1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের সাফল্য ও বিজেপির ব্যর্থতার কারণ

পায়েল সামন্ত কলকাতা
৪ জুন ২০২৪

এই প্রতিবেদন লেখার সময় ২৯টি আসনে ঘাসফুল প্রার্থীরা জিতেছেন বা এগিয়ে রয়েছেন৷ বিজেপি এগিয়ে বা জয়ী ১২টির মতো আসনে৷ দাগ কাটতে পারেনি বাম ও কংগ্রেস জোট৷

https://p.dw.com/p/4gd35
লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থকেরা
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের প্রাপ্ত ভোটের হার ২০১৯ সাালের ৪৩ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৬ শতাংশে।ছবি: Goutam Hore/DW

সাত দফায় রাজ্যের ৪২টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ করা হয়৷ নির্বাচন শুরুর দেড় মাস পর মঙ্গলবার প্রকাশিত হলো ফলাফল৷ শীর্ষস্থানীয় সব বুথফেরত সমীক্ষায় বিজেপিকে রাজ্যের একক বৃহত্তম দল হিসেবে দেখানো হয়েছিল৷

তৃণমূলের আসন বৃদ্ধি

২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে তৃণমূল জোর ধাক্কা খেয়েছিল৷ উত্থান হয়েছিল বিজেপির৷ সেবার ২২টি আসনে জেতে ঘাসফুল শিবির৷ ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ঘুরে দাঁড়ায় তারা৷ সেই ধারা বজায় রইল লোকসভা ভোটে৷

এই ভোটে প্রায় ৩০টি আসন তারা জিততে চলেছে৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের প্রাপ্ত ভোটের হার বেড়েছে৷ গত লোকসভা নির্বাচনে তারা পেয়েছিল ৪৩ শতাংশ ভোট৷ এবার তাদের ভোট বেড়ে হয়েছে ৪৬ শতাংশ৷

বিজেপির খারাপ ফল

বিজেপি গত লোকসভা ভোটে ১৮টি কেন্দ্রে জয়ী হয়েছিল৷ ২০১৪ সালের থেকে ১৬টি বেশি৷ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দাবি করেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গে তাদের ফল সবচেয়ে ভালো হবে৷ এই দাবি ভুল প্রমাণিত হয়েছে৷ 

বিজেপি গতবারের তুলনায় আটটির মতো আসন কম পেতে চলেছে৷ ভোটও অনেকটা কমেছে৷ গত লোকসভায় বিজেপি ৪০ শতাংশ ভোট পেয়েছিল৷ এবার তাদের ভোট কমে হয়েছে ৩৮ শতাংশ৷ যে উত্তরবঙ্গে তৃণমূলকে মুছে দিয়েছিল বিজেপি, এবার ঘাসফুল শিবির সেই দুর্গ ভেঙে দিয়েছে৷

নিষ্প্রভ বাম-কংগ্রেস

বাম ও কংগ্রেস জোট বেঁধে ৪০ কেন্দ্রে ভোটে লড়েছিল৷ প্রচারে বেশ সাড়া জাগিয়েছিল৷ কিন্তু তারা মাত্র একটি আসনে জিতেছে৷ 

গত লোকসভায় বাম ও কংগ্রেস আলাদা লড়েছিল৷ সেবার তারা মোট নয় শতাংশের মতো ভোট পেয়েছিল৷ বামেরা কোনো আসনে জেতেনি, কংগ্রেস দুটি আসনে জিতেছিল৷ এইবার একসঙ্গে লড়ে তারা ১১ শতাশের মতো ভোট পেয়েছে৷ বামেরা খাতা খুলতে পারেনি এবারও৷ কংগ্রেস একটি আসন হারিয়েছে৷

বড় জয়-পরাজয়

লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে ইন্দ্রপতন৷ পাঁচবারের সাংসদ, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী হেরে গেছেন বহরমপুর কেন্দ্রে৷ তাকে হারান সাবেক ক্রিকেট তারকা ইউসুফ পাঠান৷ মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রে আশা জাগিয়েও হারতে হলো সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমকে৷ জোটের মুখ রেখেছে মালদহ দক্ষিণ৷ এখানে কংগ্রেসের ঈশা খান চৌধুরী জিতেছেন৷

উত্তরবঙ্গের নজরকাড়া আসন কোচবিহারে বিজেপি প্রার্থী নিশীথ প্রামাণিক হেরে গিয়েছেন তৃণমূলের বিরুদ্ধে৷ বিদায়ী মন্ত্রিসভায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের ডেপুটি ছিলেন তিনি৷ সাবেক কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী সুভাষ সরকার পরাজিত হয়েছেন বাঁকুড়া কেন্দ্রে৷ বালুরঘাটের বিদায়ী সাংসদ সুকান্ত মজুমদার কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন৷ তিনি বিজেপির রাজ্য সভাপতি৷

কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি পদ থেকে অবসর নিয়ে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বিজেপির টিকিটে ভোটে লড়েন৷ তিনি তমলুক কেন্দ্রে জয়ের পথে৷ একইভাবে অধিকারী গড় অটুট রেখে কাঁথিতে পদ্ম প্রতীকে জিতেছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর ভাই সৌমেন্দু৷

আসন বদলে হার হয়েছে বিজেপির সাবেক রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের৷ তাকে হারিয়েছেন সাবেক ক্রিকেট তারকা তৃণমূল প্রার্থী কীর্তি আজাদ৷ আসানসোলে জিতেছেন বলিউডের সাবেক তারকা, তৃণমূলের শত্রুঘ্ন সিনহা৷ তিনি হারান বিজেপি প্রার্থী সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুরিন্দর সিং আলুওয়ালিয়াকে৷

তারকার লড়াইয়ে জিতেছে তৃণমূল৷ ঘাটালে দেব ও হুগলি কেন্দ্রে রচনা বন্দ্যোপাধ্যায় জিতেছেন৷ কৃষ্ণনগর কেন্দ্র থেকে জিতে ফের লোকসভায় যাচ্ছেন মহুয়া মৈত্র৷ তিনি সংসদ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিল কয়েকমাস আগে৷

মতুয়া ভোটের সৌজন্যে বনগাঁ দখলে রাখতে পেরেছে বিজেপি৷ এখানে তাদের প্রার্থী বিদায়ী মন্ত্রিসভার প্রতিমন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর৷ 

কলকাতার দুটি আসনে তৃণমূল এগিয়ে৷ কলকাতা উত্তরে সকলের নজর ছিল৷ তৃণমূল ছেড়ে তাপস রায় বিজেপির প্রার্থী হয়েছিলেন৷ তার থেকে এগিয়ে গিয়েছেন তৃণমূলের সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়৷ দক্ষিণ কলকাতায় বিপুল জয়ের পথে মালা রায়৷

সিপিএমের টিকিটে লড়া তরুণ বাম প্রার্থীরা প্রচারে সাড়া জাগালেও প্রতিযোগিতায় দাঁড়াতে পারেননি৷ যাদবপুরে সৃজন ভট্টাচার্য, শ্রীরামপুরে দীপ্সিতা ধর, ডায়মন্ড হারবারে প্রতীক উর রহমান, তমলুকে সায়ন বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যুদস্ত হয়েছেন৷

রেকর্ড জয় অভিষেকের

দেশের মধ্যে রেকর্ড ভোটে জয়ের নজির গড়তে চলেছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়৷ ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্রে সাত লক্ষের বেশি ভোটে এগিয়ে রয়েছেন তিনি৷ ২০০৪ সালে লোকসভা ভোটে পাঁচ লক্ষ ৯০ হাজার ভোটে আরামবাগে জিতেছিলেন সিপিএমের অনিল বসু৷

বিরোধীদের অভিযোগ, ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্রে ভোটের দিন অধিকাংশ বুথে এজেন্ট বসাতে দেয়নি তৃণমূল৷ এদিন ভোট গোনার সময়ও সর্বত্র বিরোধী এজেন্টদের বসতে দেয়া হয়নি৷

কোন ফ্যাক্টরে জয়

তৃণমূলের জয়ের নেপথ্যে সবচেয়ে বড় অবদান হিসেবে দেখা হচ্ছে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পকে৷ এই প্রকল্পে নারীরা প্রতি মাসে ৫০০ টাকা পেতেন৷ নির্বাচনের আগে তা বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হয়৷ ভোটের মুখে সেই টাকা অ্যাকাউন্টে পাঠানো শুরু করে তৃণমূল সরকার৷ দুই কোটির বেশি নারী এই প্রকল্পের আওতায় রয়েছেন৷ তাদের ভোট তৃণমূলের পক্ষে গিয়েছে৷

রাজ্যের সংখ্যালঘু ভোটে থাবা বসাতে পারেনি বাম ও কংগ্রেস জোট৷ দাগ কাটতে পারেনি আইএসএফ৷ তাই মুসলমান ভোটের প্রায় পুরোটাই তৃণমূলের সঙ্গে থেকেছে৷ পশ্চিমবঙ্গ ও দেশের অন্যত্র ভোটপ্রচারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সরাসরি মুসলমানদের নাম করে যেসব মন্তব্য করেছিলেন, তাতে এ রাজ্যে মেরুকরণ আরো প্রবল হয়৷

রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘ভোটের আগেই প্রতি তিন জন মানুষের একজন বিজেপির সঙ্গে নেই৷ সংখ্যালঘুরা পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৩০ শতাংশ৷ অর্থাৎ ৭০ নম্বরের পরীক্ষা দিতে বসেছে বিজেপি, তৃণমূল কিন্তু ১০০ নম্বরের পরীক্ষা দিচ্ছে৷ ২ কোটি ১৮ লক্ষ ভোটার লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের সুবিধা পাচ্ছেন৷ অন্যান্য প্রকল্পও আছে৷ এতেই অঙ্ক পরিষ্কার হয়ে যায়৷''

বিজেপির ক্ষেত্রে নেতৃত্ব ও সংগঠনের দুর্বলতা হারের বড় কারণ হয়ে উঠে এসেছে৷ নিয়োগ দুর্নীতি, একশো দিনের কাজ বা আবাস যোজনায় দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে বড় আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি বিরোধীরা৷ সন্দেশখালি নিয়ে তোলপাড় হলেও ভোটে তা দাগ কাটতে পারেনি৷ বসিরহাট কেন্দ্রে তৃণমূল বিপুল ভোটে জিতেছে৷ এমনকি সন্দেশখালি বিধানসভাতেও বিজেপি প্রার্থী রেখা পাত্র এগোতে পারেননি৷

তাই বুথফেরত সমীক্ষা যাই বলুক, বাস্তবে রাজ্যের মানুষ অন্যরকম ভেবেছেন বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা৷ সাংবাদিক নির্মাল্য মুখোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘মানুষের ক্ষোভ তৈরি হয়নি, যেটা মনে করা হচ্ছিল৷ সেখানেই হিসেবে ভুল হয়ে গিয়েছে৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথাই মানুষ বিশ্বাস করেছে৷ বিজেপি এখনও পশ্চিমবঙ্গের দল হয়ে উঠতে পারেনি৷ কোথাও একটা কমিউনিকেশন গ্যাপ রয়ে গিয়েছে৷''

আর দুই বছর পর পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন৷ সেখানে বিরোধীদের খুব একটা আশা দেখছেন না রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও পর্যবেক্ষক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য৷ তিনি বলেন, ‘‘আর বছর দুয়েক সময় হাতে আছে৷ এর মধ্যে বিজেপি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বলে মনে হয় না৷ এবার প্রধানমন্ত্রী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রচার করার পরও যে ফল হলো, তাতে বোঝা যাচ্ছে, তৃণমূলকে বিধানসভা ভোটে হারানো খুবই কঠিন৷''