1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ফ্যাক্ট চেক: বাংলাদেশে ভারত ‘কৃত্রিম' বন্যা তৈরি করেনি

২৮ আগস্ট ২০২৪

বাংলাদেশে বন্যায় ৫০ লাখেরও বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কিন্তু এটি একটি রাজনৈতিক মোড় নিয়েছে এবং অনেকে এই ভয়াবহ বন্যার জন্য দায়ী করছেন ভারতকে।

https://p.dw.com/p/4k1Of
ফেনীতে বন্যা জল ভেঙে মুরগী নিয়ে যাচ্ছেন এক ব্যক্তি
বন্যায় বাংলাদেশে বাস্তুচ্যূত হয়েছেন লাখ লাখ মানুষছবি: MUNIR UZ ZAMAN/AFP

প্রবল বর্ষার কারণে সম্প্রতি বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের অনেক জেলা প্লাবিত হয়েছে। বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে দাবি করেছেন বন্যাটি ‘কৃত্রিম' এবং ভারত বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী নদীতে বাঁধ ও ব্যারেজ খোলার ফলে আরো তীব্র হয়েছে।

বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়েই বন্যার ঘটনা ঘটলো। ভারতে আশ্রয় নেওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর বাংলাদেশে হিন্দুদের টার্গেট করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে ভারত।

বাংলাদেশের ফেনীতে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা
বাংলাদেশের ফেনীতে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাছবি: Anik Rahman/Middle East Images/AFP/Getty Images

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ভারতপন্থি নীতি বজায় রাখার জন্য সমালোচিত হয়েছেন। এই নিয়ে বাংলাদেশে অনেকেই ক্ষুব্ধ এবং বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে জটিলতাও সৃষ্টি করেছে। সাম্প্রতিক বন্যা দুই দেশের মধ্যে এরই মধ্যে খারাপ সম্পর্ককে আরো তাতিয়ে তুলেছে। অনেকেই এখন এই অঞ্চলে ভয়াবহ বন্যার জন্য ভারতকে দায়ী করছেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের অনেকে দাবি করছেন যে, ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবাহিত গোমতী নদীর ওপর ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে অবস্থিত ডুম্বুর বাঁধ খুলে দিয়ে ভারত বাংলাদেশকে প্লাবিত করেছে।

ডিডাব্লিউ ফ্যাক্ট চেক সবচেয়ে ভাইরাল দাবিগুলোর কয়েকটি খণ্ডন করেছে।

সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্স-এ ভারতের তেলেঙ্গানার শ্রীশৈলম বাঁধের একটি ভিডিও দিয়ে দাবি করা হয়েছে এটি ত্রিপুরার ডুম্বুর বাঁধ।
সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্স-এ ভারতের তেলেঙ্গানার শ্রীশৈলম বাঁধের একটি ভিডিও দিয়ে দাবি করা হয়েছে এটি ত্রিপুরার ডুম্বুর বাঁধ।ছবি: X/@smzakaria

দাবি: ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে ডুম্বুর বাঁধ থেকে ভারত বাংলাদেশের দিকে পানি ছেড়ে দিচ্ছে

DW ফ্যাক্ট চেক: মিথ্যা

সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক ব্যবহারকারী একটি বাঁধের জল ছেড়ে দেওয়ার ভিডিও (এখানে আর্কাইভ করা) পোস্ট করে দাবি করেছেন যে, এটি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ডুম্বুর বাঁধ। তবে ভিডিওর বাঁধটি আসলে শ্রীশৈলাম মন্দিরের কাছে ভারতের তেলেঙ্গানা রাজ্যে অবস্থিত শ্রীশৈলম বাঁধ।

আমরা এখানে শ্রীশৈলম বাঁধের অবস্থান চিহ্নিত করেছি, এবং এখানে দেখতে পাবেন ২০২০ সালে গুগল ম্যাপসে যুক্ত করা একটি পুরাতন ভিডিও । ভিডিওগুলো তুলনা করলে বোঝা যায় যে দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই বাঁধ। এখানে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে নেওয়া বাঁধটির একটি পুরাতন ভিডিও রয়েছে৷

আরেকটি সূত্র হচ্ছে আবহাওয়া। ভিডিওতে পরিষ্কার আকাশ এবং ভালো আবহাওয়া দেখা যাচ্ছে। তবে ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে গত সপ্তাহে ভারি বৃষ্টিপাত হয়েছিল এবং বাঁধ খোলার সময় সেই অঞ্চলের আকাশ মেঘলা ছিল।

দক্ষিণ এশিয়ায় বন্যা প্রায়ই এই অঞ্চলের আন্তসীমান্ত নদী ব্যবস্থার কারণে ঘটে থাকে। এর ফলে প্রতিবেশী দেশগুলো প্রায়ই একে অপরকে দোষারোপ করে। বাংলাদেশ প্রায়ই বন্যার জন্য ভারতকে দায়ী করে। বিশেষ করে ফারাক্কা ব্যারেজ নিয়ে দুই দেশের দ্বন্দ্ব অনেক পুরাতন। ভারতের ফারাক্কা ব্যারেজ অবস্থিত গঙ্গা নদীর ওপর, যা বাংলাদেশে পদ্মা নাম নিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

বাংলাদেশের নদী ও পানি ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত ডিডাব্লিউকে বলেছেন, "বাংলাদেশ একটি বন্যা কবলিত বদ্বীপ অঞ্চল, সুতরাং, আমরা আমাদের নিজের দেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বাঁধ বা ফ্লাড ডাইকের ওপর নির্ভর করি। দুর্ভাগ্যবশত, এগুলোর বেশিরভাগই '৬০, ৭০ এবং ১৯৮০-এর দশকে নির্মিত হয়েছিল এবং তাদের রক্ষণাবেক্ষণও খুব খারাপ। এর ফলে প্রায়ই বাঁধ ভেঙে যায় এবং বন্যার জল ঢুকে পড়ে।"

বাংলাদেশের ফেনীর লালপোল এলাকায় বন্যার একটি চিত্র
বাংলাদেশের ফেনীর লালপোল এলাকায় বন্যার একটি চিত্রছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS

অধ্যাপক নিশাত বলেন, ''গোমতী নদীর ডুম্বুর বাঁধটি বাংলাদেশ থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে। হ্যাঁ, বাঁধের নিরাপত্তার জন্যই তাদের গেট খুলে দিতে হয়েছিল।''

তিনি আরো বলেন, ''ফারাক্কা ব্যারাজের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বিরূপ মনোভাব বর্ষার পরিস্থিতির জন্য নয়, শীত বা শুষ্ক মৌসুমের পরিস্থিতির জন্য। শুষ্ক মৌসুমে প্রবাহ কমে যায় এবং ভারত পুরো জলপ্রবাহকে সরিয়ে নিতে পারে।''

অভিন্ন নদীতে জলপ্রবাহ নিয়ে সংকট শুধুমাত্র ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ঘটছে এমন নয়। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যেও একই ধরনের অভিযোগ রয়েছে। দুই দেশ ১৯৬০ সালে সিন্ধু জলবন্টন চুক্তি সই করেছিল। কিন্তু তারপরেও দুই দেশই প্রায়ই একে অপরকে চুক্তি লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত করেছে। কোশি ও মহাকালী নদী নিয়ে ভারত ও নেপালের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। বর্ষা ঋতুতে যখন উপমহাদেশ ভারী বৃষ্টিপাতের সম্মুখীন হয় তখন প্রায়ই এই সমস্যা দেখা দেয়।

আইনুন নিশাত বলেন, "দুর্ভাগ্যবশত, ভারতের সঙ্গে শুষ্ক মৌসুমের পানি বা পানিবণ্টন নিয়ে আমাদের কোনো সঠিক চুক্তি নেই। সুতরাং, বাংলাদেশে শুষ্ক মাসগুলোতে নিম্ন জলপ্রবাহ হয় এবং বর্ষাকালে উচ্চ প্রবাহের সংকটে ভোগে।''

একজন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী অন্য একটি বাঁধের দুই বছর আগে ভিডিও পোস্ট করে সেটিকে ডুম্বুর বাঁধের বলে দাবি করেছেন
একজন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী অন্য একটি বাঁধের দুই বছর আগে ভিডিও পোস্ট করে সেটিকে ডুম্বুর বাঁধের বলে দাবি করেছেনছবি: X/@ChiddikaAb31861

ভারত কি উদ্দেশ্যমূলকভাবে বাঁধ খুলে দিয়েছিল?

ভারত দাবি করেছে যে, কোনো ফ্লাডগেট খোলা হয়নি। তবে গোমতী জলাধারে ধারণক্ষমতার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানোর পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে গেট খুলে যায়। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স-এ পোস্ট করা একটি ভিডিও (এখানে আর্কাইভ করা) এই দাবিকে চ্যালেঞ্জ করেছে। ভিডিওটি দেখিয়ে দাবি করা হয়েছে,  এটি স্বয়ংক্রিয় নয়, বরং ইচ্ছাকৃত ছিল। ভিডিওতে দেখা যায় দুই ব্যক্তির উপস্থিতিতে একটি ক্রেন দিয়ে বাঁধের একটি গেট খোলা হচ্ছে।

দাবি: জল স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছেড়ে দেওয়া হয়নি।

DW ফ্যাক্ট চেক: মিথ্যা

আসল ভিডিওটি ইউটিউবে দুই বছরেরও বেশি আগে পোস্ট করা হয়েছিল। ভিডিওটিতে তিন কোটিরও বেশি ভিউ হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের ফারাক্কা ব্যারেজের একটি গেট পরিবর্তন করার ভিডিও এটি।

আমরা ফারাক্কা ব্যারাজের ভূ-অবস্থান নির্ণয় করে দেখেছি এই ভিডিওটির সঙ্গে সেখানকার অনেক মিল রয়েছে। ত্রিপুরার ডুম্বুর বাঁধের সাথে এর কোন মিল নেই। এই ভিডিওতেও দেখা গেছে পরিষ্কার আকাশ।

বাংলাদেশের তথ্য ও সম্প্রচার বিষয়ক উপদেষ্টা মোহাম্মদ নাহিদ ইসলাম অভিযোগ করেছেন, ভারত কোনো পূর্ব সতর্কবার্তা না দিয়ে এবং বাংলাদেশকে প্রস্তুতির সুযোগ না দিয়েই বাঁধ খুলে দিয়েছে।

ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেয়া বিবৃতিতে দাবি করা হয়েছে, "বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ১২০ কিলোমিটার উজানে অবস্থিত বাঁধের নিচের দিকের ক্যাচমেন্টের জলের কারণে বন্যা হয়েছে।" বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে যে ২১ আগস্ট থেকে ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে "স্বয়ংক্রিয়ভাবে জল ছেড়ে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে।"

বর্তমানের বন্যার পরিস্থিতি তুলে ধরতে অতীতের ভিডিও ব্যবহার

বাংলাদেশে চলমান বন্যার প্রচুর ছবি এবং ভিডিও অনেকেই অনলাইনে শেয়ার করছেন। কিন্তু একই সঙ্গে বেশ কিছু সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে পুরাতন ছবি ও ভিডিও শেয়ার করে সেগুলো বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বন্যার বলে মিথ্যা দাবি করা হচ্ছে।

টুইটে শেয়ার করা বাংলাদেশের বন্যা কবলিত অঞ্চলের কয়েকটি ছবি
টুইটে শেয়ার করা বাংলাদেশের বন্যা কবলিত অঞ্চলের কয়েকটি ছবিছবি: Facebook/Sajeeb Mazumder

দাবি: ছবিতে দেখানো হচ্ছে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা বন্যার পানিতে ডুবে গেছে

DW ফ্যাক্ট চেক: বিভ্রান্তিকর

একটি ফেসবুক পোস্টে একজন ব্যবহারকারী দাবি করেছেন যে, নোয়াখালী জেলা জলে প্লাবিত হয়েছে এবং এই দাবির সমর্থনে তিনটি ছবি পোস্ট করেছেন। অবিরাম বর্ষণ ও ভারত থেকে আসা পানির কারণে নোয়াখালী বন্যা কবলিত হয়েছে।

তবে পোস্টে শেয়ার করা সব ছবি সঠিক নয়। প্রথম ছবিটি বাংলাদেশেরই। তবে এটি সিলেটের, নোয়াখালীর নয়। এই ছবি আগস্টের বন্যার নয়,  জুনেই এই ছবি গেটি ইমেজেস সংস্থায় প্রকাশ করা হয়েছে। দ্বিতীয় ছবিটি ভারতের আসাম রাজ্যের। সেখানে চলতি বছরের জুন মাসে বন্যা হয়েছিল। ভারতীয় সংবাদপত্র টাইমস অফ ইন্ডিয়া এই নিবন্ধে একই ছবি পোস্ট করেছে, যেটি বার্তা সংস্থা রয়টার্সের তোলা। পর্যাপ্ত ক্লু না পাওয়ায় তৃতীয় ছবিটি সঠিক কিনা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

আনোয়ার আশরাফ, আরাফাতুল ইসলাম, ওয়েসলি রান/এডিকে