পোশাক রপ্তানিতে চুরি ও মুদ্রাস্ফীতির কুপ্রভাব
৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩মঙ্গলবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর নেতারা বলেন, গত দুই দশকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দুই হাজারেরও বেশি কাভার্ড ভ্যান থেকে শত শত কোটি টাকার পোশাক চুরি হয়েছে। গত বছরও ২০-২২টি চুরির ঘটনা ঘটেছে।
তারা বলেন, এখন কাভার্ড ভ্যানে চুরি পোশাক রপ্তানিকারকদের জন্য সবচেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্রেতাদের আস্থা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন।
তারা উদাহরণ দিয়ে বলেন, ব্রাজিলের একটি ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের রপ্তানিকারককে জানিয়েছে, তারা বেশির ভাগ কার্টনের ৩০-৩৫ শতাংশ পোশাক বুঝে পায়নি। ওই চালানে ২৬ হাজারের বেশি পোশাকের মধ্যে আট হাজারই তারা পায়নি।
অভিযোগ করার পর র্যাব ওই চুরির সঙ্গে জড়িত চার জনকে আটক করেছে।
বিজিএমই নেতারা বলেন, "যারা এই চুরির সঙ্গে জড়িত, তাদের মাঝেমধ্যে গ্রেপ্তার করা হলেও কয়েক মাস পর জামিনে বেরিয়ে এসে আবার একই কাজ করে। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা আছে। সেরকমই একজন হলো সাহেদ৷ তার বিরুদ্ধে ১৭-১৮টি মামলা থাকার পরও সে জামিনে বেরিয়ে এসে তার চক্র নিয়ে আবার চুরিতে নেমেছে।”
সম্প্রতি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা চুরির সঙ্গে জড়িত কয়েকটি চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তার করলে চমকপ্রদ তথ্য বেরিয়ে আসে। তাদের কয়েকজন রপ্তানির পোশাক চুরি করে ঢাকায় একাধিক বাড়ি করেছে, গাড়ি কিনেছে।
বিজিএমইএ নেতারা তাই মহাসড়কে তাদের পোশাকের নিরাপত্তা চেয়েছেন। তারা মার্চ মাসের মধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সিসি ক্যামেরা স্থাপনসহ পাঁচ দফা দাবি জনিয়েছেন।
বাংলাদেশের একজন প্রতিষ্ঠিত পোশাক রপ্তানিকারক ও চারটি পোশাক কারখানার মালিক মো. আসাদুজ্জামান বুধবার জানান, "এই চুরির কারণে আমাদের বিপূল পরিমাণ জরিমানা দিতে হয়। আমি নিজে এর শিকার। আমাদের সুনামও ক্ষুন্ন হচ্ছে। বায়ারদের আস্থা নষ্ট হচ্ছে।”
তিনি বলেন, "চোর চক্র কাভার্ড ভ্যানের পিছনের দরজার তালা খুলে কার্টন থেকে পোশাক বের করে সেখানে ‘জুট' ভরে দেয়। এটা ধরা পড়ে যখন বায়ারের কাছে যায় তখন। এর দায় কেউ নিতে চায় না। শেষ পর্যন্ত আমাদেরই নিতে হয়। এর সঙ্গে কাভার্ড ভ্যানের চালকরাও জড়িত।”
এ ব্যাপারে হাইওয়ে পুলিশের বক্তব্য চেষ্টা করেও পাওয়া যায়ানি।
অর্ডার কমছে
বিজিএমইএ'র সভাপতি ফারুক আহমেদ বলেন, " যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সেসব দেশের মানুষ কেনাকাটা কমিয়ে দিয়েছে। তাই পোশাকের অর্ডার কমিয়ে দিয়েছে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান। তারা একসঙ্গে বড় অর্ডার না দিয়ে ছোট ছোট ভাগ করে অর্ডার দিচ্ছে। আবার অনেক অর্ডারের দাম পরিশোধের সময়সীমাও পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে।''
কিন্তু চলতি অর্থ বছরের প্রথম সাত মাসে পোশাক রপ্তানিতে ১৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "অর্ডার কমে যাওয়ার কারণে অধিকাংশ কারখানা পূর্ণ সক্ষমতায় উৎপাদন চালাতে পারছে না। ওভারটাইমও করানো যাচ্ছে না।”
বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বুধবার ডয়চে ভেলেকে বলেন, "শুধু ইউরোপ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়, সারাবিশ্বেই একটা ক্রাইসিস চলছে। তার প্রভাব আমাদের তৈরি পোশাক খাতে পড়ছে। অর্ডার কমছে। তবে কত কমছে তার হিসাব আমরা এখন দিতে পারছি না, কারণ এই ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট কে কীভাবে করতে পারছে তার ওপর নির্ভর করছে কে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ছোট পোশাক কারখানাগুলো সবচেয়ে বেশি বিপাকে আছে।কোনো কোনো কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।”
তিনি বলেন, "আমরা এখন যা রপ্তানি করি তার পেমেন্ট তিন-চার মাস পরে পাই। এখন তারা পেমেন্ট আরো পিছিয়ে দিচ্ছে তাদের ক্রাইসিসের কারণে। এটা আমাদের জন্য আরো একটি সমস্যা।”
তার কথায়, "এরপরও রপ্তানি আয় বাড়ার কারণ হলো পোশাক তৈরির খরচ বেড়ে গেছে। কাঁচা মালের দাম বেড়ে যাওয়ায় মূলত ইউনিট প্রাইস বেড়েছে। ফলে মনে হচ্ছে রপ্তানি আয় বেড়েছে। কিন্তু প্রফিট মার্জিন বাড়েনি। রপ্তানি বাড়েনি।”
পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক, অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, " সমস্যাটা হচ্ছে প্রকৃত রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে। কারণ, কাঁচামালের দাম বাড়ার কারণে খরচ বেড়েছে। সেখানে রপ্তানি আয় বাড়তি দেখালেও প্রকৃত রপ্তানি আয় কত বেড়েছে- সেটাই এখন প্রশ্ন।”
তবে তিনি এ-ও বলেন, " ক্রাইসিস আছে। কিন্তু তাতে অর্ডার কমছে বলে আমার জানা নেই। অর্ডার হারানোর ঘটনা অভ্যন্তরীণ। এক প্রতিষ্ঠান অর্ডার হারিয়েছে, সেই অর্ডার আরেক প্রতিষ্ঠান পেয়েছে। তাতে অর্ডার হারানো প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু দেশের বাইরে অর্ডার চলে যাওয়ার বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয়।”