সব সাংবাদিক তাদের মর্জিমত সংবাদ ও তথ্য পরিবেশন করুক৷ এটা সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার নিয়ত চ্যালেঞ্জ৷ এ চ্যালেঞ্জকে পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে সাংবাদিকতা বাংলাদেশে হচ্ছে৷ কিন্তু বাদামি খামের সাংবাদিকতা যদি পরিমাণে, চর্চায় ও সংখ্যায় বেড়ে যায় তখন অশনি সঙ্কেত দেখা দিবে৷ খারাপ মুদ্রা যেভাবে ভাল মুদ্রাকে বাজার থেকে বিদায় করে তেমনি খারাপ সাংবাদিকতাও ভাল সাংবাদিকতাকে বিতাড়িত করতে পারে৷ এটাই আশঙ্কার বিষয়৷ তবে আশার কথা হলো, বাদামি খামের সাংবাদিকতা নিয়ে গবেষণাগুলোতে দেখা গেছে, অর্থ ও অন্যান্য প্রলোভনের মাধ্যমে কিছু সংখ্যক এমনকি কখনও কখনও বাঘা বাঘা সাংবাদিক কেনা সম্ভব হলেও পেশা হিসেবে সাংবাদিকতার যে স্পিরিট সেটাকে কেনা সম্ভব হয় না৷ কারণ আগাছা বনাঞ্চলের জায়গা দখল করতে পারলেও মূল বৃক্ষগুলোর আড়ালেই তাকে থাকতে হয়৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান