পরিবেশ সংরক্ষণে কাঠের তৈরি অভিনব বহুতল
১৪ জুলাই ২০২১সিমেন্ট দিয়ে তৈরি বাড়িঘরে থাকলে রাতে মানুষ কী স্বপ্ন দেখেন? নির্মাণের জায়গার মধ্যেই তার ইঙ্গিত খোঁজার চেষ্টা চলছে৷ সম্ভবত গাছপালা, খোলা জায়গা, বনজঙ্গল ও সেখানকার বাসিন্দারাই স্বপ্নে দেখা দেয়৷
ফলে অনেকের মনে যে সিমেন্টের জঙ্গল ছেড়ে চলে যাবার বাসনা জাগবে, তাতে বিস্ময়ের কারণ আছে কি? সিমেন্টের বদলে কাঠের কদর বাড়ছে৷ জার্মানিতে প্রতি পাঁচটি নতুন নির্মাণের মধ্যে একটিতে উপকরণ হিসেবে কাঠ ব্যবহার করা হচ্ছে৷ এর কারণ কী? স্থপতি হিসেবে ফরিদ শারাবি মনে করেন, ‘‘এমন কাঠের তৈরি বাসায় প্রবেশ করলে সেখানকার মান ও পরিবেশ দেখলে সবাই মুগ্ধ হয়৷’’
ইউটিবি কোম্পানির প্রধান টোমাস বেস্টগেন বলেন, ‘‘নির্মাণ শেষ হবার পর কাঠের বাড়িতে প্রবেশ করলে প্রথম দিন থেকেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন এবং বসবাসের একেবারে ভিন্ন পরিবেশ পাবেন৷’’
জার্মানিতেও কাঠের বহুতলের প্রবণতা
জার্মানির সবচেয়ে বড় কাঠের তৈরি বহুতল ভবন ‘ভোহো’-তেও সেই অনুভূতি হবার কথা৷ ৯৮ মিটার উঁচু ও ২৯ তলার বাড়িটি চোখে পড়ার মতো৷ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এমন প্রকল্প দেখা যাচ্ছে৷ বার্লিনও সেই প্রবণতার ব্যতিক্রম নয়৷ টোমাস বেস্টগেন বলেন, ‘‘বার্লিন রাজ্য কর্তৃপক্ষ গোটা পাড়া জুড়ে কাঠের তৈরি বাড়ি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ শহরে কার্বন নির্গমন বন্ধ করতে আমাদের উদ্যোগ নিতে হবে৷ নির্মাণের উপকরণ হিসেবে কাঠ তাতে সহায়তা করতে পারে৷ অনেক শতক জুড়ে কাঠ কার্বন ধারণ করেছে, ভেঙে ফেললেও কার্বন কাঠের মধ্যেই থাকে৷ সিমেন্টের তুলনায় এটাই সবচেয়ে বড় পার্থক্য৷’’
নির্মাণের ক্ষেত্রে এখনও সিমেন্ট মূল উপকরণ৷ বার্লিন শহরেও একটি গোটা এলাকা জুড়ে সিমেন্টের বাড়ি তৈরি হচ্ছে৷ মাত্র একটি বাড়ি কাঠ দিয়ে গড়ে তোলা হচ্ছে৷ বছরের শেষে সেটির কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার কথা৷ শুধু ভিত্তি ও সিঁড়ি সিমেন্ট দিয়ে তৈরি, বাকি অংশে শুধু কাঠ৷ স্থপতি হিসেবে ফরিদ শারাবি দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে এমন বাড়ি ডিজাইন করছেন৷ বার্লিনে তিনিই এমন শৈলির পথিকৃত৷ নিজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ফরিদ বলেন, ‘‘আমরা অবশ্যই পথিকৃৎ৷ ফলে পথিকৃতদের মতোই কষ্ট পেতে হয়েছে৷ পথ মসৃণ করতে অনেক বাধা পের হতে হয়েছে৷ কর্তৃপক্ষের অনেক প্রতিরোধের বিরুদ্ধেও লড়তে হয়েছে৷ আমাদের বিশেষজ্ঞদের দল গড়তে হয়েছে, মালিকদেরও আস্থা অর্জন করতে হয়েছে৷ শুরুর দিকে কোনো কিছুই সহজ ছিল না৷’’
এটি তার সর্বশেষ প্রকল্পগুলির মধ্যে একটি৷ ছয় তলার ভারি কাঠের ভবনে প্রায় ৪০টি ইউনিট রয়েছে৷ শারাবি ও তাঁর টিমের এই প্রকল্প ২০২১ সালের জার্মান টেকসই নির্মাণ পুরস্কারের চূড়ান্ত পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল৷ ফরিদ শারাবি বলেন, ‘‘সত্যি বলতে কি আমাদের কোম্পানি মোটেই ইকোলজির খাতিরে কাঠকে উপকরণ হিসেবে বেছে নেয় নি৷ আমি সম্ভবত ২০০৫ সালে শুধু নান্দনিক কারণে প্রথম সে বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করেছিলাম৷ আমার আসলে খুব ভালো লেগেছিল৷ এমন নির্মাণ যে পরিবেশবান্ধব এবং তাতে ব্যবহৃত কাঠ যে বিশাল পরিমাণ কার্বন-ডাই-অক্সাইডও ধারণ করে, সেটা আসলে পরে জানতে পেরেছিলাম৷’’
সমাজের সব শ্রেণির বাসভবন
কাঠের তৈরি বহুতল ভবনে ইকোলজিকল ফুটপ্রিন্ট ছাড়া অন্য বৈশিষ্ট্যও রয়েছে৷ হাতে গোনা ধনীদের বসবাসের টাওয়ার হিসেবে সেটি গড়ে তোলা হচ্ছে না৷ সেই বাড়িতে সমাজের সব স্তরের মানুষের বাসার কথা ভাবা হয়েছে৷ ইউটিবি কোম্পানির প্রধান টোমাস বেস্টগেন বলেন, ‘‘সেখানে প্রতিবেশীরা মিলেমিশে, সমাজবদ্ধ হয়ে থাকবেন৷ এমন প্রকল্পে জড়িয়ে পড়তে হলে আদর্শগত অবস্থান থাকতে হবে৷ কারণ কাঠ আসলে জীবন্ত, সেটি নড়াচ়়ড়া করে, শব্দ করে৷ ফলে সেটা মেনে নিতে হবে, মন থেকে চাইতে হবে৷’’
কিন্তু এমন নির্মাণের জন্য সবার আগে অনেক গাছ ধ্বংস করতে হয়৷ তাহলে সেই কাজ কী করে পরিবেশবান্ধব হতে পারে, এমন প্রশ্ন তো উঠতেই পারে৷ বেস্টগেন বলেন, ‘‘ঘটনা হলো, আমরা মোটেই টেকসই পদ্ধতিতে এমন কোনো জায়গায় গাছ কাটতে পারি না, যেখানে আর গাছ গজাবে না৷ বরং জার্মানি ও মধ্য ইউরোপে যে সম্পদ রয়েছে, তা দিয়েই আমাদের কাজ চালাতে হয়৷ তার বাইরে হাত বাড়ালে প্রকল্পটি আমাদের ইচ্ছামতো টেকসই হতো না৷’’
বার্লিনের মাঝে নির্মাণের জায়গায় এখনো প্রস্তুতি শুরু হয়নি৷ তবে কয়েক বছরের মধ্যেই কাজ শেষ হবার কথা৷ ২০২৬ সালে সম্ভবত ভবনটি তৈরি হয়ে যাবে৷
ইওয়াখিম এগার্স/এসবি