বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়ে আসছে৷ এরপর বিভিন্ন সময়ে এই সম্পর্কে যোগ হয়েছে নানা মাত্রা৷ বর্তমানে দেশটি বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি-গন্তব্য এবং রেমিটেন্সের অন্যতম উৎস৷
বাংলাদেশের জন্মের বিরোধিতা
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বিরোধিতা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷ যুদ্ধে তাণ্ডবলীলা চালাতে পাকিস্তান যে সব ব্যবহার করে, তার মধ্যে বহু অস্ত্রই যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি৷ এমনকি তারা বাংলাদেশ অভিমুখে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে নতুন এই রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঠেকাতে চেয়েছিল৷ পাকিস্তানের পরাজয় ঠেকাতে জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব আনারও উদ্যোগ নিয়েছিলো যুক্তরাষ্ট্র৷ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূকিকায় এসব নস্যাৎ হয়ে যায়৷
শেষ পর্যন্ত স্বীকৃতি
যুদ্ধের সময় মার্কিন সরকার বাংলাদেশের বিরোধিতা করলেও দেশটির বহু মানুষ বাংলাদেশের পক্ষে প্রচার-প্রচারণা এবং তহবিল সংগ্রহে ভূমিকা রাখে৷ পাকিস্তানের মানবাধিকার লঙ্ঘণের বিরুদ্ধেও তাঁরা সরব হন৷ শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ স্বাধীন হলে দৃশ্যত অবস্থান বদলায় মার্কিন সরকার৷ স্বীকৃতি দেয় বাংলাদেশকে৷ তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি রোধে দেশটির তৎপরতা দেখা গেছে৷
বিনিয়োগ ও উন্নয়নে
স্বাধীনতার পরপরই বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷ নতুন দেশটির উন্নয়নে অংশীদারিত্বের পাশাপাশি বিভিন্ন বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়েও যায় তারা৷ ইউএসএইড-এর মতে, বর্তমানে তাদের অন্যতম বৃহৎ ‘ফরেন এইড মিশন’ রয়েছে বাংলাদেশে৷ অবশ্য শেভরন, কনকো ফিলিপের মতো জ্বালানি খাতে মার্কিন বিনিয়োগকারীদের নিয়ে দেশে ব্যাপক সমালোচনাও রয়েছে৷
বাংলাদেশের রপ্তানি বাজার
একক দেশ হিসাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷ দেশটির সঙ্গে বাণিজ্যে আবার আমদানি-রপ্তানির হিসাব বাংলাদেশের অনুকূলে রয়েছে৷ গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি রপ্তানির মধ্যে ৬ বিলিয়নই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে৷
রেমিটেন্স
২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ প্রবাসী আয়ের ১ হাজার ৫৩২ কোটি মার্কিন ডলারের যে রেকর্ড হয়, তার মধ্যে ২৩৮ কোটি ডলারই এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে৷ দীর্ঘদিন যাবত দেশটি বাংলাদেশর প্রবাসী আয়ের শীর্ষ ৫ দেশের মধ্যে থাকছে৷
তৈরি পোশাক
বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক৷ এই পণ্যও সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে৷ তবে সাম্প্রতিক সময়ে এই রপ্তানি কিছুটা পড়তির দিকে৷
জিএসপি
জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্সেস বা অগ্রাধিকারমূলক বাজার-সুবিধা (জিএসপি) আওতায় শুল্কমুক্ত সুবিধায় যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি করা যায়৷ যদিও তৈরি পোশাকখাত কোনোদিনই এই সুবিধা পায়নি, তথাপি রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য এই সুবিধা বাতিল করে দেয়৷ বাংলাদেশ সরকার এখন বলছে, জিএসপি সুবিধা পাওয়া পণ্যের রপ্তানির পরিমাণ কম হওয়ায় এটা কেবল মর্যাদার প্রশ্ন হয়ে আছে৷
ট্রাম্পযুগ
গ্রামীণ ব্যাংক থেকে মুহাম্মদ ইউনূসকে অপসারণের ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিন্টনের সঙ্গে বাংলাদেশের তিক্ততার পর আসে মার্কিন নির্বাচন৷ সেখানে মুসলিমবিরোধী নানা মন্তব্য করলেও ট্রাম্প জিতে যাওয়ার পর মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে সবার আগে উষ্ণ অভিনন্দন জানায় বাংলাদেশ সরকার৷
টিপিপি বাতিল
ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ বা টিপিপি চুক্তিতে বাংলাদেশ সরাসরি ছিল না৷ তবে এটা ঘিরে বাংলাদেশের উদ্বেগ ছিল৷ কারণ, এই চুক্তি বাস্তবায়িত হলে ভিয়েতনাম পোশাক রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়ে যেতো৷ তাতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের প্রধান এই রপ্তানি পণ্য অসম প্রতিযোগিতার মুখে পড়তো৷ নির্বাচনী অঙ্গীকার অনুসারে ট্রাম্প এই চুক্তি বাতিল করলে বাংলাদেশ সরকার থেকে অভিনন্দনও জানানো হয়৷
ভূ-রাজনীতি
অদূরে চীন, পাশেই ভারত৷ সীমান্ত রয়েছে চীনের দীর্ঘদিনের মিত্র মিয়ানমারের সঙ্গেও৷ ভূ-কৌশলগত অবস্থানের কারণেই বাংলাদেশ বিশেষ গুরুত্ব পায় বড় শক্তিগুলোর কাছে৷ সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশ স্বল্প উন্নত দেশগুলোর পক্ষে ভূমিকা রেখেও আলাদা অবস্থান তৈরি করেছে৷
প্যারিস জলবায়ু চুক্তি
জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় ভূক্তভোগী দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ৷ এই চুক্তির আওতায় প্রতি বছর উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ১ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দের কথা রয়েছে৷ ট্রাম্প এই চুক্তি থেকে সরে যাওয়ায় টান পড়বে এই অর্থ জোগানে৷ এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র কার্বন নিঃসরণ না কমালে এর ফল ভোগ করতে হবে বাংলাদেশকেও৷
শান্তিরক্ষী বাহিনী
জাতিসংঘ পরিচালিত শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের বড় একটা অংশ বাংলাদেশের৷ এটা বাংলাদেশের বৈদেশিক আয়েরও একটা উৎসে পরিণত হয়েছে৷ অন্যদিকে জাতিসংঘের বাজেটের বড় একটা অংশ আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে, যা কমিয়ে দেয়ার প্রস্তাব করেছেন ট্রাম্প৷ সেক্ষেত্রে শান্তিরক্ষা মিশনসহ অনেক কাজ পরিচালনা প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে বলে জানায় সংস্থাটির এক মুখপাত্র৷ এটা উদ্বেগে ফেলেছে বাংলাদেশকেও৷
অভিবাসন নীতি
যুক্তরাষ্ট্র অবৈধ অভিবাসী কমাতে ট্রাম্পের নানা পদক্ষেপ সমস্যায় ফেলবে সেখানে থাকা অনেক প্রবাসী বাংলাদেশিকে৷
গণতন্ত্র ও মানবাধিকার
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কে বড় একটা জায়গা জুড়ে থাকে দেশটির গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতি৷ বাংলাদেশে নিয়োগ পাওয়া মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে প্রায়ই এটা নিয়ে কথা বলতে বা সক্রিয় হতে দেখা যায়৷