দুর্গার সাজে জার্মানির ছোঁয়া
১১ অক্টোবর ২০২০করোনা সংকটে যখন পার্বণের রং ফিকে, তখন বাবু সংস্কৃতির সেই ইতিহাস ফের জাগছে ঠাকুরদালানে৷
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে বাংলার ব্যবসায়ীরা নানা ধরনের পণ্যের ব্যবসার মাধ্যমে সমৃদ্ধি অর্জন করেছিলেন৷ কলকাতায় গড়ে উঠেছিল তাঁদের বিলাসবহুল ভবন, সেখানে দুর্গাপুজোর আয়োজনও ছিল বৈভব প্রদর্শনের মঞ্চ৷ এই পুজোর সঙ্গে ইউরোপের সাহেবরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন৷ মূলত তাদের আমোদপ্রমোদের পার্বণ হয়ে উঠেছিল বাংলার প্রাণের উৎসব৷ পর্যটন মন্ত্রকের অধীনে ইন্ডিয়ান ট্যুরিজম কলকাতা প্রকল্পে এবার সেই ইতিহাসের উপর আলোকপাত করা হচ্ছে৷ জোড়াসাঁকোর শিবকৃষ্ণ দাঁ-এর বাড়ির নাটমণ্ডপে কথা ও সুরে উঠে আসছে পুরোনো কলকাতা৷
১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধের পর কলকাতায় প্রথম দুর্গাপুজো হয় শোভাবাজার রাজবাড়িতে৷ তখন থেকেই ব্রিটিশ প্রভুরা শহরের বাবুদের আয়োজনে প্রধান অংশীদার৷ আমিষ ভোজন থেকে ঢালাও সুরা পরিবেশন কিংবা বাঈজি নাচ, প্রমোদের সব উপকরণই থাকত পুজোর দিনগুলিতে৷ শুধু এই হুল্লোড় নয়, পুজো ঘিরে বাংলার সঙ্গে আত্মিক যোগ ছিল ইউরোপের৷ সেই সময় প্রতিমার সাজ আসত জার্মানি থেকে৷ ডাক মারফত এদেশে সেই উপকরণ আসায় বলা হত ডাকের সাজ৷ এখন আর তা আসে না, তবু লোকমুখে ‘ডাকের সাজ’ কথাটি রয়ে গিয়েছে৷ সেই সাজের এখনো দেখা মেলে কলকাতার কোনো কোনো বনেদি বাড়িতে৷ উপনিবেশ অতীত হয়ে গেলেও আজও বাংলার প্রাণের প্রতিমার সাজে থাকে জার্মানির ছোঁয়া৷ ১৯৪২ সাল পর্যন্ত ডাকের সাজ কলকাতায় আসত৷ এখনও শিবকৃষ্ণ দাঁ-এর বাড়ির চালচিত্রে মিশ্র ধাতুর জার্মান তবক ব্যবহার করা হয়৷
এমনই নানা টুকরো কথার মালায় সেজে উঠেছে ১০ অক্টোবরের আগমনী৷ মূল ব্যবস্থাপক টুইনস ট্যুর-এর অন্যতম কর্ণধার অরিজিৎ দত্ত ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পুরোনো কলকাতার বাবু সংস্কৃতির সঙ্গে পুজোর যোগকে তুলে ধরাই আমাদের উদ্দেশ্য৷ সেই সংস্কৃতির সঙ্গে ইউরোপীয়দের যে যোগ আছে সেটা বিদেশের মানুষ জানেনই না৷ আমরা তাঁদের সামনে কলকাতার উৎসবকে তুলে ধরেছি৷ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের পর্যটকেরা এখানে এসে পুজোর আনন্দ নিয়েছেন৷’’ অরিজিৎ জানান, দুবছর আগে ডাচ পর্যটকদের একটি দল এই শহরে এসে মণ্ডপে সাইকেলের থিম দেখে অভিভূত হয়ে গিয়েছিল৷ অন্য মহাদেশের দর্শনার্থীরাও বিশ্বের সর্ববৃহৎ উন্মুক্ত শিল্প প্রদর্শনী এই উৎসব চাক্ষুষ করেছেন৷ এমনকি আর্জেন্টিনার এক পর্যটক লুঙ্গি পরে ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছিলেন৷
কিন্তু এবার সব হিসেব বদলে দিয়েছে করোনা৷ বাড়ির পুজো, ইউরোপীয় স্থাপত্য রীতিতে তৈরি ভবন দেখতে বিদেশি পর্যটকেরা কলকাতায় আসেন, তাঁরা এবার আসতে পারছেন না৷ এর ফলে বিপুল ক্ষতির মুখে পড়েছেন পর্যটন শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মানুষজন৷ সেই খেদ মেটাতে পারে আগমনী বৈঠক৷ এই অনুষ্ঠানের পরিকল্পনায় রয়েছেন কলকাতার ইতিহাস সম্পর্কে অনুসন্ধিৎসু, বনেদি বাড়ির সদস্য ইন্দ্রদীপ নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সামাজিক মাধ্যমের যুগেও বাঙালির বৈঠকের গুরুত্ব হারায়নি৷ একসঙ্গে বসে আলাপচারিতার মতো আত্মিক যোগ ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপে তৈরি হয় না৷ আমাদের বৈঠকী সাজানো হয়েছে অতীত কলকাতার গল্প ও গানে৷'' ইংরেজদের তুষ্ট করার জন্য বাবুরা মাতৃবন্দনায় ইংরেজি শব্দ যুক্ত করেছিলেন৷ এমন চমকপ্রদ তথ্য উৎসবেরই ইতিহাস হয়ে আছে৷ তাই বৈঠকে এমন কাহিনীর সঙ্গে থাকবে আগমনী ও টপ্পা৷ গানে গানে একুশ শতকে এই শহরে উপস্থিত হবেন দাদাঠাকুর শরৎচন্দ্র পণ্ডিত, রসরাজ অমৃতলাল, রূপচাঁদ পক্ষী৷
পশ্চিমবঙ্গে সাগর থেকে পাহাড়, অরণ্য থেকে মালভূমির পাশাপাশি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক পর্যটনের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে৷ কিন্তু তার সবটা এখনো আবিষ্কার করা যায়নি৷ দুর্গাপুজো তেমনই একটি সুযোগ৷ পর্যটন মন্ত্রকের আঞ্চলিক অধিকর্তা (পূর্ব) সাগ্নিক চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘করোনাতে এবার সবকিছুই টালমাটাল৷ তার মধ্যে আগমনী বৈঠকের মাধ্যমে আমরা উৎসবের সূচনা করতে চাইছি৷ আরো একাধিক কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে৷ আসলে শুধু পুজোকে তুলে ধরা নয়, এমন একটা উৎসবকেই আমরা পর্যটন বিকাশের লক্ষ্যে ব্যবহার করতে চাইছি৷’’
ইন্ডিয়া ট্যুরিজম-এর উদ্যোগে কোভিড পরিস্থিতিতে সতর্কতা হিসেবে জেলার আটটি বনেদি বাড়িকে করোনা কিট সরবরাহ করা হচ্ছে৷ একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক জুরি অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হবে কলকাতার পুজো কমিটিগুলোকে৷