তবু অনন্ত জাগো-১
২৯ নভেম্বর ২০১১এ যেন নির্লিপ্ত এক তপস্বীর উপলব্ধি, যিনি দুঃখে সুখে আকীর্ণ পৃথিবীর মধ্যে থেকেও তার ঊর্ধে অবারিত যে মুক্তির অসীম আকাশ, তার মধ্যে আপন চিত্তকে পরিব্যাপ্ত করে দিয়েছেন৷
‘‘দীর্ঘ জীবনপথ, কত দুঃখতাপ, কত শোকদহন,'' কোন কিছুই তাঁকে বিচলিত করতে পারেনি৷ বলেছেন, ‘‘মৃত্যু তাঁর জীবনকে কত সঞ্চয় দিয়ে গেছে''– তাঁর পত্নীর অকালমৃত্যু, পুত্র-কন্যা-দৌহিত্রের অকালমৃত্যুসহ আরো কতো মৃত্যু – ভেঙে পড়েননি কখনো, স্থিতধী থেকেছেন সর্বদা সর্ব অবস্থায়৷
চৌদ্দ বছর বয়সে প্রথম মৃত্যুশোক, মায়ের মৃত্যুতে৷ ‘‘কী হইয়াছে ভালো করিয়া বুঝিতেই পারিলাম না৷ প্রভাতে উঠিয়া যখন মা'র মৃত্যুসংবাদ শুনিলাম তখনো সে কথাটার অর্থ সম্পূর্ণ গ্রহণ করিতে পারিলাম না৷ ... কেবল যখন তাঁর দেহ বহন করিয়া বাড়ির সদর দরজার বাহিরে লইয়া গেল... তখনই শোকের সমস্ত ঝড় যেন একেবারে এক দমকায় আসিয়া মনের ভিতরটাতে হাহাকার তুলিয়া দিল৷''
বালক রবীন্দ্রনাথ মানসিক আশ্রয় পেলেন দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আর নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবীর কাছে৷ কাদম্বরী দেবী হয়ে ওঠেন তাঁর সৃষ্টিকর্মের সবচেয়ে বড়ো অনুপ্রেরণার উৎস৷ তাঁর দীর্ঘজীবনের সবচেয়ে সুখের সময় কেটেছে এঁদের আশ্রয়েই৷ অপর্যাপ্ত স্নেহে-ভালবাসায় ভরা স্বপ্নের এই দিনগুলি রবীন্দ্রনাথ ভুলে যাননি কখনও৷ এঁদেরই বাড়িতে একদিন এক আকস্মিক অভিজ্ঞতা হলো তাঁর৷ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন 'আধ্যাত্মিক' অভিজ্ঞতা৷ সেই অভিজ্ঞতার অভিঘাতে রচিত হলো আশ্চর্য কবিতা 'নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ'৷
সম্পূর্ণ নতুন এক প্রাণসত্তা নিয়ে জেগে উঠলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক কবি, বিশ্বকবি, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর৷
রবীন্দ্রনাথের লেখার উৎস খুলে গেলো পুরোপুরি৷ মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে রচিত হলো তেরোটি গ্রন্থ৷ এর মধ্যে তিনটি গ্রন্থ জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে এবং চারটি কাদম্বরী দেবীকে উৎসর্গিত৷ ‘ভগ্ন হৃদয়' গ্রন্থের উৎসর্গপত্রে রবীন্দ্রনাথ কাদম্বরীর উদ্দেশ্যে লিখলেন, ‘‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা''...
রবীন্দ্রনাথের জীবনে তখন সোনালি রঙের সৃষ্টিমুখর উচ্ছল দিন৷ কৌতুকপ্রিয়, সংগীতপ্রিয়, বন্ধুবৎসল রবীন্দ্রনাথের যেন মনে হচ্ছিলো ‘‘এমনি করেই যায় যদি দিন যাক না৷''
১৮৮৩-তে বাইশ বছর বয়সে বিয়ে হলো রবীন্দ্রনাথের৷ প্রচলিত প্রথা লঙ্ঘন করে বিয়ে হলো বরের বাড়িতেই৷ বিয়ের রাত্রে শিলাইদহে বড়ো ভগ্নিপতি সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়ের আকস্মিক মৃত্যুর খবর এসে পৌঁছালো বাসি বিয়ের দিন – উৎসব অকস্মাৎ শোকে স্তব্ধ হয়ে গেলো৷
রবীন্দ্রনাথের বিয়ের কয়েক মাস পরে, ১৮৮৪ সালের ১৯ শে এপ্রিল বৌঠান কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করলেন৷ মৃত্যুর বিষাদময় ভয়ংকর রূপের সঙ্গে সত্যিকার নিষ্ঠুর পরিচয় ঘটলো রবীন্দ্রনাথের৷
শোকাহত রবীন্দ্রনাথ তিনটি বই মৃতা বৌঠানকে উৎসর্গ করলেন৷ ‘শৈশব সংগীত'-এর উৎসর্গপত্রে তিনি লিখলেন, ‘‘এ কবিতাগুলিও তোমাকে দিলাম৷ বহুকাল হইল তোমার কাছে বসিয়াই লিখিতাম, তোমাকেই শুনাইতাম৷ সেই সমস্ত স্নেহের স্মৃতি ইহাদের মধ্যে বিরাজ করিতেছে৷ তাই মনে হইতেছে, তুমি যেখানেই থাক না কেন এ লেখাগুলি তোমার চোখে পড়িবেই৷''
সমস্ত জীবনভর তিনি গদ্যে পদ্যে চিঠিতে এই মৃত্যু এবং এই মানুষটির কথা শ্রদ্ধা ও অনুরাগে স্মরণ করেছেন৷ ‘‘আমার তেইশ বছর বয়সের সময় মৃত্যুর সঙ্গে যে পরিচয় হইল তাহা স্থায়ী পরিচয়৷ তাহা তাহার পরবর্তী প্রত্যেক বিচ্ছেদশোকের সঙ্গে মিলিয়া অশ্রুর মালা দীর্ঘ করিয়া গাঁথিয়া চলিয়াছে৷ জীবনের মধ্যে কোথাও যে কিছুমাত্র ফাঁক আছে৷ তাহা তখন জানিতাম না৷... জীবনের এই রন্ধ্রটির ভিতর দিয়া যে একটা অতলস্পর্শ অন্ধকার প্রকাশিত হইয়া পড়িল, তাহাই আমাকে দিনরাত্রি আকর্ষণ করিতে লাগিল৷ আমি ঘুরিয়া ফিরিয়া কেবল সেইখানে আসিয়া দাঁড়াই, সেই অন্ধকারের দিকেই তাকাই এবং খুঁজিতে থাকি–যাহা গেল তাহার পরিবর্তে কী আছে৷''
পরিবর্তে রবীন্দ্রনাথ খুঁজে পেলেন কাজ আর কাজ ৷ শুধু কবিতা, গান বা নাটক লেখা নয়, নতুন কর্মযজ্ঞে নিজেকে উৎসর্গ করলেন তিনি৷ জমিদারির দায়িত্বগ্রহণ, পত্রিকা সম্পাদনা, নানা ধরনের সামাজিক দায়িত্ব গ্রহণ করাসহ অজস্রমুখী কাজের সঙ্গে তিনি যুক্ত হলেন৷ শুরু হলো রবীন্দ্রনাথের জীবনের নবতর অধ্যায়৷ শোককে তিনি পরিণত করলেন সৃষ্টিতে বিভিন্নমুখী নির্মাণ কর্মে৷ শোকের মধ্যে তিনি খুঁজে পেলেন বহুধা বিকশিত প্রাণশক্তি৷
কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর পর রবিপ্রতিভা আরো ভাস্বর হয়ে উঠলো৷ পাশাপাশি মৃত্যুও প্রসারিত করে দিলো তার গাঢ় কালো ছায়া৷ ১৮৯৯-এ অতি প্রিয় ভাইপো বলেন্দ্রনাথের মৃত্যু ঘটলো অকস্মাৎ, মাত্র ঊনত্রিশ বছরে বয়সে৷ এই প্রতিভাবান যুবক স্বল্প বয়সসীমার মধ্যেই বাংলা গদ্য রচনায় সৃষ্টিশীলতার পরিচয় দেন৷ বলেন্দ্রনাথের বিয়েতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'নদী' কাব্য উৎসর্গ করেছিলেন৷
প্রতিবেদন: ফরহাদ খান
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক