1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হলে হলে শিক্ষার্থীদের মারধরের অভিযোগ

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
১৬ জুলাই ২০২৪

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলে গতকাল রাত ১০টার পর থেকে শিক্ষার্থীদের মুঠোফোন তল্লাশি ও মারধরের অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে।

https://p.dw.com/p/4iJZm
হামলার একটি মুহূর্ত
কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উপর হামলা হামলা হয়েছেছবি: Mamunur Rashid/NurPhoto/picture alliance

গতকাল দুপুরে বিক্ষোভের পর বিকেল থেকে ছাত্রলীগের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। হামলা ও সংঘর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি সংগঠনটির ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন শাখার নেতা-কর্মীরা অংশ নেন। তাঁদের হাতে ছিল হকিস্টিক, লাঠি, রড, জিআই পাইপসহ বিভিন্ন দেশি অস্ত্র। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে পিস্তল দিয়ে গুলি ছুড়তে দেখা যায় অন্তত পাঁচজন অস্ত্রধারীকে।

শিক্ষার্থীরা বলছেন, রাতে হলে ফেরার পর ছাত্রলীগ তাদের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছে। শিক্ষার্থীরা কোটা আন্দোলনে যুক্ত কি না, তা দেখতে শিক্ষার্থীদের মুঠোফোন তল্লাশি করা হয়েছে। আন্দোলনে যুক্ততা পেলেই মারধর করা হয়েছে।

‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ এই হামলার জন্য ছাত্রলীগকে দায়ী করেছেন৷ হামলায় আহতদের মধ্যে বেশ কয়েকজন নারী শিক্ষার্থীও আছেন৷

ঢাবিতে শিক্ষার্থীদের উপর হামলার প্রতিবাদে কোটাবিরোধীরা তাৎক্ষণিকভাবে সারাদেশে সড়ক এবং রেলপথ অবরোধের ডাক দিয়েছেন৷ আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘‘সারাদেশে শিক্ষার্থীরা যে যেভাবে পারবেন সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করবেন৷’’

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত দাবি করেছেন, ‘‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি হলে কোটাবিরোধীরা হামলা করলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিরোধ করেছে৷ হামলার পর ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা অবস্থান করছেন৷ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আহতদের কমপক্ষে ১০০ জনকে ভর্তি করা হয়েছে৷’’

আরেকজন সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম অভিযোগ করেন, ‘‘হামলায় আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর সেখানে ঠিকমতো চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে না৷ তাদের ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানোর চেষ্টা করছি৷’’ 

তিনি বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদে আমরা দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ ডাকি৷ একই জায়গায় ছাত্রলীগ বেলা তিনটায় সমাবেশ ডাকে৷ আমরা দুপুর দুইটার মধ্যে সমাবেশ শেষ করে মিছিল নিয়ে রেজিষ্ট্রার বিল্ডিংয়ের দিকে যাই৷ সেখানে গিয়ে আমরা জানতে পারি বিজয় একাত্তর হলে আমাদের কিছু ছাত্রকে আটকে রাখ হয়েছে৷ তখন মূল মিছিল থেকে কিছু আন্দোলনকারী তাদের উদ্ধার করতে গেলে হলের ভিতর থেকে তাদের ওপর প্রথমে হামলা শুরু হয়৷ মোহসীন হল থেকেও হামলা হয়৷’’ 

তিনি আরো বলেন, ‘‘এরপর আমরা মেয়েদের নিরাপত্তার জন্য মিছিল ঘুরিয়ে বের হয়ে যেতে চাইলে মধুর ক্যান্টিনের দিক থেকে হামলা চালানো হয়৷ মেয়েরা তখন মিছিলের সামনে ছিল৷ মেয়েদের ওপরই প্রথম হামলা হয়৷ তারা প্রথমে ইটপাটকেল ছোঁড়ে৷ তারপর চারদিকে থেকে লাঠিসোঁটা, রড, হকিস্টিক নিয়ে হামলা করে৷’’ 

আহতদের উদ্ধার করতে গেলে তাদের ওপর হামলা শুরু হয়’

তানভীর হাসান সৈকত অবশ্য দাবি করেন, ‘‘কোটাবিরোধীদের মিছিল থেকে ছাত্রদল ও শিবিরের চিহ্নিত ক্যাডাররা বিজয় একাত্তর, স্যার এ এফ রহমান ও জসীম উদ্দীন হলে হামলা চালালে সাধারণ ছাত্ররা তাদের প্রতিরোধ করে৷ ছাত্রলীগ কোনো হামলা চালায়নি৷ তাদের হামলায় আমাদের ২৫ জন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন৷’’

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন
সরকারি চাকরিতে কোটার যৌক্তিক পুনর্বিন্যাসের দাবিতে কোটা আন্দোলনকারীরা ১ জুলাই থেকে আন্দোলন শুরু করেন৷ ৬ জুলাই থেকে তারা ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচিতে যান৷ বিষয়টি এখন আদালতে আপিল পর্যায়ে আছে৷ হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে সব ধরনের কোটা থাকবে৷ কিন্তু সরকার চাইলে এর অনুপাতে পরিবর্তন আনতে পারবে৷ সরকার বলছে, এটার সমাধান আদালতের মাধ্যমেই হতে হবে৷ আর কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বলছেন, এর সমাধান সরকারকেই করতে হবে৷ রোববার তারা তাদের দাবির স্মারক লিপি রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে দাবি মেনে নেয়ার জন্য ২৪ ঘণ্টা সময় দেন৷ তারা সর্বোচ্চ পাঁচ শতাংশ কোটা রেখে সরকারকে সংসদের জরুরি অধিবেশন ডেকে আইন পাশ করতে বলেন৷ ঢাবিতে কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা, প্রতিবাদে অবরোধের ডাকতারা মুক্তিযোদ্ধা কোটা, নারী কোটা, জেলা কোটা বাতিল করে শুধু পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী ও বিশেষ চাহিদা সম্পন্নদের (প্রতিবন্ধী) কোটা রাখার কথা বলেন৷

এদিকে রোববারই প্রধানমন্ত্রী গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরাও পাবে না? তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা পাবে? আমার প্রশ্ন দেশবাসীর কাছে৷ তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে, মুক্তিযোদ্ধারা পাবে না? অপরাধটা কী? নিজের জীবন বাজি রেখে, সংসার সব ফেলে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে৷ দিনরাত খেয়ে না খেয়ে, কাদামাটি ভেঙে, রোদ-বৃষ্টি-ঝড় মোকাবিলা করে যুদ্ধ করে এ দেশের বিজয় এনেছে৷ বিজয় এনে দিয়েছিল বলে সবাই উচ্চপদে আসীন৷’’

‘কোটাবিরোধীরা হামলা করলে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিরোধ করে’

কোটা আন্দোলনকারীরা প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের প্রতিবাদে রোববার মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ছেড়ে রাজু ভাস্কর্য এলাকায় সমবেত হয়ে প্রতিবাদ জানায়৷ তারা ‘‘তুমি কে আমি কে - রাজাকার, রাজাকার’’, ‘‘চাইতে গেলাম অধিকার- হয়ে গেলাম রাজাকার’’ এবং ‘‘কোটা নয় মেধা- মেধা মেধা’’ সহ বিভিন্ন শ্লোগান দেয়৷ তারা দাবি করেন, প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে কোটা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ‘‘রাজাকার’’ বলেছেন৷

তারা মধ্যরাতের প্রতিবাদ থেকে সোমবার রাজু ভাস্কর্য এলাকায় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহারে প্রতিবাদ সমাবেশ ডাকেন৷ এই সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও আশেপাশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন৷ অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীকে কটুক্তি এবং ‘‘আমি কে, তুমি কে, রাজাকার রাজাকার’’ এই শ্লোগানের প্রতিবাদে ছাত্রলীগ বিকাল ৩টায় একই স্থানে অবস্থান কর্মসূচি দেয়৷ 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত বলেন, ‘‘কোটাবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে আমাদের বিরোধ নেই৷ আমরা কোটার যৌক্তিক পুনর্বিন্যাস চাই৷ কিন্তু এই আন্দোলনের নামে স্বাধীনতার চেতন- বিরোধী কোনো বক্তব্য বা প্রচার আমরা করতে দেবো না৷ তারা নিজেরা রাজাকার বলে গর্ববোধ করতে পারে, কিন্তু এই বাংলাায় রাজাকারের ঠাঁই হবে না৷ তাদের ওপর শিবির ও ছাত্রদল ভর করেছে৷’’

কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘‘সংবাদ মাধমে আমাদের স্লোগানকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে৷ ছাত্ররা বলেছে, আমি কে তুমি কে? রাজাকার, রাজাকার৷ কে বলেছে কে বলেছে সরকার, সরকার৷ পরের অংশটি সংবাদমাধ্যম প্রচার করেনি৷  আর এটা ছিল ক্ষোভে আন্দোলনকারীদের ব্যঙ্গাত্মক স্লোগান৷’’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের জরুরি বৈঠক 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মল চত্বর এলাকার সংঘর্ষের পর শহীদুল্লাহ হল, অমর একুশে হল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এমার্জেন্সি গেট এলাকায় সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে৷ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগ এলাকায় যেতে চাইছে৷ সেখানে আহত কোটা বিরোধীদের সঙ্গে তাদের সহপাঠীরা আছেন৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে৷ কোটা আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, বিকেলের পর ছাত্রলীগ হলে হলে তল্লাশি চালাচ্ছে৷ অনেক শিক্ষার্থীই হলে ফিরতে পারছেন না৷  ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ঢুকে আহত শিক্ষার্থীদের ওপর একাধিকবার ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলা চালিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন কোটা আন্দোলনকারীরা।

সারাদিনের এসব হামলা সংঘাতের পর সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জরুরি বৈঠকে বসে পাঁচটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ সিদ্ধান্তগুলো হলো: 
(১) শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ হলে শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করবেন৷
(২) প্রভোস্ট ও আবাসিক শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তায় সার্বক্ষণিকভাবে হলে অবস্থান করবেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন৷
(৩) হলগুলোতে কোনো বহিরাগত অবস্থান করতে পারবে না৷
(৪) যেকোনো ধরনের গুজব ও অপপ্রচার থেকে বিরত থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে আহ্বান জানানো হয়েছে৷
(৫) সবাইকে নাশকতামূলক কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য বলা হয়েছে৷ কেউ নাশতকতামূলক কাজে জড়িত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে৷

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও দেশের আরো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার ঘটনা ঘটেছে৷ এই প্রতিবেদন লেখা অবধি পরিস্থিতি থমথমে রয়েছে৷