চলচ্চিত্র উৎসবের সমাপ্তি
১৮ নভেম্বর ২০১৩আগের দিনই ক্রিকেটার শচীন তেন্ডুলকর ২০০তম টেস্টটি খেলে তাঁর ২৪ বছরের দীর্ঘ আন্তর্জাতিক ক্রিকেট জীবনে ইতি টানার সময়, বিদায়ী ভাষণে বার বার স্বীকার করেছেন তাঁর সাফল্যের পিছনে তাঁর পরিবারের অবদানের কথা৷ সেই একই আবেগের পুনরাবৃত্তি হলো রবিবার সন্ধ্যায়, সায়েন্স সিটি অডিটোরিয়ামে, ১৯তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের সমাপ্তি অনুষ্ঠানে৷ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সাফল্যের পিছনে তাঁদের বাবা-মা বা অভিভাবকদের যে স্বার্থত্যাগ, পরিশ্রম এবং অনুপ্রেরণা থাকে, তার স্বীকৃতি দেওয়া হলো সর্বসমক্ষে৷ মৌসুমী চ্যাটার্জি, সুস্মিতা সেন, বিপাশা বসু, রানী মুখার্জি ও কোয়েল মল্লিক – বাংলার এই পঞ্চকন্যাকে সম্বর্ধনা দেওয়ার সময় ধন্যবাদ জানানো হলো তাঁদের বাবা-মা ও গুরুজনদের৷ মঞ্চে ডেকে নেওয়া হল সুস্মিতা এবং বিপাশার বাবা, রানী ও কোয়েলের বাবা-মায়েদের৷
পাঁচজন বাঙালি অভিনেত্রী, যাঁরা বাংলার বাইরে, সর্বভারতীয় বা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও বাংলার মুখ উজ্জ্বল করেছেন, এমন পঞ্চকন্যাকে যে এবারের চলচ্চিত্র উৎসবে সম্বর্ধিত করা হবে, সেটা আগেই ঠিক ছিল৷ তবে একেবারে শেষ মুহূর্তে বদলে গেল একটি নাম৷ কোয়েল মল্লিক নয়, ঠিক ছিল সম্বর্ধিত হবেন অপর্ণা সেনের কন্যা কঙ্কনা সেন শর্মা৷ চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দর্শকের আসনে কঙ্কনাকে দেখাও গিয়েছিল৷ কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে কঙ্কনা সম্বর্ধনা নিতে রাজি হননি৷ তা সত্ত্বেও কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের মঞ্চে সফল প্রবাসী বাঙালি ফিল্ম অভিনেত্রীদের স্বীকৃতি দিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই অভিনব উদ্যোগ প্রশংসিত হয়েছে, যার শুরুটা মুখ্যমন্ত্রী করেছিলেন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জয়া ভাদুড়িকে এনে৷
আরও একটা চেষ্টা চলচ্চিত্র উৎসবের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী করছেন৷ সেটা হলো, কলকাতার প্রিয় এই উৎসবকে আঞ্চলিক চলচ্চিত্রচর্চার মধ্যে আটকে না রেখে এটাকে একটা সর্বভারতীয় বাণিজ্যিক চেহারা দেওয়া৷ হিন্দি ছবি তথা ভারতীয় সিনেমার আইকন অমিতাভ বচ্চন বা বলিউডের বাদশাহি এখন যাঁর হাতে, সেই শাহরুখ খানকে মমতা আগেই নিয়ে এসেছিলেন, এবার আনলেন দক্ষিণ ভারতের সুপারস্টার কমল হাসানকে৷ এঁরা প্রত্যেকেই এমন ফিল্মস্টার, যাঁদের সাধারণ মানুষ, বিনোদনপ্রিয় আমজনতা চেনে, জানে৷ চলচ্চিত্র উৎসবকে আরও জনপ্রিয় করে তুলতে আগামী বছর থেকে প্রতিযোগিতামূলক বিভাগ চালু করার কথাও এবার ঘোষণা করা হয়েছে৷ অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রী ঐকান্তিকভাবে চাইছেন, শুধু বিনোদনী মেজাজে নয়, মেধা এবং উৎকর্ষেও এই উৎসব চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠুক৷
১৯তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষ পুরস্কার পেয়েছে বাংলাদেশের মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘টেলিভিশন', যে ফারুকীকে এই মুহূর্তে অন্য ধারার বাংলা সিনেমার আর এক হোতা বলে মনে করা হচ্ছে৷ ফারুকী বলেছেন, চলচ্চিত্র উৎসবেই শুধু নয়, কলকাতা-ঢাকার সিনেমাহলেও দু'দেশের বাংলা ছবি দেখানো হোক, এমন একটা দিন দেখতে চান তিনি৷ কারণ আধুনিক প্রজন্ম আধুনিক চিত্রভাষার খোঁজ করছে৷ সর্বত্র সেটা ঘটছে, বাংলা সিনেমাতেও৷
এবারের চলচ্চিত্র উৎসবে একজন মানুষের না থাকাটা সবাইকেই বিষন্ন করেছে৷ তিনি প্রয়াত পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ৷ তাঁর মোট ছটি ছবি এবারে দেখানো হয়েছে, যার মধ্যে ‘রেনকোট' ছবির হিন্দি ‘তাক ঝাঁক' ছিল উৎসবের উদ্বোধনী ছবি৷ ঋতুপর্ণের ছবি দিয়ে এবার উৎসবের বিজ্ঞাপনী হোর্ডিংও দেখা গিয়েছে, যাতে সহাস্য ঋতুপর্ণের ছবির পাশে তাঁরই অননুকরণীয় কথার ভঙ্গিতে লেখা ছিল – তোরা আসিস!
এটাই যেন কলকাতার সমস্ত নাগরিক উৎসবের মূলমন্ত্র হয়ে উঠছে৷ গুরুগম্ভীর খোলস ছেড়ে সহজ, আন্তরিক এবং কাছের হয়ে ওঠা৷ কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব সেই রাস্তায় আরও এক পা এগিয়ে গেল৷