পার্বত্য চট্টগ্রাম: শাসন ও সংঘাতের ইতিহাস
পাহাড় আর সবুজ ঘেরা বাংলাদেশের অনিন্দ্য সুন্দর এক অঞ্চল পার্বত্য চট্টগ্রাম৷ কিন্তু সেখানকার ভূমি নিয়ে যুগ যুগ ধরে চলেছে দখলের লড়াই৷ বাংলাপিডিয়ার তথ্য অবলম্বনে ছবিঘরে থাকছে পার্বত্য চট্টগ্রামের সেই ইতিহাস৷
আরাকান ও ত্রিপুরা রাজের লড়াই
৯৫৩ সালে এখনকার পার্বত্য চট্টগ্রাম ছিল আরাকান রাজার দখলে৷ তিনশ বছরের শাসনের পর ১২৫৩ সালে তাদের কাছ থেকে তৎকালীন ত্রিপুরার রাজা অঞ্চলটি দখল করে নেয়৷ ১৫৭৫ সালে আবার দখল ফিরে পায় আরাকানরা৷ ১৬৬৬ সালে তাদের কাছ থেকে নিয়ন্ত্রণ নেয় মুঘলরা৷
ব্রিটিশ শাসন
১৭৬০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং ১৮৬০ সালে ব্রিটিশ ভারতের অধীনে আসে অঞ্চলটি৷ প্রশাসনিকভাবে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামকে বঙ্গ প্রদেশের অধীনে আনে৷ শাসনের জন্য ১৯০০ সালে ‘চিটাগং হিল ট্র্যাকস রেগুলেশন অ্যাক্ট’ নামের আইন প্রবর্তন করে৷ ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম৷
রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা
১৯৫৬ সালে পাহাড়ি ছাত্ররা নিজেদের দাবি আদায়ে হিল স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন নামের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে৷ ১৯৬৬ সালের গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম উপজাতীয় কল্যাণ সমিতি, যার নেতৃত্বে ছিলেন অনন্ত বিহারী খীসা ও জে বি লারমা৷ ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে এ সমিতির সমর্থনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন৷
চার দফা দাবি
১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির জন্য চার দফা দাবি পেশ করেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা৷ দাবিগুলো ছিল: পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসন এবং নিজস্ব আইন পরিষদ গঠন, সংবিধানে ১৯০০ সালের রেগুলেশনের মতো সংবিধির অন্তর্ভুক্তি, সংশোধনের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক বিধিনিষেধ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের বসতি স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ৷
প্রত্যাখ্যান ও অসন্তোষ
পাহাড়ীদের দাবি অনুযায়ী পৃথক জাতিসত্তার স্বীকৃতির পরিবর্তে সংবিধানে সবাইকে বাঙালি হিসেবে উল্লেখ করা হয়৷ পাশাপাশি চার দফা দাবিও মেনে নেয়নি সরকার৷ এর ফলে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে সৃষ্টি হয় অসন্তোষ৷ নিজেদের অধিকার রক্ষায় ১৯৭৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, তাদের সামরিক সংগঠন ছিল শান্তিবাহিনী৷
অন্তর্কোন্দল
শুরু থেকেই দুটি মতাদর্শে ভাগ হয়ে যায় জনসংহতি সমিতি৷ মানবেন্দ্র লারমার নেতৃত্বে ছিল বামপন্থি লারমা গ্রুপ, অন্যদিকে প্রীতিকুমার চাকমার নেতৃত্বে ছিল জাতীয়তাবাদী প্রীতি গ্রুপ৷ ১৯৮৩ সালে প্রতিদ্বন্দ্বীদের হামলায় নিহত হন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা৷ তাঁর ছোট ভাই জোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) দলের নেতৃত্বে আসেন৷ ১৯৮৫ সালের এপ্রিলে প্রীতি গ্রুপের ২৩৬ জন সদস্য সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করেন৷
সামরিক শাসন
পাকিস্তান আমলে কাপ্তাই বাঁধের কারণে সৃষ্ট বন্যায় সেখানকার প্রায় একলাখ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েন৷ নিজেদের ভূমি ফিরে না পাওয়ায় অসন্তোষ ছিল পাহাড়িদের মধ্যে৷ তার উপর ১৯৭৯ সালে গোষ্ঠী মালিকানাধীন জমিকে খাস জমি ঘোষণা করে সেখানে বাঙালি বসতি স্থাপনের কার্যক্রম নেয় সরকার৷ উচ্ছেদ হয় বহু পাহাড়ি পরিবার৷ ১৯৯১ সালে বাঙালিদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় মোট জনসংখ্যার ৪৮.৫ শতাংশে, যা ১৯৭৪ সালে ছিল মাত্র ১১.৬ শতাংশ৷
সংঘাত
আশির দশকে শান্তি বাহিনী সামরিক দিক থেকে সংগঠিত হতে শুরু করে৷ ১৯৭৭ সালে তারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি বহরের উপর হামলা চালায়৷ এরপর সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামকে ২৪তম ডিভিশনের জিওসির অধীনে আনে৷ পাল্টা হামলা শুরু করে৷
শান্তি চুক্তি
১৯৯৭ সালের দুই ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে শান্তি চুক্তি হয়৷ চুক্তির আওতায় তিন পার্বত্য জেলার স্থানীয় সরকার পরিষদ সমন্বয়ে একটি আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হয়৷ বলা হয়েছে, উপজাতীয়দের ভূমি মালিকানা অধিকার নির্ধারিত হলে তাদের ভূমি ফিরিয়ে দেওয়া হবে৷ এ উদ্দেশ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ভূমির উপর মালিকানা নির্ধারণের জন্য ভূমি জরিপব্যবস্থা পরিচালিত হবে৷
শান্তি ফেরেনি
শান্তি চুক্তির পরও পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফেরেনি৷ অভিযোগ আছে এই চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন আজও হয়নি৷ ইতি ঘটেনি সংঘাত ও অশান্তিরও৷ কল্পনা কিংবা মাইকেল চাকমার মতো রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের গুম, হত্যার অভিযোগ আছে সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে৷ নিজেদের বিভিন্ন দলের অন্তর্কোন্দলেও প্রতিনিয়ত প্রাণ ঝরছে পাহাড়ে৷