সম্প্রতি ভারতের কয়েকটি ওটিটি প্ল্যাটফর্মে কোচিং সেন্টার নিয়ে বেশ কিছু ফিল্ম এবং সিরিজ তৈরি হয়েছে। আইআইটি-তে ভর্তি হওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য রাজস্থানের কোটায় কার্যত কোচিং হাব তৈরি হয়ে গেছে। মজা করে যাকে কোটা ফ্যাক্টরি বলা হয়। এদিকে, দিল্লির মুখার্জি নগরে চলে সরকারি কর্মকর্তা তৈরি করার কারখানা। লাখ লাখ পড়ুয়া এখানে আসেন আইএস, আইপিএস, আইএফএস-এর ট্রেনিং নিতে। গুজরাটের সুরাতেও এমন কোচিং হাব আছে। সিনেমা এবং সিরিজগুলিতে এই ট্রেনিং সেন্টারগুলির অনেক ভিতরের কাহিনি দেখানো হয়েছে। কিন্তু একটি জিনিস বলা হয়নি। কী ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতিতে চলে এই কোচিংগুলি।
২০১৯ সালে সুরাতের ঘটনা এখন অনেকেই ভুলে গেছেন। মাত্র পাঁচ বছর আগে ২০১৯ সালের মে মাসে সুরাতের এমনই এক কোচিং সেন্টারে আগুন লাগে। ক্লাস হতো উপরের তলায়। আগুন লাগে গ্রাউন্ড ফ্লোরে। ভবন থেকে বার হওয়ার রাস্তা মাত্র একটি। সেখানেও কাঠের সিঁড়ি। আগুন নেভানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। ঘুপচি ঘরে বসে আগুনে ঝলসে মারা গেছিলেন ২২ জন পড়ুয়া। ভয়াবহ আহত হন ১৯ জন। অর্থাৎ, ওই ঘুপচি ঘরে একসঙ্গে কোচিং নিচ্ছিলেন অন্তত ৪১জন ছাত্র।
পরে জানা যায়, ওই ভবনটি কমার্শিয়াল কাজে ব্যবহার করার কথাই নয়। লাইসেন্স ছিল না কোচিং সেন্টারের। ঘটনায় তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারপর তাদের কী হয়, আদৌ কোনো শাস্তি হয় কি না, সে খোঁজ কেউ আর রাখেনি।
আইন রক্ষা করার দায়িত্ব পুলিশ-প্রশাসনের। ভারতে ভবনের নিরাপত্তা সংক্রান্ত স্পষ্ট এবং নির্দিষ্ট আইন আছে। কোন ভবন কী কাজে ব্যবহার করা যাবে, ব্যবসায়িক কাজে কোনো জায়গা নেয়া হলে সেখানে কী কী নিয়ম মানতে হবে, তার সুনির্দিষ্ট নিয়ম আছে। কিন্তু কে মানে কার কথা! ভবিষ্যতের প্রশাসনিক কর্তারা তাদের ভিত তৈরি করেন যে কোচিং সেন্টারগুলিতে, সেগুলিই তো অধিকাংশ বেআইনি! কী করে আশা করা যায়, চাকরিতে ঢুকে তারা সেগুলির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন?
এ তো গেল কোচিংয়ের কথা। বাজার, শপিং মল এমনকী হাসপাতালের কথা যত কম বলা যায়, ততই ভালো। সম্প্রতি মিজোরামে এক সহকর্মী মজা করে বলছিলেন, শুধুমাত্র দিল্লির চাঁদনিচক লোকসভা কেন্দ্রে যত ভোট আছে, গোটা মিজোরাম রাজ্যের ভোট সম্ভবত তত। অতিশয়োক্তি তো বটেই! তবে সাংঘাতিক অতিশয়োক্তি নয়। দুইটি চাঁদনি চকের ভোটারের সমান একটি গোটা মিজোরাম রাজ্যের ভোট। সেই চাঁদনিচক, যেখানে প্রতিদিন কয়েক লাখ মানুষ কেনাকাটি করতে আসেন, সেখানে আকাশের দিকে তাকালে খোলা বিদ্যুতের তারের জাল দেখা যায় কেবল। যে কোনো একটি গলির যে কোনো একটি ভবনে সামান্য শর্ট সার্কিট হলে, কত মানুষের প্রাণ যাবে, ভাবতেও আতঙ্ক হয়। লেগেছেও আগুন। মাঝরাতে লাগায়, জীবনহানি হয়নি ততটা, কিন্তু কোটি কোটি টাকার জিনিস পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
একই অবস্থা কলকাতার শতাব্দীপ্রাচীন বাজারগুলির। একবার নয়, বার বার আগুন লেগেছে একাধিক বাজারে। মানুষের প্রাণ গেছে, সম্পত্তি নষ্ট হয়েছে। মন্ত্রী, প্রশাসনিক কর্মকর্তারা গেছেন, বড় বড় ভাষণ দিয়েছেন, সংবাদমাধ্যমে বিতর্কসভা বসেছে। তার এক সপ্তাহের মধ্যে যে কী সেই! বাজারে তারের জালি ঠিক যেমন ছিল, এখনো তেমনই আছে।
এখনো মনে পড়ে সেই ভয়াবহ ভোরের কথা। আমরি হাসপাতালের আগুন। একের পর এক রোগীর মৃত্যু। তবে হাসপাতালের ক্ষেত্রে ওই ঘটনার পর বেশ কিছু পরিবর্তন চোখে পড়েছিল। প্রতিটি হাসপাতালে বাইরে দিয়ে সিঁড়ি তৈরির নিয়ম জারি করা হয়েছিল। কলকাতার অধিকাংশ হাসপাতালই সেই নিয়ম পালন করেছে।
হাসপাতাল একটু আশার আলো জাগালেও আলোর ছিঁটেমাত্র নেই শহর এবং শহরতলির বেআইনি কারখানাগুলির ক্ষেত্রে। দিল্লি, কলকাতায় কুটির শিল্পের মতো তৈরি হয়েছে কেমিক্যাল তৈরির, প্লাস্টিক তৈরির, জামা-কাপড় তৈরির ছোট ছোট কারখানা। ছোট ছোট ঘরে গাদাগাদি করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেখানে কাজ করেন অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকেরা। দিন আনি দিন খাই মজুরেরা। রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবীর মতো সত্যিই ওই শ্রমিকদের পরিচয় কিছু নম্বর মাত্র। ৬৫-র চ, ৬৯ এর ঙ। তারা বেঁচে থাকলেই বা কী, মরেই গেলেই বা কী? প্রতি বছর নিয়ম করে এই কারখানাগুলিতে আগুন লাগে। কখনো কলকাতায়, কখনো দিল্লিতে, কখনো গুজরাটে, কখনো কর্ণাটকে। দাউ দাউ সেই আগুন নেভাতে সরু গলিতে ঢুকতে পারে না দমকল। আগুন ছড়াতে থাকে। এসবই কেমন নিয়ম হয়ে গেছে। ঠিক যেমন নিয়মের আগুন লাগে কলকাতার ট্যানারিতে, প্রতি বছর। কারো কিছু যায় আসে না তাতে।
এত কিছুর পরেও জতুগৃহের এই দেশে প্রতিদিন যে আগুন লাগে না, সেই তো যথেষ্ট। প্রতিদিন যে আগুন লাগে, তা বড় আশ্চর্য!