ভুলে যাওয়ার ম্যাচে মাহমুদউল্লাহর মনে রাখা সেঞ্চুরি
২৪ অক্টোবর ২০২৩১৪৯ রানের বড় জয় পেয়েছে আফ্রিকার দেশটি।
চিত্রনাট্যটা আপনার খুব পরিচিত। বাংলাদেশ দল প্রতিপক্ষের বিশাল রান পাহাড়ে চাপা পড়ার পর ব্যাট হাতে অসহায় আত্মসমর্পণ করছে- এমন দৃশ্য বাংলাদেশের ক্রিকেটে খুঁজলে বিস্তর পাওয়া যাবে। সেই ইতিহাস আজ আরেকবার ফিরে এলো ওয়াংখেড়েতে। মাহমুদউল্লাহ না থাকলে সেই গল্পটা আরও করুণ হতে পারত বাংলাদেশের।
আসলে ম্যাচের অর্ধেকের আগেই একটা ঝড়ে গল্পের ক্লাইম্যাক্স লেখা হয়ে গেছে। বাংলাদেশ থেকে মুম্বাইয়ের অনেকটা দূরত্ব, বঙ্গোপসাগরে যখন ঘূর্ণিঝড় হামুন চোখ রাঙাতে শুরু করেছে, আরব সাগর তখন নিস্তরঙ্গ। কিন্তু হামুনের হাওয়ার ঝাপটা লাগতে শুরু করল ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে। ডি কক ও ক্লাসেনের সেই ঝড়ে সেই যে উড়ে গেল বাংলাদেশ, এরপর ব্যাটসম্যানরা খড়কুটো ধরে সাগরে ভেসে থাকার চেষ্টা করলেন কেবল।
চেষ্টা বললেও আসলে ভুল বলা হবে। এক মাহমুদউল্লাহ ছাড়া আর কেউ সেটাও বা করলেন কই? একটা দল ৩৮২ রান করে ফেলার পর সেটা তাড়া করে ফেলার সামর্থ্য হয়তো বাংলাদেশের এখনো হয়নি। তবে ব্যাটারদের শরীরী ভাষাতেই পরিষ্কার, এই ম্যাচটা আসলে বাংলাদেশ হেরে গেছে অনেক আগেই।
সেটা কখন, সেটা নিয়েও খুব সংশয় নেই। টসে জিতে যখন সাউথ আফ্রিকা ব্যাটিং নিল, তখনই আসলে বাংলাদেশের আকাশে কালো মেঘের আনাগোণা। যেটা পরে মহাবিপদসংকেত হাতে নিয়ে এসেছেন ডি কক। এই বিশ্বকাপে প্রথম দুই ম্যাচেই দুই সেঞ্চুরি হয়ে গিয়েছিল তার। পরের দুই ম্যাচে রান পাননি, আবার রানে ফেরার জন্য বেছে নিলেন বাংলাদেশকে। ডি ককের বাংলাদেশের বিপক্ষে রেকর্ড দুর্দান্ত, আজ সেঞ্চুরিটা করেছেন একরকম হেসে খেলে। ওয়াংখেড়েতে ব্যানার চোখে পড়ছিল, ‘এই বিশ্বকাপ শেষে অবসর নিও না ডি কক।' সত্যি, এই বিশ্বকাপে যেমন ব্যাটিং করছেন ডি কক, তাতে বিশ্বকাপের পর ওয়ানডে থেকে অবসর নিলে সাউথ আফ্রিকা সমর্থকদের মন খারাপ হবে নিশ্চিত।
অথচ ম্যাচের শুরুটা দুর্দান্ত হতে পারত বাংলাদেশের। দ্বিতীয় ওভারেই মেহেদী হাসান মিরাজকে কাট করতে গিয়ে স্লিপে তুলে দিয়েছিলেন রিজা হেনড্রিক্স, কঠিন ক্যাচটা হাতে জমাতে পারেননি তানজিদ হাসান তামিম। অবশ্য সেটার জন্য বেশি আফসোস করতে হয়নি বাংলাদেশকে। শরিফুল ইসলামের ভেতরের দিকে ঢোকা বলে খানিক পর ১২ রানে বোল্ড হয়ে গিয়েছিলেন হেনড্রিক্স।
সেটা ইনিংসের সপ্তম ওভার। এক ওভার পর আবার উদযাপনের সুযোগ পেয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ। শুরু থেকেই আঁটোসাঁটো বল করতে থাকা মিরাজের বলে এবার এলবিডব্লু হয়ে যান রেসি ভ্যান ডার ডুসেন, আউট হয়ে যান ১ রান করেই। ৩৬ রানে ২ উইকেট ফেলে দিয়ে ম্যাচের লাগাম তখন বাংলাদেশের।
কিন্তু সেটা এরপর নিজেদের করে নেন ডি কক ও অধিনায়ক এইডেন মার্করাম। দুজনের জুটিতে রান উঠেছে তরতর করে, একাধিক বোলার এনেও জুটি ভাঙতে পারছিলেন না অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। শেষ পর্যন্ত জুটিটা ভাঙার জন্য নিজেই আসলেন সাকিব। কিন্তু ততক্ষণে মার্করাম ৬৯ বলে করেছেন ৬০, ডি কক ও মার্করামের জুটিতে রান উঠেছিল ১৩১ রান।
এরপরের গল্পটা ডি কক ও দুর্দান্ত ফর্মে থাকা ক্লাসেনের। ৪০ ওভারের পর দুজনের ঝড়ে এলোমেলো হয়ে গেল বাংলাদেশের বোলিং। সেঞ্চুরির পর মূর্তিমান ত্রাস হয়ে ডি কক সাকিবের ওভার থেকে একাই নিলেন ২১ রান। যখন মনে হচ্ছিল ডি ককের ২০০ও হয়ে যেতে পারে, হাসান মাহমুদের বলে ক্যাচ দিলেন নাসুমকে। তার আগে ১৪০ বলে ১৭৪ রানে এই বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ ইনিংসের কীর্তি নিজের করে নিয়েছেন।ডি কক আউট হলেও ক্লাসেনের ঝড় থামছিলই না। ৩৪ বলে ফিফটির পর সেঞ্চুরির কাছে গিয়েও শেষ পর্যন্ত ৪৯ বলে ৯০ রান করে আউট হয়ে যান ক্লাসেন। শেষ ১০ ওভারে ১৪৪ রান তুলেছিল সাউথ আফ্রিকা, ম্যাচটা আসলে ওখানেই শেষ।
এরপর ফিরে এলো মুম্বাইয়ে ইংল্যান্ড আর সাউথ আফ্রিকার আগের ম্যাচটাই। সেই ম্যাচে এমন রান পাহাড়ের পর ইংলিশ ব্যাটাররা ছিলেন আসা যাওয়ার মিছিলে। আজও বাংলাদেশের সেটাই হলো। শুরুটা তানজিদ হাসান তামিমকে দিয়ে। ১২ রানে তার উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে আসার পরেই শুরু মড়কের।পরের বলেই শান্ত আউট খোঁচা দিয়ে, এই বিশ্বকাপে দুঃস্বপ্নটা শেষ হচ্ছে না বাংলাদেশ সহ অধিনায়কের।
সাকিব আল হাসানের কাছ থেকে দরকার ছিল অধিনায়কোচিত দায়িত্বশীলতার। কিন্তু তিনি বাজে এক শটে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে ফিরলেন ১ রানে। মুশফিকুর রহিম এই বিশ্বকাপে দলের বিপদে কয়েকবারই হাল ধরেছেন। আজ তিনিও যখন ৮ রানে থার্ডম্যানে ক্যাচ দিয়ে ফিরলেন, ৪২ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশ মহা বিপর্যয়ের সামনে। সেই দুঃস্বপ্ন গভীর হলো কাগিসো রাবাদার বলে লিটন দাসের আউটে, ২২ রান করলেও লিটন দাসকে কখনোই স্বচ্ছন্দ মনে হয়নি।
এরপর মাহমুদউল্লাহকে একদিকে চেষ্টা করে গেছেন অন্তত ভদ্রস্থ কিছু করার। প্রথমে মিরাজ, পরে নাসুম কিছুটা সঙ্গ দিয়েছেন তাকে। ১২২ রানে ৭ উইকেট পড়ার পরও অবশ্য ২০০ অনেক দূরের পথ মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের। তবে মাহমুদউল্লাহ আজ লড়াইটা একরকম টেল এন্ডারদের নিয়েই চালিয়ে গেছেন। হাসান মাহমুদ ফিরে যাওয়ার পর মোস্তাফিজকে নিয়ে দলের রান ২০০ পার করেছেন। তখন অপেক্ষা ছিল তার সেঞ্চুরির, শেষ পর্যন্ত পেয়েছেন সেটি। ওয়ানডে ক্যারিয়ারে তার চতুর্থ সেঞ্চুরি, এর তিনটিই বিশ্বকাপে। অথচ বিশ্বকাপের আগে তার ক্যারিয়ারের শেষই দেখে ফেলেছিলেন অনেকে, আজ তার সেঞ্চুরিতে পুরো ড্রেসিংরুম অভিবাদন জানাল। ১১ চার ও চারটি ছয়ে ১১১ বলে ঠিক ১১১ রানের ইনিংসে শেষ পর্যন্ত থামলেন। ম্যাচের ভাগ্য তার অনেক আগেই শেষ, তবে মাহমুদউল্লাহ জানালেন তিনি এখনো ফুরিয়ে যাননি।
তারপরও এই ইনিংসটা বাংলাদেশের জন্য হয়ে থেকেছে সান্ত্বনাই।টানা চার হারে এই বিশ্বকাপ থেকে কিছু পাওয়ার আশার বাতিটা আরও নিভু নিভু হলো বাংলাদেশের। দলের ব্যাটিং, বোলিং থেকে অনেক কিছু নিয়েই অপ্রিয় অনেক প্রশ্ন চলে এলো সামনে। আর সাউথ আফ্রিকা পেল চতুর্থ জয়, সেমিফাইনাল এখন তাদের জন্য মুম্বাইয়ের আকাশ থেকে আরব সাগরের দূরত্বের মতোই বেশ দৃশ্যমান।
সংক্ষিপ্ত স্কোর :
সাউথ আফ্রিকা ৫০ ওভারে ৩৮২/৫ (ডি কক ১৭৪, ক্লাসেন ৯০, মার্করাম ৬০; মাহমুদ ২/৬৭)
বাংলাদেশ ৪৬.৪ ওভারে ২৩৩ (মাহমুদউল্লাহ ১১১; কোয়েটজি ৩/৬২)
ফল: সাউথ আফ্রিকা ১৪৯ রানে জয়ী
ম্যাচসেরা: কুইন্টন ডি কক