নতুন কলরেট নিয়ে গ্রাহকরা সংশয়ে
১৮ আগস্ট ২০১৮সোমবার রাত ১২টার পর থেকে বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের নতুন কল রেট চালু হয়েছে৷ মিনিটে সর্বনিম্ন কলরেট ৪৫ পয়সা আর সর্বোচ্চ ২ টাকা৷ নতুন ব্যবস্থায় অননেট আর অফনেট তুলে দেয়া হয়েছে৷ করা হয়েছে ফ্ল্যাট রেট৷ অননেট হল একই অপারেটরের মধ্যে কল আদান প্রদান৷ আর অফনেট হল এক অপারেটর থেকে অন্য অপারেটরে কল আদান-প্রদান৷
নতুন ফ্ল্যাট কলরেট চালু হওয়ার আগে বর্তমানে সর্বনিম্ন অননেট কলচার্জ প্রতি মিনিট ছিল ২৫ পয়সা ও অফনেট ৬০ পয়সা৷ সর্বোচ্চ চার্জ প্রতি মিনিট ২ টাকা৷ নতুন ব্যবস্থায় বিটিআরসি সর্বোচ্চ ২ টাকা ঠিক রেখে অফনেট এবং অননেট বাদ দিয়ে সর্বনিম্ন কলচার্জ করেছে ৪৫ পয়সা৷ অফনেট-অননেট ব্যবস্থা তুলে দেয়া হয়েছে৷
বিটিআরসির হিসেবে বাংলাশে এখন মোট মোবাইল ফোন গ্রাহক ১৫ কোটির বেশি৷ মোট অপারেটর ৪টি- গ্রামীণ, রবি, বাংলালিংক এবং টেলিটক৷ এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি গ্রাহক গ্রামীণের, প্রায় ৭ কোটি৷ আর সবচেয়ে কম গ্রাহক টেলিটকের, ৩০ লাখ৷ রবির গ্রাহক প্রায় সাড়ে ৪ কোটি এবং বাংলালিংক- এর গ্রাহক ৩ কোটির বেশি৷
মোবাইল ফোনের নতুন কলচার্জ নিয়ে আছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া৷ ব্যবসায়ী সুমন জাহিদ গ্রামীণ ফোন ব্যবহার করেন৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে জানান, তাঁর মনে হচ্ছে আগের চেয়ে কলচার্জ বেশি হচ্ছে৷ কারণ জানাতে গিয়ে বলেন, ‘‘আগে আমার মাসে দুই হাজার টাকা খরচ হতো। কিন্তু তিন দিন আগেই আমার কাছে ম্যাসেজ এসছে যে আমার ৭০ ভাগ খরচ হয়ে গেছে৷ তাই বোঝা যাচ্ছে যে খরচ বাড়ছে৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘বাংলাদেশে পৃথিবীর সবচেয়ে কম কলচার্জ হওয়া উচিত৷ কারণ এখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব৷ অস্ট্রেলিয়ায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকার জন্য একটি টাওয়ার বসিয়ে গ্রাহক পাওয়া যায় পাঁচ হাজার৷ আর বাংলাদেশে একই খরচে পাওয়া যায় পাঁচ লাখ৷
সর্বনিম্ন কলরেট কি সত্যিই ২৫ পয়সা ছিল?
আগে সর্বনিম্ন কলরেট ২৫ পয়সা ছিল৷ আর সর্বোচ্চ ২ টাকা৷ এর মানে এই নয় যে সর্বনিম্ন কলরেট ২৫ পয়সাই ছিল৷ অপারেটররা সর্বনিম্ন এবং সার্বোচ্চ সীমার মধ্যে থেকে কল চার্জ নির্ধারণ করতেন৷ কয়েকটি অপারেটরের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় বাস্তবে অননেট কলরেট ছিল ৪০ পয়সা থেকে ৫২ পয়সা৷ আর অফনেট কল চার্জ ছিল কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক টাকারও বেশি৷ গড়ে ৮০ পয়সা থেকে ১ টাকা ৪০ পয়সা৷
কিন্তু এখন আর অফনেট -অননেট নেই৷ ফলে ফ্ল্যাট রেট হবে৷ অপারেটররা এখন এই সর্বনিম্ন ফ্ল্যাট রেট প্রতি মিনিট কত ধার্য করেন তার ওপর আসলে নির্ভর করবে গ্রাহকের খরচ বাড়বে কী কমবে৷ গ্রামীণ ফোনের হেড অব এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স সৈয়দ তালাত কামাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা বিটিআরসির নির্দেশ কার্যকর করছি৷ প্যাকেজগুলোতে নতুন করে ঠিক করছি৷ তবে এর প্রভাব কি হবে তা এখনই বলা সম্ভব নয়৷''
তবে কোনো অপারেটরই এখনো কলচার্জ বাড়ানোর কোনো ঘোষণা দেয়নি৷ বাংলালিংকের চিফ কর্পোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স অফিসার তাইমুর রহমান ডয়চে ভেলেক বলেন, ‘‘আমার মনে হয় নতুন এই ব্যবস্থায় গ্রাহকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না৷ বরং তারা লাভবান হবেন৷ কারণ তাঁরা অফনেটের বড় আকারের কলচার্জ থেকে রেহাই পেয়েছেন৷ এখন সব অপারেটরেই কলের একই চার্জ৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘এখন আর সাত কোটি বা তিন কোটির পরিবার নেই৷ এখন ১৫ কোটি গ্রহকের একটি পরিবার৷ কলরেটও এক৷''
কল রেট সম্পর্কে কতটা সচেতন গ্রাহক?
বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রাহকই আসলে জানেন না তার মোবাইল ফোনের প্রতি মিনিট কলচার্জ কত৷ একজন গ্রাহক জাকিয়া আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সর্বনিম্ন ২৫ পয়সা থেকে ৪৫ পয়সা করায় আমিতো ক্ষতিগ্রস্ত হলামই৷ কলচার্জ বেড়ে গেল৷ আমি সাংবাদিকতার জন্য অনেক্ষণ ধরে মোবাইলে কথা বলি৷ এখন তো খরচ বেড়ে যাবে৷''
তিনি একটি বড় অপারেটরের গ্রাহক৷ তাঁকে যখন প্রশ্ন করা হল, আপনি কি জানেন আগে আপনার অপারেটর প্রতি মিনিটে কত চার্জ নিত? জবাবে তিনি বলেন, ‘‘না আমি জানতাম না৷ আর এখন কত নেয় তাও জানিনা৷'' তাঁর ধারণা ছিল, আগে ২৫ পয়সার চার্জ বাড়িয়ে এখন ৪৫ পয়সা করা হয়েছ৷ কিন্তু পরে দেখা গেছে, তাঁর অপারেটর আগেও প্রতি মিনিট ৫২ পয়সা নিত, বিটিআরসির নতুন সিদ্ধান্তের পরও ৫২ পয়সাই নিচ্ছে৷
জাকিয়া আরো বলেন, ‘‘শুনেছি এফএনএফ প্যাকেজ বাতিল হয়ে যাবে৷ আমরা খুব কম পয়সায় ওই প্যাকেজে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতাম৷ এখন সে সুযোগ থাকবেনা৷''
আরেকজন সাংবাদিক সাদ্দিফ অভি বললেন ভিন্ন কথা৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমার মনে হয় সুবিধা হয়েছে৷ কারণ আমি যে অপারেটরের গ্রাহক, তার বাইরে সব অপারেটরের গ্রাহকের সঙ্গেই আমার কথা বলতে হয় পেশাগত প্রয়োজনে৷ ফলে আমাকে অফনেট চার্জ দিতে হত বেশি৷ বেশি বিল গুণতে হত৷ এখন সব কল রেটই এক৷ ফলে আমার মনে হয় আমার বিল কমবে৷''
বাংলাদেশে মোট মোবাইল ফোন কলের শতকরা কত ভাগ অননেট আর কতভাগ অফনেট, তার কোনো সঠিক পরিস্যংখান জানা যায়নি৷ তবে যে অপারেটরের গ্রাহক বেশি তার অফনেট কল কম৷ আর যে অপারেটরের গ্রাহক কম তার অফনেট কল বেশি হওয়ার কথা৷ আর অফনেট কলের চার্জ যেহেতু অনেক বেশি ছিল তাই গ্রাহকরা খরচ কমাতে একাধিক অপারেটরের মোবাইল সংযোগ ব্যবহারে বাধ্য হন৷ এখন অফনেট আর অননেট ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়ে ফ্ল্যাট রেট করায় মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো বিলের নানা প্যাকেজ অফার না দিয়ে সেবার মান বাড়াতে বাধ্য হবে বলে মনে করছেন অনেকেই৷
এদিকে মোবাইল ফোনের কলরেট নিয়ে কথা হলেও অনেক গ্রাহক আসলে সে সম্পর্কে সচেতন না৷ শত শত প্যাকেজ আর নানা অফারের হিসেবের ভিড়ে তা বোঝাও কঠিন৷ এরমকম একজন গ্রাহক আমানুর রহমান রনি বলেন, ‘‘কত কলচার্জ সে হিসাব রাখিনা৷ হিসাব করাও কঠিন৷ নানা প্যাকেজ, নানা অফার৷ এগুলো বুঝতে গণিতে ভালো হতে হয়৷ আমার একটাই কথা কম খরচে মোবাইল ফোর ব্যবহার করতে চাই৷''
ফ্ল্যাট রেটের উদ্দেশ্য কী?
অপারেটরদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে অভিন্ন কল রেট চালুর মূল উদ্দেশ্য মোবাইল নাম্বার পোর্টেবিলিটি- এমএনপি চালু করা৷ এই ব্যবস্থায় নম্বর না বদলিয়ে অপারেটর বদল করতে পারবেন গ্রাহকরা৷ তাই অভিন্ন কলরেট না হলে গ্রাহকরা অসুবিধায় পড়বেন৷
গত ১ আগস্ট থেকে দেশে এমএনপি সেবা চালুর কথা থাকলেও কারিগরি প্রস্তুতির কারণে তা দুই মাস পেছানো হয়৷ নতুন তারিখ অনুযায়ী আগামী ১ অক্টোবর দেশে এমএনপি চালু হওয়ার কথা৷
তবে নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটির ইলেকটিক্যাল এন্ড কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক এবং টেলিকম বিশেষজ্ঞ ড. রোকনুজ্জামান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘নতুন কল রেটের কারণে গ্রাহকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন৷ কারণ অন নেট কল অনেক বেশি৷ আর দেশে একটি অপারেটরের প্রধান্য থাকায় অননেট কলও বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক৷ গ্রাহকরা নানা প্যাকেজের আওতায় যে কল রেট সুবিধা পেতেন৷ কলচার্জ কমানোর যে প্রতিযোগিতা ছিল সেটাও আর থাকবেনা৷ ফলে গ্রাহজের চার্জ বাড়বে৷ আর বাজারের অপারেটরদের গ্রাহক সংখ্যার পার্থক্য থাকায় ভারসাম্য হারাবে৷ অফনেট থেকে ছোট গ্রাহকরা যে বাড়তি আয় করত তা তারা হারাবে৷''