পাহাড়ে শান্তি: চুক্তিতে অনেক, বাস্তবে কম
১৪ এপ্রিল ২০২৩বিশ্লেষক ও পাহাড়ের নেতারা বলছেন, এর মূল কারণ শান্তিচুক্তিরমূল ধারাগুলো বাস্তবায়ন না হওয়া৷ এতে পাহাড়িদের মধ্যে অবিশ্বাস, হতাশা আর দ্বন্দ্ব বাড়ছে৷ একটি জনপদে সাধারণ অপরাধ থাকে; কিন্তু পাহাড়ে যা হচ্ছে তা কোনো স্বাভাবিক পরিস্থিতি নয়৷
গত ৭ এপ্রিল বান্দরবানের বোয়াংছড়ির দুর্গম পাহাড়ি এলাকা থেকে আট যুবকের লাশ উদ্ধার করে৷ তারা সবাই বম জনগোষ্ঠীর৷ পুলিশ দুই গ্রুপের বন্দুকযুদ্ধে তারা নিহত হয়েছে বলে দাবি করলেও ওই দুইটি গ্রুপের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি৷ পাহাড়ে একসঙ্গে এতজনকে হত্যার ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে আর ঘটেনি৷
এর আগে ২০১৮ সালের ৩ মে আধিপত্যের কোন্দলে ব্রাশফায়ার করে জনসংহতি সমিতি, সংস্কার(জেএসএস) সমর্থিত নানিয়ারচর উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমাকে হত্যা করা হয়৷ অভিযোগের তির ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ইউপিডিএফের সদস্যদের দিকে৷ পরদিন ৪ মে শক্তিমানের শেষকৃত্যে যোগ দিতে যাওয়ার সময় ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)-এর সভাপতি তপন জ্যোতি চাকমা বর্মাসহ পাঁচজনকে ‘ব্রাশফায়ার' করে হত্যা করা হয়৷ ইউপিডিএফ (মূল)-এর সশস্ত্র গ্রুপ এই কাজ করেছে বলে অভিযোগ৷ ওই বছরের ২ মে ইউপিডিএফের সাবেক সদস্য উজ্জ্বল কান্তি চাকমাকে জেএসএস (সংস্কার)-এর সশস্ত্র ক্যাডাররা গুলি করে হত্যা করে বলে অভিযোগ৷ কয়েকদিন পর ২৮ মে সাজেক থানার করল্লাছড়ি এলাকায় ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)-এর ক্যাডারদের গুলিতে ইউপিডিএফ (মূল)-এর সদস্য স্মৃতি চাকমা, সুশীল চাকমা ও অটল চাকমা নিহত হন৷
পাহাড়ে এই সন্ত্রাস ধারাবাহিকভাবেই কম-বেশি চলে আসছে৷ হালে কুকি ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে আরো একটি সন্ত্রাসী গ্রুপের উত্থান ঘটেছে৷ সর্বশেষ আট জনকে হত্যার জন্য তাদের দায়ী করা হচ্ছে৷ পাহাড়ে মোট পাঁচটি গ্রুপের মধ্যে আধিপত্যের লড়াই সব সময়েই চলে৷
পাহাড়ের নেতারা মনে করেন, শান্তি চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়ার হতাশাআর অবিশ্বাস থেকেই এই গ্রুপগুলোর জন্ম হয়েছে৷ তারা নানা সন্ত্রাসী কাজে জড়িয়ে পড়ছে৷ আধিপত্যের লড়াইয়ের পিছনে আছে চাঁদাবাজি৷ কারণ, গ্রুপ চালাতে অর্থ লাগে৷
তারা বলছেন, ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে পার্বত্য শান্তি চুক্তির মূল বিষয় ছিল পাহাড়ি জনগণের ভূমির অধিকার, স্বনিয়ন্ত্রণ এবং তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার৷ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, চুক্তির ৭২টি বিষয়ের মধ্যে এ পর্যন্ত ৪৮টি বাস্তবায়িত হয়েছে৷ কিন্তু পাহাড়ের নেতাদের দাবি , ৭২টি বিষয়ের মধ্যে মাত্র ২৫টির বাস্তবায়ন হয়েছে৷
চাকমা সার্কেলের রাজা দেবাশীষ রায় বলেন, চুক্তির মৌলিক বিষয়ের ৫টি এখনো বাস্তবায়ন হয়নি৷ এগুলো হলো-
১. পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা বেসামরিকীকরণ করা ৷
২. শরণার্থী এবং অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন ৷
৩. আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদের কাছে যথাযথভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা ৷
৪. ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি ও ভূমি সংস্কার করা ৷
৫. সর্বোপরি পার্বত্য চট্টগ্রাম যে একটি অদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা সেরকম কোনো ঘোষণা বা আইনগত ব্যবস্থা নেয়া৷
জনসংহতি সমিতির দাবি, বিগত দুই যুগেরও বেশি সময়ে প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থীদের দুই তৃতীয়াংশ পরিবার তাদের ভূমি ফেরত পায়নি৷ তাদের ৪০টি গ্রাম, ভিটে-মাটি ও জায়গা-জমি এখনো সেটলার বাঙালিদের পুরো দখলে রয়েছে৷ নিজ জায়গা-জমি ফেরত না পাওয়ায় জুম্ম জনগোষ্ঠী মানবেতর জীবন যাপন করছে৷
আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং বলেন, " পাহাড়ে যে সংঘাত-সংঘর্ষ হচ্ছে এগুলো হচ্ছে শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার ফল৷ শান্তি চুক্তি-বিরোধী অনেক গ্রুপ তৈরি হয়েছে৷ কিন্তু যেসব হত্যাকাণ্ড হচ্ছে তারা কোনো বিচার হচ্ছে না৷ আর কোনো গ্রুপ ইন্ধনে তৈরি হয়েছে৷ কোনো মহলের স্বার্থে তৈরি করা হয়েছে৷”
তার কথা, ‘‘আঞ্চলিক পরিষদ হয়েছে৷ পার্বত্য উন্নয়ন বোর্ড হওয়ার কথা হয়েছে, ভূমি সংস্কার বোর্ড হওয়ার কথা হয়েছে, পার্বত্য জেলা পরিষদ হওয়ার কথা হয়েছে৷ এগুলোর নেতৃত্বে আদিবাসীরা আছেন৷ কিন্তু আইন ও বিধি প্রণয়ন কি হয়েছে? হয় নাই৷ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার তারা পায়নি৷ মূল কথা হলো, অধিকার প্রতিষ্ঠায় যা দরকার, তা হয়নি৷ ভূমি সংস্কার না করে কৌশলে আদিবাসীদের ভূমি হস্তান্তর করা হচ্ছে৷''
জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি ও রাঙামাটির স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য উষাতন তালুকদার বলেন, " পাহাড়ে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ তো থাকবে৷ একটা কমিউনিটি তো সব সময়ে ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারে না৷ মতভিন্নতা থাকতে পারে৷ দ্বিধা, সংশয়, অবিশ্বাস থেকে এগুলো হয়৷ কৃত্রিম ভাবেও সংকট তৈরি করা হয়৷ আর এর কারণে হানাহানি, সংঘাত হয়৷ শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন হলে এগুলো থেমে যাবে৷”
তিনি বলেন, "ভূমি কমিশন হলেও বিধি হয়নি৷ ফলে ভূমি কমিশন কাজ করতে পারছে না৷ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা এখনো পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ ও জেলা পরিষদের কাছে দেয়া হয়নি৷ ফলে এর দায় কে নেবে? সেখানে সমস্যা আছে বলেই তো শান্তি চুক্তি হয়েছে৷ সেটা বাস্তবায়ন না হলে তো শান্তি আসবে না৷”
সর্বশেষ জনশুমারিতে দেশে আদিবাসীদের সংখ্যা বলা হয়েছে মোট জনসংখ্যার শতকরা এক ভাগ বা ১৬ লাখ ৫০ হাজার ১৫৯ জন৷ অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারাকাত তার ‘পলিটিক্যাল ইকোনমি অফ আনপিপলিং অফ ইন্ডিজিনাস পিপলস: দ্য কেইস অফ বাংলাদেশ' শিরোনামের এক গবেষণা গ্রন্থে বলেছেন, ‘‘২৭ বছর আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী মানুষের অনুপাত ছিল ৭৫ শতাংশ, এখন তা ৪৭ শতাংশ৷ গত তিন দশক ধরে ওই অঞ্চলে আদিবাসী কমছে আর বাঙালিদের সংখ্যা বাড়ছে৷ পাহাড়িরা হারিয়েছে ভূমি-বনাঞ্চল আর আমদানি করা সেটলার বাঙালিরা দুর্বৃত্ত, আমলা প্রশাসনের যোগসাজশে তা দখল করেছে৷''
তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে৷ ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার উন্নয়নে দুই হাজার ৮১৪টি সেট কমিউনিটি সোলার সিস্টেম বিতরণ করা হয়েছে৷ আর হোম সোলার প্যানেল বিতরণ করা হয়েছে প্রায় ৩৪ হাজার৷ গত বছরের ৭ নভেম্বর পার্বত্য এলাকার জন্য ৪২ টি সেতু উদ্বোধন করা হয়েছে৷ আর আগে থেকেই ওই তিন জেলার উন্নয়নে অনেক কাজ করা হয়েছে৷ দুর্গম পাহাড়ি এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থারও উন্নয়ন হয়েছে৷ গত অর্থ বছরে পার্বত্য তিন জেলায় ২৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫৬৯টি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়৷ ওই এলাকায় টেলিযোগাযোগ ও ইন্টারনেট ব্যবস্থারও উন্নয়ন করা হয়েছে৷
আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের সভাপতি সংদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, "পাহাড়ে মূল সমস্যা হলো ভূমি সমস্যা৷ তাদের কমিশনকে কাজ করতে দিতে হবে৷ আর পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন করলেই সমস্যার সমাধান হবে৷ সমতলের আদিবাসীদের জন্যও একটি ভূমি কমিশন গঠন করা দরকার৷”
পাহাড়ের এই সার্বিক সংকট নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি দবিরুল ইসলাম বলেন, "আমি সমতলের মানুষ, পাহাড়ের সংকট বুঝি না৷ অযথাই আমাকে সংসদীয় কমিটির সভাপতি করা হয়েছে৷ তবে পাহাড়ে যে সংঘাত-সংঘর্ষ হচ্ছে তা বন্ধ করা প্রয়োজন৷ হতে পারে শান্তি চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন হলে সংকট কেটে যাবে৷ তবে সংসদীয় কমিটির বৈঠকে এটা নিয়ে আমাকে কেউ কিছু বলেননি৷”