1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

তাদের হৃদয়-ছোঁয়া সেই কান্না

Samir Kumar Dey
সমীর কুমার দে
২৯ ডিসেম্বর ২০২৩

সেদিন ছিল মঙ্গলবার। এপ্রিলের ৪ তারিখ। সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি, এমন সময় খবর এলো- বঙ্গবাজারে আগুন লেগেছে৷

https://p.dw.com/p/4ai3g
বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের দৃশ্য
গত এপ্রিলে বঙ্গবাজারে আগুনে আগুনে পুড়ে যায় বহু দোকানছবি: Piyas Biswas/ZUMA/IMAGO

প্রথমে খুব একটা গুরুত্ব না দিলেও কিছুক্ষণের মধ্যে জানতে পারি আগুনের ভয়াবহতা। ফোনেই খোঁজ-খবর নেওয়া শুরু করলাম। পাশাপাশি তৈরি হলাম বের হওয়ার জন্য। এর মধ্যে ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগের প্রধান খালেদ ভাই জানালেন, আগুনের ঘটনা নিয়ে একটা লাইভ করতে হবে। যানজট মাড়িয়ে কোনোভাবে পৌঁছালাম বঙ্গবাজারের পাশে। ততক্ষণে উৎসুক মানুষ, ফায়ার সার্ভিস আর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর শত শত সদস্য আগুন নেভানোর কাজে ব্যস্ত। আগুন থেকে অল্প দূরেই জটলা পাকিয়ে বসে আছেন অনেকে। কেউ কেউ আবার মালামাল সরিয়ে নেওয়ার কাজে ব্যস্ত।

ঘটনাস্থলে গিয়ে লাইভ করার আগে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলাম। ভাবলাম একজন ব্যবসায়ির সঙ্গে কথা বলে তাদের ক্ষয়ক্ষতির হিসাবটা বুঝি। একটি জটলার কাছে পৌঁছাতেই কানে ভেসে এলো একজন মধ্যবয়সি মানুষের কান্নার আওয়াজ। কাছে গিয়ে কথা বলতেই তিনি জানালেন নাম মিজানুর রহমান। তার আরাফাত শাড়ি হাউস নামে বঙ্গবাজারে একটি দোকান ও একটি গোডাউন এবং অ্যানেক্সো টাওয়ারে একটি কাপড়ের দোকান ছিল। তিনি একটি দোকানের মালও রক্ষা করতে পারেননি। বললেন, ‘‘আমার সব শেষ। দুই কোটি টাকার ওপরে মাল ছিল। দুই ব্যাংক ও আত্মীয়-স্বজনের কাছে এক কোটি টাকার ওপর ঋণ আছে। গতকাল আমি মাল কিনতে গেছিলাম গাউছিয়ায়। সেখানে আমার ছোট ভাইয়ের বাড়ি। সেখানেই ছিলাম রাতে। সকাল সাড়ে সাতটার দিকে শুনি মার্কেটে আগুন লাগছে। সেখান থেকে এসে দেখি পুড়ে সব শেষ।”

তার কান্না কোনোভাবেই থামছিল না। কান্নার ফাঁকে অল্প অল্প করে কথা বলছিলেন তিনি। বললেন, "অ্যানেক্সো টাওয়ারের যে পাশে আগুন লেগেছে, সে পাশেই আমার দোকান। তাই অ্যানেক্সো টাওয়ারের মালও নামাতে পারি নাই। ঈদ উপলক্ষে মাল আনছি। আবার শীতের শাল দেড় মাস হলো গোডাউন করছিলাম। কিছু নাই, সব শেষ। সব শেষ হয়ে গেছে।” এরপর আরও কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হয়েছে। তাদের সবাইকে দেখেছি, সবকিছু হারিয়ে বুকফাঁটা আত্মনাদ করতে। এখন চোখ বন্ধ করলে তাদের হৃদয় ছোঁয়া সেই কান্না আজও কানে ভেসে আসে।

এই ঘটনার ১০ দিন যেতে না যেতেই ১৫ এপ্রিল আগুন লাগে নিউমার্কেটের পাশে নিউ সুপার মার্কেটে। সেখানেও আগুনে নিঃস্ব হয়েছেন শত শত ব্যবসায়ী। সেখানেও দেখেছি, আগুনে মালামাল পুড়ে যাওয়া ব্যবসায়িদের কান্না। তিল তিল করে গড়ে তোলা দোকান যখন চোখের সামনেই আগুনে পুড়ে যায়, তখন একজন ব্যবসায়ীর তীব্র সেই কষ্ট কাছ থেকে দেখেছি। তাদের সেই আত্মনাদ, চোখে ভাসে। কোনো কিছুতেই তাদের শান্ত করতে পারিনি। দু'টি আগুনের ঘটনাই ঈদের আগে। ঈদের আগে কেন মার্কেটে আগুন লাগে তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন।

অনেকদিন ধরেই বঙ্গবাজার ভেঙে বহুতল ভবন নির্মাণের কথা আলোচনা হচ্ছিল। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও সফল হয়নি সিটি কর্পোরেশন। বঙ্গবাজারে এর আগেও অনেকবার আগুন লেগেছে। কিন্তু ফায়ার সার্ভিসের সদর দপ্তরের সামনেই এবার যেভাবে পুড়েছে বঙ্গবাজার তাতে নানা ধরনের সন্দেহ তৈরি হওয়াই স্বাভাবিক। পুরো বঙ্গবাজার পুড়ে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। এখন সেখানে অস্থায়ী ভিত্তিতে বাঁশ-কাঠের মাচা তৈরি করে ব্যবসা করছেন ব্যবসায়িরা। কিন্তু আগের বঙ্গবাজারের সেই জৌলুস আর নেই। নতুন করে আবার কথা হচ্ছে, শিগগিরই বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করবে সিটি কর্পোরেশন। ঠিক একইভাবে ১৪ সেপ্টেম্বর আগুন লাগে মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেটে। এটিও সিটি কর্পোরেশনের অধিনে চলা একটি মার্কেট।

কৃষি মার্কেটটি অত্যন্ত সুরক্ষিত একটি মার্কেট। রাতে এই মার্কেটের বিদ্যুতের প্রধান সুইচ বন্ধ থাকে। ফলে ইলেকট্রিক শক সার্কিট থেকে আগুন লাগার সুযোগ কম। তারপরও রাতের আঁধারে আগুন লাগলো কৃষি মার্কেটে। পুড়ে গেল দেড়শ' ব্যবসায়ীর স্বপ্ন। সম্প্রতি মোহাম্মদপুরে কৃষি মার্কেটে গিয়ে দেখা গেল, যে দেড়শ'টির মতো দোকান পুড়েছিল, সেখানে বসানো হয়েছে তিনশ'রও বেশি দোকান। কোনো ধরনের নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে স্থানীয় কমিশনার দোকানগুলো বসিয়ে ভাড়া উঠাচ্ছেন। ফলে এখন আগুন লাগার কারণ নিয়ে মানুষের সন্দেহ আরও তীব্র হয়েছে। কিন্তু প্রতিকারের কোনো পথ খোলা নেই। কার কাছে বিচার চাইবেন?

ঢাকা শহরে বস্তি থেকে শুরু করে মার্কেট, যেখানেই আগুন লাগুক কিছু মানুষের বাণিজ্য হয়। আর নিঃস্ব হয় কিছু মানুষ। বস্তিতে আগুন লাগলে স্থানীয় নেতারা আবার নতুন নতুন ঘর তুলে ভাড়া দেওয়ার সুযোগ পান। মার্কেট পুড়লেও এক ব্যবসায়ীর জায়গায় বসানো হয় তিনজনকে। প্রতিটি ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস তদন্ত করে। তারা হয় শক সার্কিট বা মশার কয়েল থেকে আগুনের সূত্রের কথা বলেন। কোনো ঘটনায় সন্দেহ থাকলে অধিকতর তদন্তের কথা তারা বলেন। তাদের সেই রিপোর্ট স্বারাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমাও হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কোনো একটি ঘটনারও অধিকতর তদন্তের জন্য কমিটি গঠন করা হয়নি। ফলে দুর্ঘটনা ছাড়া যদি কখনও উদ্দেশ্যমূলকভাবে আগুন দেওয়া হয় তার জন্য যিনি বা যারা দায়ি তারা সবসময় থেকে গেছেন আড়াইলেই। কখনও তাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়নি সরকারের তরফ থেকে।

চলতি বছরের আরেকটি ঘটনার কথা মনে পড়ে। ২৮ অক্টোবর ছিল নয়াপল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশ। এর আগেও দু'বার বিএনপি এখানে সমাবেশ করেছে, সেগুলো কাভার করেছি। কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। ২৮ অক্টোবর সমাবেশ শুরু হওয়ার কথা বেলা ২টায়। কিন্তু আমরা সবসময় লাইভ করেছি এক ঘণ্টা আগে। একইভাবে বেলা ১টার দিকে নাইটএঙ্গেল মোড় থেকে লাইভ করে প্রেসক্লাবের দিকে ফিরে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছি, এমন সময় খবর এল কাকরাইল মসজিদের সামনে গোলমাল হচ্ছে। সেদিকে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। কিছুদূর যেতেই দেখলাম সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেছে। বিএনপি নেতা-কর্মীরা পুলিশের উদ্দেশ্যে ইট-পাটকেল ছুঁড়ছে, আর পুলিশ রাবার বুলেট আর টিয়ারশেল নিক্ষেপ করছে সমানে। মাঝে মধ্যে সাউন্ড গ্রেনেড। সাউন্ড গ্রেনেডের সে কী বিকট শব্দ। এর মধ্যেই কয়েকজন সহকর্মীকে দেখলাম রক্তাক্ত অবস্থায় ধরাধরি করে অন্য সহকর্মীরা হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন। তাদের কয়েকজন জানালেন, বিএনপির কর্মী আর পুলিশ দুই পক্ষই সাংবাদিকদের পেটাচ্ছে। এর আগে কখনও দুইপক্ষের আক্রমনের শিকার হননি সাংবাদিকরা। এবারের ঘটনাটি ব্যতিক্রম। বিএনপি কর্মীদের পেটানোর দৃশ্যের ছবি তোলা বা ভিডিও করার কারণে না হয় পুলিশ পেটালো বুঝলাম। কিন্তু বিএনপি কেন সাংবাদিকদের পেটালো, সেই রহস্য আজও অজানা। বিএনপির কোন নেতা আজও বলেননি কেন তারা সাংবাদিকদের পিটিয়েছেন। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী শত শত বিএনপি নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করলেও সাংবাদিক পেটানোর দায়ে কাউকে ধরেনি। এভাবেই সব পক্ষের মার খেয়ে কাজ করে যাচ্ছেন বাংলাদেশের সাংবাদিকরা।

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য