ড্রেসডেন শহরের ধ্বংস ও পুনর্জন্ম
৭৩ বছর আগে মিত্রশক্তির বোমাবর্ষণে জার্মানির ড্রেসডেন শহর প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়৷ সেই বোমার রাত্রিতে প্রাণ হারান মোট ২৫,০০০ মানুষ৷ কিন্তু কিংবদন্তির ফিনিক্স পাখির মতো ভস্ম থেকে আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে ড্রেসডেন৷
ধ্বংসলীলা
১৯৪৫ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারি তারিখে ২৪৫টি ল্যাঙ্কাস্টার বোমারু বিমান ইংল্যান্ড থেকে ড্রেসডেন অভিমুখে যাত্রা করে৷ রাত ন’টা বেজে উনচল্লিশ মিনিটে সারা শহরে সাইরেন বেজে ওঠে৷ মাত্র ২৩ মিনিটের বোমাবাজিতে শহরটা আগুনের গালিচায় পরিণত হয়, ধ্বংস হয় ড্রেসডেনের প্রখ্যাত নগরকেন্দ্র৷ ব্রিটিশ বোমারু বিমানের দু’বারের হানা ও মার্কিন বোমারু বিমানের একটি হানায় শহরের মোট ১৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা বিধ্বস্ত হয়৷
গির্জা ক্ষতিগ্রস্ত
সাধারণ কোনো গির্জা নয়, হোফকির্শে বা রাজকীয় গির্জা, যা কিনা স্যাক্সনি রাজ্যের বৃহত্তম গির্জাগুলির অন্যতম৷ ড্রেসডেনের সুবিখ্যাত ফ্রাউয়েনকির্শে বা চার্চ অফ আওয়ার লেডি নামের লুথেরান গির্জাটি এর মাত্র ৩০০ মিটার দূরে৷ ১৩ই ফেব্রুয়ারির বোমাবর্ষণে হোফকির্শের ছাদ ও খিলানগুলি ভেঙে পড়ে৷ ভাঙা ইটপাথর সরানোর কাজে প্রথমে হাত লাগান তথাকথিত ট্রুমারফ্রাউয়েন বা ধ্বংসস্তূপের মহিলারা৷
মার্টিন লুথারও রেহাই পাননি
প্রটেস্টান্ট গির্জার প্রতিষ্ঠাতা মার্টিন লুথারের স্মৃতিসৌধটি ফ্রাউয়েনকির্শের ঠিক সামনে – বোমাবাজিতে সেটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ ভাস্কর আডল্ফ ফন ডনডর্ফের ১৮৬১ সালে সৃষ্ট লুথারের মূর্তি মাটিতে লুটায়৷ লুথার ১৫১৬ থেকে ১৫১৭ সালের মধ্যে ড্রেসডেনে এসেছিলেন৷
অর্থহীন ধ্বংস
ড্রেসডেনের ব্যারোক শৈলীর চার্চ অফ আওয়ার লেডি বা ফ্রাউয়েনকির্শে তৈরি হয় ১৭২৬ থেকে ১৭৪৩ সালের মধ্যে৷ ১৯৪৫-এর বোমা হামলার রাত্রে ধ্বংস হওয়ার পর গির্জাটিকে ১৯৯৩ সাল অবধি ঐ ভগ্ন অবস্থাতেই রেখে দেওয়া হয়৷ তারপর ধীরে ধীরে গির্জাটিকে আবার গড়ে তোলা হয়৷ গির্জার ওপরের ক্রুশটি তৈরি করেন এক ব্রিটিশ কর্মকার, যার পিতা বোমারু বিমানের চালক হিসেবে ড্রেসডেনের উপর বোমাবর্ষণে সংশ্লিষ্ট ছিলেন৷
আবার জন্ম নিল ফ্রাউয়েনকির্শে
১৯৯৪ থেকে ২০০৫ সাল অবধি কাজ চলে৷ অনুদান আসে সারা বিশ্ব থেকে৷ পুনর্নির্মাণের কাজে ব্যয় হয় প্রায় ১৩ কোটি ইউরো৷ গির্জার চূড়াটির উচ্চতা ৯১ মিটার, চার পাশে ড্রেসডেনের ব্যারোক শৈলীর ঘরবাড়ি৷ স্যাক্সনির রাজধানী ড্রেসডেনে এলে পর্যটকদের প্রথম দ্রষ্টব্য হলো এই চার্চ অফ আওয়ার লেডি৷
হোফকির্শেই বা কম যায় কিসে?
ফ্রাউয়েনকির্শে থেকে শ্লসপ্লাৎস পার হলেই ক্যাথলিক হোফকির্শে বা রয়্যাল চ্যাপেল৷ গির্জাটি তৈরি হয় ১৭৩৯ থেকে ১৭৫৪ সালের মধ্যে, কেননা, নৃপতি আউগুস্ট পোল্যান্ডেরও রাজা হবার জন্য ধর্ম বদলে ক্যাথলিক হয়ে যান৷
লুথার আবার নিজের জায়গায় ফিরলেন
ড্রেসডেনের বোমার রাত্রির ঠিক দশ বছর পরে, ১৯৫৫ সালে লুথারের মূর্তিটিকে আবার স্বস্থানে প্রতিষ্ঠা করা হয়৷ তারপরেও প্রায় ৫০ বছর ধরে, অর্থাৎ ২০০৩ থেকে ২০০৪ সাল অবধি, লুথারের পিছনে থাকে ফ্রাউয়েনকির্শের ধ্বংসাবশেষ৷ আজ অবশ্য লুথারের স্ট্যাচুর নীচে টুরিস্ট আর তরুণ-তরুণীরা পরস্পরের সঙ্গে দেখা করেন – সিঁড়িগুলোয় ভালো বসবার জায়গা আছে কিনা৷
এলবে নদীর ফ্লোরেন্স
ড্রেসডেনকে বলা হয় এলবে নদীর ফ্লোরেন্স৷কারণ, তার ব্যারোক স্থাপত্য৷ রাতের আলোঝলমল ড্রেসডেনকে দেখলে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না৷
ভাঙাগড়ার খেলা
অতীতের সেই দুঃস্বপ্নকে কিন্তু ভুলে যায়নি ড্রেসডেন৷ তাই পুরনো একটি গ্যাসের আধারে ১৯৪৫-এর সেই বিভীষিকাকে সার্কারামা হিসেবে ধরে রাখা হয়েছে৷ শিল্পী ইয়াদেগর আজিজি তাঁর এই সুবিশাল শিল্পকর্মটিতে ড্রেসডেনকে দেখিয়েছেন, শহরটি বোমাবাজির পর ঠিক যে অবস্থায় ছিল: ধ্বংস, ধোঁয়া আর অগ্নিশিখার এক দুঃস্বপ্নের নগরী৷