বাংলাদেশে কোটা আন্দোলন নিয়ে আলোচিত মন্তব্যগুলো

মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে হাই কোর্টের দেওয়া রায়ের পর আন্দোলনের নামেন শিক্ষার্থীরা৷ ১ জুলাই ঢাকার সমাবেশে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এর অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘‘৪ জুলাইয়ের মধ্যে আইনিভাবে আমাদের দাবির চূড়ান্ত সুরাহা করতে হবে৷’’

৪ জুলাই প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান হাইকোর্টের দেওয়া রায় নিয়ে আপিল বিভাগের শুনানিতে বক্তব্য রাখেন৷ তিনি বলেন, ‘‘এত আন্দোলন কিসের রাস্তায় শুরু হয়েছে? আন্দোলনের চাপ দিয়ে কি হাইকোর্টের রায়, সুপ্রিম কোর্টের রায় পরিবর্তন করবেন?’’

১১ জুলাই সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, অনেকে শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে৷ পানি ঘোলা করার চেষ্টা করছে। শিক্ষার্থীরা ভুলপথে যাবেন না বলেও মন্তব্য করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘‘শিক্ষার্থীরা লিমিট ক্রস (সীমা অতিক্রম) করে যাচ্ছেন৷’’

চীন সফর শেষে ১৪ জুলাই গণভবনে সংবাদ সম্মেলন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘‘কোটা বিষয়ে আমার কিছু করার নেই। মামলার পর আদালত যে রায় দেন, এতে নির্বাহী বিভাগের কিছু করার নেই। আদালতেই সমাধান করতে হবে৷’’ আরেক প্রশ্নের প্রেক্ষিতে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা পাবে না? তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে?’’

১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল শুরুর আগে সাংবাদিকদের ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘‘রাজনৈতিকভাবে এটি (কোটা সংস্কার আন্দোলন) মোকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ যারা আজও এই বাংলাদেশে থেকে ‘আমি রাজাকার’ বলার হিম্মত দেখায়, তাদের শেষ দেখিয়ে ছাড়বে ছাত্রলীগ৷’’

একই দিনে সংবাদ সম্মেলন করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘‘কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’ স্লোগানের জবাব ছাত্রলীগই দেবে৷’’ ১৭ জুলাই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের তিনি বলেন, ‘আমাদের সারা দেশের প্রত্যেক নেতা-কর্মীকে আমাদের নেত্রীর পক্ষ থেকে নির্দেশ দিচ্ছি, সারা দেশে সতর্ক হয়ে শক্ত অবস্থান নিয়ে এ অশুভ অপশক্তিকে প্রতিহত করতে হবে। কোনো অপশক্তির সঙ্গে আপস করা যাবে না৷’’

সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনার পর ১৭ জুলাই জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী৷ তিনি বলেন, ‘‘সর্বোচ্চ আদালতের রায় আসা পর্যন্ত ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার জন্য আমি সকলকে বিশেষভাবে অনুরোধ জানাচ্ছি। আমার বিশ্বাস, আমাদের ছাত্রসমাজ উচ্চ আদালত থেকে ন্যায়বিচারই পাবে, তাদের হতাশ হতে হবে না।’’

১৭ জুলাই বায়তুল মোকাররম মসজিদে গায়েবানা জানাজার পর দেওয়া বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘‘কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বিএনপি সরাসরি জড়িত নয়৷ তবে এ আন্দোলনে বিএনপির নৈতিক সমর্থন রয়েছে৷’’

জাতীয় পার্টির রওশন এরশাদপন্থি দলের নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ (ফাইল ছবিতে বাম থেকে প্রথম) একই দিন সরকারের উদ্দেশে বলেন, ‘‘এ আগুন থামান। এ আগুন নেভানোর দায়িত্ব সরকারের।... সময় খুব কম৷ আমরাও সরকারে (এরশাদ আমলে) ছিলাম। আমরাও এভাবে আন্দোলনকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছিলাম। নূর হোসেন মারা যাওয়ার পর অনেকে বলেছিলেন, টোকাই মারা গেছে, কী হবে? কিন্তু আমি বলেছিলাম, না, এই নূর হোসেন একক কোনো ব্যক্তি নয়।’’

ইন্টারনেট বন্ধ নিয়ে নানা রকমের বক্তব্য দিয়েছেন জুনাইদ আহমেদ পলক৷ ১৮ জুলাই তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্বার্থান্বেষী মহলের নানা গুজব আর অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্য সাময়িকভাবে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছে।’ ২৪ জুলাই ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘‘...ইন্টারনেট বন্ধ করিনি, ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেছে৷’’

২২ জুলাই এক বিবৃতিতে শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘‘প্রতিবাদের অধিকার আদায় করতে গিয়ে যারা সহিংসতার শিকার হয়েছেন , সেই সহিংসতা থামাতে সামর্থের সবটুকু করার জন্য আমি জরুরি ভিত্তিতে জাতিসংঘ ও এবং বিশ্বনেতাদের আহ্বান জানাচ্ছি৷’’ পরে তার এই বিবৃতিকে রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল বলে উল্লেখ করেছেন ওবায়দুল কাদের৷

২৩ জুলাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের কাছে দেওয়া বক্তব্যে হাছান মাহমুদ বলেন, ‘‘দেশে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকার সুযোগ নিয়ে বিদেশে বাংলাদেশ নিয়ে মনগড়া কনটেন্ট (আধেয়) বানিয়ে গুজব ছড়ানোর অপতৎপরতা প্রতিরোধে বিদেশের মিশনগুলো কাজ করছে৷’’ আন্দোলন দমনে জাতিসংঘের লোগো–সংবলিত যান ব্যবহার নিয়ে জাতিসংঘের উদ্বেগের বিষয়ে ২৪ জুলাই তিনি বলেন, ‘‘জাতিসংঘের লোগো ভুলে মোছা হয়নি৷’’

২৩ জুলাই সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনের সমন্বয়কদের একজন নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘‘এত রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আমরা কোটা সংস্কার চাইনি। আমরা সব হতাহতের বিচার চাই। আমাদের চূড়ান্ত দাবি ক্যাম্পাসগুলোতে গিয়ে সবার সঙ্গে আলোচনা করে জাতির সামনে পেশ করতে চাই। আমরা নিরাপত্তাহীনতায় আছি। আমরা এই পরিস্থিতির অবসান চাই। হতাহতের বিচার না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকবে৷’’

নিরাপত্তার স্বার্থে হাসপাতাল থেকে আন্দোলনকারীদের পাঁচ সমন্বয়ককে তুলে আনা হয়েছে বলে জানান ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) প্রধান হারুন অর রশীদ৷ জোর করে তাদের কাছ থেকে বিবৃতি আদায়ের অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ডিবি একটি আস্থার জায়গা। সেখানে কাউকে আটকে রাখা হয় না৷ পরবর্তীতে শুনানিতে হাইকোর্ট বলেন, ‘‘ জাতিকে নিয়ে মশকরা কইরেন না। যাকে নেন ধরে, একটি খাবার টেবিলে বসিয়ে দেন৷’’

২৪ জুলাই নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ‘‘আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর দুর্বৃত্তরা পুলিশ ও অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর পোশাক পরে হামলা চালিয়েছে৷’’

সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা জি এম কাদের ৩১ জুলাই রংপুরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘হেলিকপ্টার থেকে গুলি করা হয়েছে, বহুতল ভবন থেকে গুলি করা হয়েছে৷ এতে অনেক নিরীহ মানুষ মারা গেছে৷ শিশু মারা গেছে৷ যারা মারা গেছে, সরকার এখন পর্যন্ত তাদের সন্ত্রাসী প্রমাণ করতে পারেনি৷ এখানে আমার প্রশ্ন, এই নির্বিচার হত্যা চালালো কেন? সরকার যদি সন্ত্রাসীদের দমন করতে চায়, তাহলে আগে থেকে চিহ্নিত করে দমন করতে পারতো৷’’