ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের জীবনে বেনজীর যায়, ‘বেনজীর’ আসে
২৬ ডিসেম্বর ২০২৪পাশের পাড়ার গির্জায় বড় দিন উদযাপন করতে যাওয়ায় রাতের আঁধারে ত্রিপুরাদের বাড়ির সব পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা৷
বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই তংগোঝিরি এলাকায় পূর্ব-বেতছড়া পাড়ায় ৫০ একর জমি দীর্ঘদিন পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীর আহমেদের দখলে ছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ দিকে বেনজির আহমেদের বিরুদ্ধে একাধিক দুর্নীতির মামলা হলে তিনি বিদেশে পালিয়ে যান। তখন উচ্ছেদ হওয়া ত্রিপুরারা তাদের জমিতে ফিরে ঘর-বাড়ি তৈরি করে বলে পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
১৭টি বাড়িতে আগুন দেয়ার ঘটনায় যে মামলা হয়েছে তাতে সাত জনকে আসামি করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে বেনজিরের ওই এলাকার কেয়ারটেকার মো. ইব্রাহিমও আছে। ইব্রাহিমসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার হওয়া বাকিরা হলেন মাসৈনিয়া ত্রিপুরা, যোয়াকিম ত্রিপুরা ও ছবি ছন্দ্র ত্রিপুরা।
চারজনই এজাহারভুক্ত আসামি। লামা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এনামুল হক ভুঁইয়া বলেন, ‘‘বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।'' আগুনে ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষে তাদের বিরুদ্ধে লামা থানায় মামলা করেছেন গুঙ্গামনি ত্রিপুরা। মামলার এজাহারে আগে চাঁদা দাবি এবং দখলের হুমকির অভিযোগ করা হয়েছে।
কী ঘটেছিল মঙ্গলবার রাতে
পূর্ব-বেতছড়াপাড়ায় মোট ১৯টি পরিবার ১৯টি বাড়ি তৈরি করে ছয়-সাত মাস আগে থেকে বসবাস করে আসছিল। নতুন স্থাপিত এই পাড়ায় গির্জা না থাকায় পাড়াবাসী বড়দিন উদযাপনের জন্য মঙ্গলবার কয়েক কিলোমিটার দূরে তংগোঝিরি নামের আরেকটি পাড়ার গির্জায় গিয়েছিলেন। ওই পাড়ায় তাদের স্বজনরা থাকেন। তাদের অনুপস্থিতির সুযোগে দুর্বৃত্তরা রাতে আগুন দিয়ে ১৯টি বাড়ির ১৭টিই পুড়িয়ে দেয়। যাদের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে তাদের একজন চন্দ্রমনি ত্রিপুরা। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমরা পাশের পাড়ায় সবাই গিয়েছিলাম, কারণ, আমাদের নতুন পাড়া হওয়ায় গির্জা ছিল না। ১৯ বাড়ির সবাই চলে যাওয়ায় পাড়া ফাঁকা ছিল। রাত ১২টার পরে আমরা আগুনের খবর পাই। কেউ কেউ রাতে এলেও ভয়ে আমি আসিনি। সকালে এসে দেখি ১৯টি বাড়ির ১৭টি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।”
তিনি জানান, "কোনো বাড়িতেই কিছু অবশিষ্ট নাই। আমাদের চাল-ডাল, বাসনকোসন, ঢাকা-পয়সা , কাপড়-চোপড় সব পুড়ে গেছে। আমাদের পরনের পোশাক ছাড়া আর কিছু নাই। বাড়িগুলোতে নারী ও শিশু মিলিয়ে কমপক্ষে ১০০ মানুষের বসবাস ছিল।”
তিনি অভিযোগ করেন, "ছয়-সাত মাস আগে আমরা এখানে বাড়ি করার পর থেকেই আমাদের কাছে পরিবার প্রতি ৫০ হাজার টাকা করে চাঁদা দাবি করে আসছিল দুর্বৃত্তরা। তারা দখল করে নেয়ারও হুমকি দিচ্ছিল। আমরা এটা নিয়ে থানায় একাধিকবার জিডিও করেছিলাম। তখন পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।”
তিনি জানান, "১০ বছর আগে আমাদের এই জমি দখল করে নিয়েছিল পুলিশের বেনজির আহমেদ। এখানে তিনি রাবার বাগন করতে চেয়েছিলেন। তবে তিনি আমাদের জমিতে লিচু, লেবু ও আমের বাগান করেন। তার আগে আমরা এখানে জুম চাষ করতাম। তার বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার পর ছয়-সাত মাস আগে আমরা আমাদের জমিতে ফিরে এসে ঘর-বাড়ি তৈরি করি। ঘরগুলো ছিল মাচান ঘর।”
আরেকজন ক্ষতিগ্রস্ত তনসরাই ত্রিপুরা ডয়চে ভেলেকে বলেন, "তংগোঝিরি পাড়ায় আমাদের বাবা-মা থাকেন। আমরা এখানে চলে আসি বেনজির সাহেবের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার পর। ওই রাতে আমরা সবাই বড় দিনের প্রার্থনা করতে তংগোঝিরি পাড়ায় যাই। এখন আগুন দিয়ে আমাদের নতুন পাড়া পুড়িয়ে দেয়ার পর ছেলে-মেয়ে তংগোঝিরি পাড়ায় আমাদের আত্মীয়-স্বজনের কাছে আছে। আমরা আসলে দিন মজুর ও জুম চাষ করে খাই। আমাদের তেমন কিছু নাই। আগুনের পর আমাদের চাল ও কম্বল দেয়া হলেও আমরা যে নতুন করে ঘর তুলবো তার কোনো ব্যবস্থা হয়নি। আমরা ভাবতে পারছি না এই শীত আমাদের কীভাবে কাটবে।”
ওই এলাকার হেডম্যান দুর্যোধন ত্রিপুরা বলেন, "আসলে দুইটি ছাড়া সব ঘরই পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ওই জমি নিয়ে আগেই দ্বন্দ্ব ছিল। বেনজির সাহেব জায়গা দখলের পর তার সঙ্গে কয়েকজন পাহাড়ি ও বাঙালি ছিল। তার একজন কেয়ারটেকারও ছিল। তবে বেনজির সাহেব পলাতক হওয়ার পর তার সঙ্গের পাহাড়ি ও বাঙালিরা নতুন পাড়া করে ঘর-বাড়ি বানানোর বিরুদ্ধে ছিল। তারা হুমকিও দিয়ে ্অসছিল।”
ত্রিপুরাদের নতুন এই পাড়াটি সরাই ইউনিয়নের আট নাম্বার ওয়ার্ডে। ওই ওয়ার্ডের মেম্বার জামাল উদ্দিন বলেন, "ওই পাড়াটি ‘এসপির বাগান' নামে পরিচিত ছিল। বেনজির সাহেব নিয়ন্ত্রণ করতেন তার কেয়াটেকার ইব্রাহিমকে দিয়ে। তবে ৫ আগস্টের পর ইব্রাহিমও চলে যায়। আর তার আগেই নতুন করে ঘর-বাড়ি তৈরি করে ত্রিপুরা। ওই জমিতে তারা আগে জুম চাষ করতো।”
প্রশাসন যা বলছে
লামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রূপায়ন দেব জানান, "আমি বুধবারই ওই এলাকায় যাই। সেখানে প্রায় সব বাড়িই পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বড় দিনে তারা আরেক পাড়ায় যাওয়ায় দুর্বৃত্তরা সেই সুযোগে আগুন দিয়েছে। তারা অস্থায়ীভাবে কয়েক মাস আগে বাড়ি করেছে। তাদের পূর্ব পুরুষের সবার বাড়ি আছে পাশেই তংগোঝিরি পাড়ায়। ওখানে ৬০টি পরিবার বসবাস করে। তারমধ্যে ১৯টি পরিবার কয়েকমাস আগে নতুন পাড়ায় চলে আসে। তার মধ্যে ১৭টি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।”
তার কথা, "আমরা কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখেছি- এটা খাস জমি। তবে ত্রিপুরারা এখানে জুম চাষ করতো। ১৯৯৫ সালে কয়েকটি গ্রুপ ৫০ একরের মতো জমির পূর্ব-বেতছড়া লিজ নেয়ার আবেদন করে। তবে কাউকেই বরাদ্দ দেয়া হয়নি। তাদের মধ্যে বেনজির সাহেব ওটা দখল করে রেখেছিলেন। ওই শত্রুতার জেরেই আগুন দেয়া হতে পারে।”
লামা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এনামুল হক ভুঁইয়া বলেন, "তাদের আগে চাঁদা ও দখলের হুমকি দেয়া হয়েছে। তবে তারা আগে জিডি করেছে কিনা আমার জানা নাই। এলাকাটি দুর্গম, আমরা তাই নজর রাখতে পারিনি। তবে এখন আমরা নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছি। ওই এলাকায় পুলিশ দেয়া হয়েছে।”
"শত্রুতার জেরে আগুন দেয়া হয়েছে। আরো একটি গ্রুপ ওই জমি দখলে নিতে চাইছিল বলে জানতে পেরেছি। এখন মামলা হয়েছে। আমরা মামলা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছি,” বলেন তিনি।
পুড়িয়ে দেয়া ১৭টি বাড়ির মানুষদের উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পরিবার প্রতি ১০ কেজি চাল, শুকনা খাবারের প্যাকেট ও দুটি করে কম্বল দেয়া হয়েছে। তবে পুড়ে যাওয়া বাড়ি নির্মাণে কোনো সহায়তা এখনো দেয়া হয়নি। বৃহস্পতিবার বান্দরবান জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা এবং ক্ষতিগ্রস্তদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়ার আশ্বাস দেন।
প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের তীব্র নিন্দা
ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের ওই পাড়ায় অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ‘তীব্র নিন্দা' জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। বুধবার মধ্যরাতে এক বার্তায় তার দপ্তর বলেছে, "বান্দরবান পুলিশ জানিয়েছে যে, তারা ঘটনাস্থলে তাদের কর্মকর্তা পাঠিয়েছে। পুলিশ অপরাধীদের গ্রেপ্তারেও অভিযান চালিয়েছে। এই ঘটনায় একটি এফআইআর দায়ের করা হয়েছে।”
শুক্রবার পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা বান্দরবানে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের ক্ষতিগ্রস্ত ঘর-বাড়ি ও এলাকা পরিদর্শন করবেন। এ সময় তিনি ঘর-বাড়িতে অগ্নিসংযোগকারী গুন্ডাদের ছাড় দেওয়া হবে না বলে হুঁশিয়ারি দেন। তিনি বলেন, "বান্দরবান গোয়েন্দা সংস্থা ইঙ্গিত দিয়েছে পলাতক সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের সন্দেহভাজন গুন্ডারা জায়গা দখলের নামে এই জঘন্য হামলা চালিয়েছে।’’