তিউনিশিয়ার ভবিষ্যৎ
২৯ এপ্রিল ২০১৩আদেল আর কোনো পথ খুঁজে পায়নি৷ ২০১৩ সালের ১৩ই মার্চ দিনের শুরুতেই এই ২৭ বছর বয়সের যুবক রাজধানী তিউনিসের বিপণীসমৃদ্ধ রাজপথে নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে মৃত্যুবরণ করেন৷ অগ্নিদগ্ধ অবস্থাতেই সে নাকি চিৎকার করে বলেছিল: ‘‘এই দেখো! এই হলো তিউনিশিয়ার যুবসমাজ, যারা রাস্তায় সিগারেট বেচে৷ এই হলো বেকারত্ব৷''
বেকারত্ব, দারিদ্র্য, আশাহীনতার বিরুদ্ধে চিৎকার৷ দু'বছর আগে বিপ্লব শুরু হওয়া যাবৎ যা কিছু করা হয়নি, যা কিছু অকৃত থেকে গেছে, তারই পরিচয় বহন করছে আদেলের এই মরিয়া, আত্মবিনাশী পদক্ষেপ৷ সেই পদক্ষেপও যেন ইতিহাসের প্রতিধ্বনি, কেননা ২০১১ সালের আরব বিপ্লব শুরু হয়েছিল আরেক তিউনিশীয়'র অগ্নিতে আত্মাহুতির ফলে৷ তার নাম ছিল মোহামেদ বুয়াজিজি, গ্রাম থেকে আসা এক সবজি বিক্রেতা৷ বুয়াজিজির মতোই আদেল খেদ্রিও ছিল গাঁয়ের মানুষ৷
সোনার ফসলের প্রতীক্ষায়
আদেলের বাড়ি ছিল উত্তর তিউনিশিয়ার সুক জেমা গ্রামে৷ সেখানে তিউনিসের নতুন সরকার কিংবা সাংবিধানিক সম্মেলনের কোনোরকম সিদ্ধান্ত থেকে কিছুমাত্র ফললাভ হয়নি৷ বলতে কি, সারা দেশ জুড়ে একই চিত্র৷ আদেল খেদ্রির পরিবারের মতো মোট ত্রিশ লাখ তিউনিশীয় – দেশের জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ – দিন আনে, দিন খায়৷ ঘুপসি, অন্ধকার ঝুপড়িগুলোতে শীতে ঘর গরম রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই৷ রাষ্ট্র-রাজনীতিতে তাদের কিছু আসে যায় না৷ কিন্তু আদেলের মৃত্যুর পর এই দীন-হীন-বঞ্চিতদের রোষ যেন ফুটে বেরোয়: সমাধি অনুষ্ঠান পরিণত হয় গণপ্রতিবাদে৷ এমনকি সরকারের পদত্যাগের দাবিও ধ্বনিত হয়৷
সাবেক শাসক বেন আলির আমলেই দেশের রাজনীতি এই দরিদ্র জনতার দিকে ফিরেও তাকায়নি৷ বিদ্রোহের পর দু'বছর কেটে গেছে, এখনও তাদের দাবি পূরণের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না৷ আদেলের চাচাতো ভাই আহমেদ খাজরির সহজ ব্যাখ্যা হলো: ‘‘রাজনীতিতে চলে শুধু বিতর্ক আর ক্ষমতা নিয়ে কাড়াকাড়ি৷'' গোড়ায় যারা বিদ্রোহের জন্য পথে নেমেছিল, তারাই আজ বলে: ‘‘ওরা আমাদের বিপ্লবকে চুরি করেছে৷''
বিদেশ থেকে আসছে অর্থ, ধর্মাদর্শ
তিউনিশিয়ায় ক্ষমতার লড়াই চলেছে৷ কিন্তু সমাজ চলেছে কোথায়? ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন কি সম্ভব হবে? নাকি তিউনিশিয়াও কোনো ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের মতো শরিয়া আইনের দিকে এগোচ্ছে?
বিপ্লবই সোফিয়ানে চৌরাবিকে ব্লগার করে তোলে৷ দেশের অধিকাংশ মানুষ রক্ষণশীল ইসলামের অনুসারী একটি রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থা কামনা করে, বলে তাঁর ধারণা৷ এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যা বিদেশ থেকে প্রচুর অর্থসাহায্য পাবে – যেমন সৌদি আরব ও কাতারের মতো রক্ষণশীল সুন্নি ইসলামের দেশ থেকে৷
সাংবাদিক, লেখক সালাহিদীন আল-জুর্শি বলেন, ‘‘বিপ্লবের পর তিউনিশিয়ায় রাষ্ট্র খুব দুর্বল ছিল – আজও রয়েছে৷ বাইরের শক্তিরা এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে দেশে চরমপন্থিদের আস্কারা দিচ্ছে ও মধ্যমপন্থিদের দাবানোর চেষ্টা করছে৷'' বিপ্লবের পরই উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে অর্থ ও ইমামদের আসা শুরু হয়ে যায়৷
সালাফিরা ভয় দেখাতেও ভয় পায় না
‘‘আগে সাংবাদিকদের স্বৈরাচারী রাষ্ট্রের খামখেয়ালিপনা সহ্য করতে হতো৷ আজ আমরা সমাজের তরফ থেকে নতুন এক ধরনের জুলুম দেখতে পাচ্ছি,'' বলেছেন সোফিয়ানে চৌরাবি৷ তিউনিসের বিভিন্ন এলাকায় মহিলারা ইসলাম-সম্মত জামাকাপড় না পরলে, অথবা তরুণ কি যুবকরা মদ্যপান করলে, ইসলামপন্থিদের দল তাদের ভীতিপ্রদর্শন করে৷
তিউনিস বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী-পুরুষের সমানাধিকার ও আন্তঃ-সংস্কৃতি গবেষণার অধ্যাপিকা আমেল গ্রামি নিজেই তা অভিজ্ঞতা করেছেন৷ টেলিফোনে তাঁকে প্রায়ই হত্যার গুমকি দেওয়া হয়েছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় চলেছে তাঁকে নিয়ে কুৎসা রটনা৷ গ্রামি ইসলামের আধুনিক ব্যাখ্যা করেন, তিনি একটি উদারপন্থি সমাজব্যবস্থার সপক্ষে৷ ‘‘দাড়িওয়ালাদের তা-তেই আপত্তি৷ তারা আমাকে জিওনিস্ট বলে, খ্রিষ্টান মিশনারী বলে৷'' ইতিমধ্যে তিনি শহরের অনেক এলাকা বর্জন করে চলেন, কেননা তিনি সেখানে নিজেকে নিরাপদ বলে মনে করেন না৷
বেন আলির পতনের পর থেকেই সালাফিরা প্রকাশ্যে বেরতে শুরু করছে, বলে সোফিয়ানে মনে করেন৷ বিভিন্ন গোষ্ঠী মিলিয়ে এখন হয়তো তারা দশ কি বিশ হাজার৷ তাদের মধ্যে সবাই-এর মনোভাব হিংসাত্মক না হলেও, আল-কায়েদা ঘেঁষা কিছু উপাদান আছে, বলেন সোফিয়ানে৷ ‘‘এদের সবার পন্থা হল, অন্য সবাইকে নাস্তিক, অবিশ্বাসী বলে কুৎসা রটানো৷''
সহিংস, সশস্ত্র গোষ্ঠী
‘‘বিপ্লব সুরক্ষা লিগ'' নাম দিয়ে বিপ্লবের সময় নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য এই সব গোষ্ঠী সৃষ্টি হয়েছিল৷ শাসকদল এন্নাহদা এদের উপর নির্ভর করে থাকে৷ ইসলামপন্থি এন্নাহদা তিউনিশিয়ার বহু শহরে ও গ্রামে সশস্ত্র গোষ্ঠী গড়ে তুলেছে ঠিক সেই ধরনের তরুণ-যুবাদের নিয়ে, যাদের জন্য অর্থোপার্জনের, জীবনধারণের, সবচেয়ে বড় কথা, সমাজে মর্যাদা পাবার আর কোনো পথ খোলা ছিল না৷ গোষ্ঠী তাদের দিয়েছে অর্থ, মর্যাদা এবং সংগ্রামের লক্ষ্য৷ এই সব সশস্ত্র গোষ্ঠীকে ইতিমধ্যে বেসরকারিভাবে নথিভুক্তও করা হচ্ছে, যদিও তাদের পন্থা সর্বক্ষেত্রে আইনসম্মত নয়৷ বিগত কয়েক মাসে সারা দেশে বিভিন্ন অস্ত্রভাণ্ডার আবিষ্কৃত হয়েছে৷
ফলে তিউনিশিয়া এখন একটি বারুদের স্তূপ হয়ে আছে৷ এই ঠান্ডা গৃহযুদ্ধ যে কোনো সময় একটি প্রকৃত গৃহযুদ্ধের রূপ ধারণ করতে পারে বলে আমেল গ্রামির ধারণা৷