টেলিটক দিয়ে গ্রামীণফোনের ‘মনোপলি' ভাঙতে চায় সরকার
২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০প্রায় এক বছর ধরে চলা সংকটের নিরসন হতে চলেছে৷ আদালতের নির্দেশনা মেনে রবিবার এক হাজার কোটি টাকা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিতে জমা দিচ্ছে গ্রামীণফোন৷ শুক্রবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে অপারেটরটি এই তথ্য জানিয়েছে৷ টাকা জমা দেওয়ার পর সোমবার আদালত পরবর্তী নির্দেশনা দেয়ার কথা রয়েছে৷
তবে এই এক বছরে গ্রামীণফোনের সেবার মান কমেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে৷ এর কারণ হিসেবে তারা বলছে, ‘‘এনওসি (নো অবজেকশন সার্টিফিকেট) বন্ধের কারণে এতদিন প্রতিষ্ঠানটি কোন যন্ত্রপাতি আমদানি করতে পারেনি৷ এখন নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে সেবার মান ভালো হবে৷’’
আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী এক হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করার পর সেসব বাধা উঠবে কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে বিটিআরসি চেয়ারম্যান জহুরুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেছেন, টাকা হাতে পাওয়ার আগে বিস্তারিত কোনো মন্তব্য করতে চান না৷ অন্যদিকে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘তারা আগে টাকা দিক তারপর দেখব কিভাবে সমাধান হবে? আগে তো টাকা দিতে হবে৷ আসলে তারা টাকা দিয়ে আদালতে গেলে আদালত একটা নির্দেশনা দেবেন, আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব৷’’
গ্রামীণফোন টাকা না দিলে প্রশাসক বসানোর বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত নেয়া আছে বলে জানান তিনি৷ মন্ত্রী বলেন, ‘‘নিরীক্ষা প্রতিবেদন নিয়ে গ্রামীণফোনের সঙ্গে একটা সংকট থাকায় দু’টি বিষয়ে আমরা নজর দিতে পারিনি৷ একটা হল এসএমপি (সিগনিফিকেন্ট মার্কেট পাওয়ার) ও কোয়ালিটি অব সার্ভিস (সেবার মান)৷ এখন আমরা এ দিকে নজর দেব৷ কারণ সরকার তো বসে থাকতে পারে না৷’’
সাম্প্রতিক সময়ে গ্রামীণফোনের সেবার মান নিয়ে অভিযোগ অনেক বেড়েছে বলে জানান মন্ত্রী৷ তিনি বলেন, ‘‘তাদের সার্ভিস (সেবা) এখন তলানিতে৷ তারা এতদিন মনোপলি (একচেটিয়া ব্যবসা) করে সাড়ে সাত কোটি গ্রাহক করেছে, কিন্তু ঠিকমতো সেবা দিচ্ছে না৷ তাই সরকার তাদের মনোপলি ভাঙতে কয়েকটি উদ্যোগ নিয়েছে৷ এর একটি হল রাষ্ট্রীয় কোম্পানি টেলিটকের নেটওয়ার্ক আরো শক্তিশালী করা৷ সেবার মান ভালো করা৷ এ কারণে নেটওয়ার্ক বাড়াতে টেলিটকের কিছু যন্ত্রপাতি আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে৷’’ টেলিটকের নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করতে নতুন একটি প্রকল্প তৈরি করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি৷ মন্ত্রীর আশা এর ফলে গ্রামীণফোন তার সেবার মান না বাড়ালে গ্রাহক হারাতে থাকবে৷
তবে নিজেদের সেবার মান তত খারাপ নয় বলে মনে করে গ্রামীণফোন৷ প্রতিষ্ঠানটি হেড অব এক্সটার্নাল কমিউনিকেশন মো. হাসান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এনওসি বন্ধের কারণে কিছু সমস্যা আমাদের হয়েছে সত্যি৷ কিন্তু আমরা গ্রাহকদের সেবা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি৷ এখন যদি নিয়ন্ত্রক সংস্থা আমাদের সবকিছু উন্মুক্ত করে দেয় তাহলে খুব শিগগিরই সেবার মান আরো ভালো করা সম্ভব৷’’
সম্প্রতি গ্রামীণফোনের নতুন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইয়াসির আজমান সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, ‘‘নেটওয়ার্কে আমরা এর মধ্যে কোন বিনিয়োগ করতে পারিনি৷ এই বছরে নেটওয়ার্কের মান উন্নতিতে আমরা বড় অংকের টাকা বরাদ্দ রেখেছি৷ সংকটের নিরসন হলেই আমরা কাজ শুরু করব৷’’
তবে নিরীক্ষা নিয়ে তৈরি হওয়া জটিলতার সঙ্গে সেবার মানের বিষয়টিকে মেলানো ঠিক নয় বলে মনে করেন এসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস বাংলাদেশের (এমটব) সাবেক সাধারণ সম্পাদক টি আই এম নুরুল কবির৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘(এই) দু'টো ভিন্ন জিনিস৷ রেগুলেটরকে (নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানকে) কোয়ালিটি অব সার্ভিসের ব্যাপারে কঠোর হতে হবে৷ লাইসেন্সিং গাইডলাইন অনুযায়ী তাদের যে ধরনের সেবা দেওয়ার কথা সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রেগুলেটরের৷ এখন মানুষ যে সেবা পাচ্ছে না তার দায়দায়িত্ব কে নেবে? নিয়ন্ত্রক সংস্থা না অপারেটর?’’ তবে এনওসি বন্ধের কারণে কিছু সমস্যা হওয়ার কথা স্বীকার করেন এই টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ৷
এর আগে বৃহস্পতিবার আপিল বিভাগ গ্রামীণফোনকে সোমবারের মধ্যে বিটিআরসির কাছে এক হাজার কোটি টাকা পরিশোধের নির্দেশ দেয়৷ তিন মাসে দুই হাজার কোটি টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও এরমধ্যে কোন টাকাই বিটিআরসিকে দেয়নি গ্রামীণফোন৷ সোমবারই শেষ হচ্ছে সেই তিন মাসের মেয়াদ৷ টাকা না দিয়ে আপিল বিভাগের আদেশ পুনর্বিবেচনা চেয়ে রিভিউ আবেদন করে প্রতিষ্ঠানটি৷ ঐ আবেদনের শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগ নতুন সিদ্ধান্ত দেয়৷
গ্রামীণফোনের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে নানা অসংগতি পাওয়ায় বিটিআরসি তাদের কাছে ১২ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা দাবি করে৷ গত বছরের ২ এপ্রিল দাবিকৃত টাকা দেওয়ার জন্য গ্রামীণফোনকে চিঠি দেয় সংস্থাটি৷ একইভাবে রবির কাছেও নিরিক্ষা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সাড়ে ৮০০ কোটি টাকা দাবি করে বিটিআরসি৷ এর মধ্যে ১৩৮ কোটি টাকা পাঁচ মাসে সমান কিস্তিতে পরিশোধের নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট৷ আদেশ মেনে এরইমধ্যে তারা প্রথম কিস্তির ২৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা জমা দিয়েছে৷
দেখুন ২০১৮ সালের মার্চের ছবিঘরটি...